রাজ্যসভা ভোটে কি কংগ্রেসের প্রার্থীকে সমর্থন করবেন তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়?
হাইকম্যান্ডের নির্দেশে এআইসিসি-র সাধারণ সম্পাদক শাকিল আহমেদ শনিবার সেটাই জানতে এসেছিলেন ইউপিএ-র দ্বিতীয় বৃহত্তম শরিকের সর্বময় নেত্রীর কাছে। কংগ্রেস সূত্রের খবর, তেমন কোনও ‘আশা’ নিয়ে আজ, রবিবার দিল্লি ফিরছেন না শাকিল।
জোট সূত্রের খবর, সরাসরি ‘না’ বলেননি ঠিকই। কিন্তু কংগ্রেসকে সমর্থনের প্রশ্নে মমতা ‘সম্মতি’ও দেননি। জোটের এক শীর্ষ নেতার কথায়, “একটা প্রাথমিক আলোচনা হয়েছে। তার ভিত্তিতে কোনও সিদ্ধান্ত নেওয়া ঠিক হবে না। তবে উনি (মমতা) আকারে-ইঙ্গিতে বুঝিয়ে দিয়েছেন যে, কংগ্রেসের প্রার্থীকে সমর্থনের কথা এখনও ভাবছেন না।”
শাকিল কী ‘বার্তা’ পেলেন?
কংগ্রেসের এক নেতার কথায়, “উনি হতাশ, তা বলছি না। তবে নিশ্চিন্তও নন।”
তৃণমূলের এক শীর্ষ নেতার কথা মানতে হলে, জোটের বড় শরিকের সমর্থনে এ রাজ্য থেকে রাজ্যসভায় কংগ্রেসেরও একটি আসন বাড়িয়ে নেওয়ার সম্ভাবনা এখনও দেখা যাচ্ছে না। তৃণমূলের ওই নেতার কথায়, “এটুকু বলতে পারি যে, তিন জন প্রার্থীকে রাজ্যসভায় পাঠানোর পরেও আমাদের কাছে বাড়তি প্রার্থীর জন্য প্রয়োজনীয় সংখ্যা রয়েছে।” মমতার উদ্দেশ্য খুব স্পষ্ট রাজ্যসভায় সাংসদের সংখ্যা আরও বাড়িয়ে নেওয়া। আপাতত লোকসভা এবং রাজ্যসভা মিলিয়ে তৃণমূলের সাংসদ সংখ্যা ২৫। আসন্ন রাজ্যসভা ভোটে তা ২৭ হবেই (মুকুল রায় পুনর্নির্বাচিত হবেন। নির্বাচিত হবেন নতুন দু’জন। মমতা তা আরও একটি বাড়াতে চান। কংগ্রেসকে সমর্থন করলে তা হবে না।) সে ক্ষেত্রে কংগ্রেস কি রাজ্যসভায় আদৌ প্রার্থী দেবে?
রাজ্য কংগ্রেসের নেতাদের একাংশের মতে দেওয়া উচিত। |
সরাসরি হিসেবে রাজ্যসভার প্রতিটি আসনের জন্য ৪৯ জন বিধায়কের সমর্থন দরকার। কিন্তু কংগ্রেসের মোট বিধায়ক সংখ্যা ৪২। চোপড়ার ‘নির্দল’ বিধায়ক হামিদুল রহমানকে ধরলেও (যিনি এখন তৃণমূলের দিকে এক পা বাড়িয়ে রয়েছেন) সেই সংখ্যা ৪৩-এ পৌঁছবে। যা প্রয়োজনীয় বিধায়ক সংখ্যার চেয়ে ছ’টি কম। এই পরিস্থিতিতে জোটের বড় শরিক মমতার উপরই কংগ্রেস ‘নির্ভরশীল’। তৃণমূলের তিন প্রার্থীকে ৪৯টি করে ভোট দিয়েও মমতার হাতে ৩৮টি বাড়তি ভোট থাকবে।
