ধুধু মাঠের পরে ছোট্ট একটা টিলা। টিলার উপরে একটি কুঁড়ে ঘর। ঘরটার ভেতর থেকে একটানা একটা ঘর্ঘর্ শব্দ আসছিল। এক সময় সেই শব্দটা প্রচণ্ড জোরে হাউমাউখিকিজবিজ্-এ বদলে গেল। ভয় পেয়ে উড়ে গেল পাখির ঝাঁক।
শব্দটা হুকুম সিংয়ের ঘুম থকে উঠে আড়মোড়া ভাঙার। সে আসলে নাম করা শিকারি। তার বাপ-ঠাকুর্দাও ছিলেন তাই। তাঁদের বন্দুকের নিশানার পড়ে বাঘ-সিংহ-হাতি-বাইসনেরা সব এই মুল্লুক ছেড়ে কবেই ভেগে গিয়েছে। বেচারা হুকুম সিংয়ের শিকার করার মতো কিছুই পড়ে নেই।
ঘুম তো ভাঙল। তার পরেই আসল সমস্যাটা দেখা দিল! পেটের ভেতর ঘোঁয়াওঘোঁয়াও করে চলতে শুরু করল একটা মেশিন। যেটাকে সবাই খিদে বলে। হুকুম ঘরের কৌটো, হাঁড়ি, খাটের তলা, ছাদের উপর, সর্বত্র তল্লাশি করে পেল একটুখানি আটা! তা দিয়ে আর যা-ই হোক না কেন, অত জোরালো খিদেটা মেটে না।
তা হলে শিকারই করা যাক, ভাবল হুকুম। তাতেও তো সমস্যা! বাপ-ঠাকুর্দার আমলের গাদা বন্দুকের নলে ফাট ধরেছে। ফুরিয়ে গিয়েছে গোলা আর বারুদ। হুকুম তবে শিকারটা করে কী করে? কিছু না থাকুক, হুকুমের বুদ্ধিটাতে তো আর মরচে ধরেনি। সে ঘরের কোণে রাখা বন্দুকের নলে কৌটোর তলায় পড়ে থাকা আটাটাকে বারুদের মতো করে গেদে নিল। নলের মুখে বসাল একটা নুড়ি পাথর। একদম তৈরি হয়ে বের হয়ে পড়ল বীর শিকারি হুকুম সিং।
কেটে গেল কত ঘণ্টা। এ ঝোপ, ও গাছ, পাথরের খাঁজেটাজে উঁকি মেরেও হুকুমের নজরে এল না কোনও জানোয়ার। শেষে সূর্য যখন ডুবুডুবু, একটা ঘাসের জঙ্গল সামান্য ফাঁক করতেই চোখে পড়ল ঘুমন্ত মোটাসোটা খরগোশ। তাড়াতাড়ি তাক করেই ফায়ার করে দিল হুকুম। তার পরে তার চোখের সামনে পৃথিবীটাই যেন অদৃশ্য হয়ে গেল।
ফায়ার করতেই ফাট ধরা গাদা বন্দুকের নল থেকে সমস্ত আটা উড়ে ঢেকে ফেলেছিল হুকুমের দু’চোখ। বন্দুকের নলের মুখের পাথরটা গিয়ে পড়েছিল খরগোশের মাথার কাছাকাছি। আচমকা ঘুম ভেঙে খরগোশের চোখে পড়ল হুকুমের আটায় ভরপুর ইয়া গোঁফ আর মুখ। পাথরটাও মাথার কাছে পড়তে যে প্রচণ্ড শব্দটা হল তাতে খরগোশ ভাবল, মহাপ্রলয় ঘটে গিয়েছে। তাতেই সে পটল তুলেছে। তার আত্মাকে নিয়ে যেতে এসেছে কদাকার যম দূত! চোখ উল্টে সে তো ভিরমি খেল।
দু’চোখ মুছে, হুকুম দেখল খরগোশটা অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে। সে মনে মনে নিজেকে প্রচণ্ড বাহবা দিল। ভাবল, ‘আরে আমি হচ্ছি বীর শিকারি হুকুম সিং। রাইফেল সিংয়ের নাতি আর টোটা সিংয়ের ছেলে। বারুদ, গুলি নেই তো কী? আমি আটা আর পাথর দিয়েই কেমন শিকার করেছি দেখ!’ খরগোশের লম্বা কান দুটো কষে পাকড়ে, সে ফিরে চলল নিজের ডেরায়।
তখনই, সারা দিন ঘুমিয়ে পথে বের হয়েছে মোড়লের ছেলে বাচ্চা সিং। টাট্টু ঘোড়ার পিঠে চড়ে চলেছে ইয়ারদোস্তদের সঙ্গে আড্ডা দিতে। বাচ্চা গ্রামের মধ্যে সবচেয়ে দুষ্টু ছেলে। লোকে গাছের পাকা ফল, খাঁচার মুর্গি, ওর উৎপাতে রাখতে পারেনা। কত জিনিসপত্র যে বাচ্চা নষ্ট করেছে মজা করতে গিয়ে, হিসেব নেই। বাচ্চা পথে নামলে লোকে লুকোয়। পাছে সঙ্গে থাকা মালপত্র কেড়ে নেয় ভুলিয়েভালিয়ে! |
ছবি: ওঙ্কারনাথ ভট্টাচার্য |
সেই বাচ্চার চোখে পড়েছে হুকুম সিংয়ের হাতের মোটা খরগোশটা। কী করে বুড়োটাকে বোকা বানিয়ে খরগোশটা হাতাবে, তা নিয়ে দারুণ ব্রেন খাটাতে শুরু করেছে বাচ্চা। সে হুকুমকে বলেছে, “খরগোশটা বেচবে চাচা? আহা, কত দিন খরগোশের মাংস খাইনি গো। বেচো না চাচা। আমি তোমাকে একশো টাকা দেব।”
খিদের মুখে এমন একটা প্রস্তাবে হকচকিয়ে গিয়েছে খোদ হুকুম। ভেবেছে, ‘একশো টাকা মানে কী? একশো টাকা মানে দশটা দশ টাকা। কুড়িটা পাঁচ টাকা, পঞ্চাশটা দু’টাকা! বাবা, একটা খরগোশের দাম এত বেশি?’ খানিকটা সম্মোহিতের মতোই হুকুম, বাচ্চার দিকে খরগোশটা বাড়িয়ে দিয়েছে। বাচ্চা যখন খরগোশটাকে হাতে নিয়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখছে, তখন গামছা দিয়ে নিজের কপালের ঘামটা মুছে নিচ্ছে হুকুম। আসলে প্রতীক্ষা করছে, টাকাটা হাতে পাওয়ার।
বাচ্চা ততক্ষণে ঘোড়ার লাগামটা টেনে ধরেছে। মেরেছে ঘোড়ার তলপেটে লাথি। ঘোড়াও টগবগিয়ে তেপান্তরের পথ ধরেছে। খিদে ভুলে হুকুম দৌড়েছে ঘোড়ার পিছনে। বলেছে, “আরে ভাতিজা, খরগোশটা নিলে আর দামটা দিতে ভুলে গেলে?” কিন্তু ঘোড়ার সঙ্গে কী আর মানুষ পারে? কিছুটা দৌড়ে