রাজ্য কংগ্রেসের এক শীর্ষ নেতার কথায়, “সরাসরি লড়াই হলে কিন্তু তৃণমূলের চেয়ে আমাদের ভোট বেশি। তৃণমূলের বাকি বিধায়ক সংখ্যা ৩৮। কংগ্রেসের ৪২। হামিদুলকে ধরলে ৪৩। আর গোর্খা জনমুক্তি
মোর্চার তিন জনের ভোট পেলেও তৃণমূলের মোট সংখ্যা হবে ৪১। হামিদুলের ভোট তৃণমূলের দিকে গেলেও দু’পক্ষেরই ৪২। তখন তৃণমূলকে দ্বিতীয় পছন্দের ভোট পেতে হবে। সে ক্ষেত্রে অবশ্য ওরা জিতে যাবে।”
ওই নেতা জানাচ্ছেন, প্রার্থী দেওয়ার ভাবনা কংগ্রেসে রয়েছে (ইতিমধ্যেই সম্ভাব্য প্রার্থী হিসেবে ১৫টি নাম হাইকম্যান্ডের কাছে পাঠানোর জন্য তালিকাভুক্ত করা হয়েছে)। তবে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে হাইকম্যান্ড। কারণ এর সঙ্গে জাতীয় রাজনীতির প্রশ্নও জড়িত। বস্তুত সেই জন্যই বামেদের বাড়তি ভোট নিয়ে কিছু ভাবছেন না রাজ্য কংগ্রেস নেতৃত্ব। নিজেদের প্রার্থীকে জিতিয়েও বামেদের হাতে ১২টি বাড়তি ভোট থাকবে। কিন্তু এই পরিস্থিতিতে বামেদের সমর্থন নেওয়ার প্রশ্ন নেই (রাজ্যসভার ভোট এখন আর গোপন ব্যালটে হয় না) বলেই রাজ্য কংগ্রেসের নেতাদের দাবি। রাজ্য কংগ্রেসের এক নেতার কথায়, “সিদ্ধান্ত যা নেওয়ার, দ্রুত নিতে হবে। কারণ, ১৯ তারিখ বেলা তিনটের মধ্যে মনোনয়ন জমা দিতে হবে। ফলে ১৩-১৪ তারিখের মধ্যে ফয়সালা করতেই হবে।”
পক্ষান্তরে তৃণমূলের অন্দরের খবর, নিজেদের ১৮৫ জন বিধায়কের সমর্থন ছাড়াও তারা মোর্চার তিন জন এবং মোর্চা-সমর্থিত এক বিধায়ক মোট চারটি ভোট পাবে (জিটিএ চুক্তি নিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর ভূমিকা এ ক্ষেত্রে ‘প্রণিধানযোগ্য’)। ফলে তারা মোট ১৮৯ জনের সমর্থন পাবে। রাজ্যসভার ‘অঙ্ক বিশারদ’ এক তৃণমূল নেতা জানাচ্ছেন, সেক্ষেত্রে প্রাথমিক ভাবে ঠিক হয়েছে, তৃণমূল নিজেদের তিন প্রার্থীকে ৪৭টি করে ভোট এবং চতুর্থ প্রার্থীকে ৪৮টি ভোট দেবে। মোর্চার চার বিধায়ক শেষমেষ ভোটদানে ‘বিরত’ থাকলেও ১৮৫টি ভোটের ভাগাভাগিতে তিন জন প্রার্থীকে ৪৬টি করে ভোট এবং চতুর্থ প্রার্থীকে ৪৭টি ভোট দেবে। সে ক্ষেত্রেও তাদের ভোট কংগ্রেসের চেয়ে বেশি থাকবে।
তৃণমূল নেতাদের কথায়, “ওঁরা মোর্চার তিন বিধায়কের সমর্থনের কথা বলছেন। সম্ভবত, মোর্চা-সমর্থিত কালচিনির বিধায়কের চতুর্থ ভোটের কথাটা তাঁদের হিসেবে নেই!”
প্রসঙ্গত, কংগ্রেস-তৃণমূলের মধ্যে সরাসরি লড়াই হলে ন্যূনতম ৪৯টি ভোটের প্রশ্ন আসবে না। সে ক্ষেত্রে যারা বেশি ভোট পাবে, তারাই সরাসরি জিতবে। যার উদাহরণ হিসেবে তৃণমূল শিবির ২০০০ সালের রাজ্যসভা ভোটের কথা বলছে। সেই ‘কম্বিনেশন’ই এই ভোটে ফিরে আসছে। ২০০০ সালের সেই রাজ্যসভা ভোটেও জিততে ন্যূনতম ৪৯টি ভোটের প্রয়োজন ছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কংগ্রেসের ‘সরকারি’ প্রার্থী দেবপ্রসাদ রায়ের বিরুদ্ধে তৃণমূল-সমর্থিত নির্দল প্রার্থী জয়ন্ত ভট্টাচার্যের সরাসরি লড়াইয়ে জেতেন জয়ন্তবাবু। দেবপ্রসাদবাবু পান ৩৭টি ভোট। ৪৩টি ভোট পান জয়ী জয়ন্তবাবু।
ঠিক সেই হিসেবেই তৃণমূল শিবির মনে করছে, কংগ্রেসের সঙ্গে সরাসরি লড়াই হলে তারাই জিতবে। যে হিসেবে ভর করে দলের এক প্রথম সারির নেতা বলেছেন, “আমাদের কাছে প্রয়োজনীয় সংখ্যা রয়েছে।”
তবে তৃণমূলের অন্দরেই আরও একটি ‘সম্ভাবনা’র কথা বলা হচ্ছে। রাজ্যসভা নিয়ে সরাসরি কংগ্রেসের সঙ্গে ভোটযুদ্ধে নেমে পড়লে ‘ভুল বার্তা’ যেতে পারে। সে ক্ষেত্রে মমতা কংগ্রেসের থেকেই তাঁর ‘পছন্দসই’ প্রার্থী বেছে দিতে পারেন। তখন আর ভোটের দরকার হবে না। কিন্তু পাশাপাশিই প্রশ্ন: প্রার্থী দিয়ে জয়ের বিষয়ে ‘নিশ্চিত’ থাকলে মমতা তেমনই বা করবেন কেন?
মমতা-শাকিল বৈঠকের পর কংগ্রেস নেতৃত্বও তেমন আশা করছেন না। শুক্রবার গভীর রাতে ঠিক হয়, মমতার সঙ্গে কথা বলে রাজ্যসভা নিয়ে শাকিল তাঁর ‘মন বোঝা’র চেষ্টা করবেন। তার পর রিপোর্ট দেবেন হাইকম্যান্ডকে। মমতা দেখা করতে অনীহা দেখাননি। আধ ঘণ্টার বৈঠকে মমতার সঙ্গে ছিলেন তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক তথা কেন্দ্রীয় মন্ত্রী মুকুল রায়ও। বৈঠকের পর শাকিল বিষয়টিকে ‘সৌজন্য সাক্ষাৎকার’ বলেই জানিয়েছেন। জানিয়েছেন, মাওবাদী নেত্রী সুচিত্রা মাহাতোর আত্মসমর্পণের ‘সাফল্যে’র জন্য তিনি মমতাকে এআইসিসি এবং সনিয়া গাঁধীর তরফে ‘শুভেচ্ছা’ জানিয়েছেন। রাজ্যসভা ভোট আলোচনা প্রসঙ্গে শাকিল বলেছেন, “রাজ্যসভার ভোট আলোচনার বিষয় ছিল না। তবে মূল আলোচনার পাশাপাশি ওই বিষয়েও কথা হয়েছে।”
মমতা বা মুকুলবাবু কেউই মুখ খোলেননি।
রাজ্য কংগ্রেসের এক নেতার কথায়, “দিল্লি সম্ভবত প্রার্থী দেবে। কিন্তু সেটা হাইকম্যান্ডকেই ঠিক করতে হবে। এই ব্যাপারটা তো শুধু রাজ্য রাজনীতিতে সীমাবদ্ধ থাকবে না। জাতীয় রাজনীতিতেও এর প্রভাব পড়বে।”
ওই নেতার আরও বক্তব্য, “সরাসরি জোটের সঙ্গে এর কোনও সম্পর্ক নেই। কিন্তু একটা রাজনৈতিক লড়াই তো হয়েই যাবে!” দেখার, মমতা সেই ‘লড়াই’য়ে যান কিনা। |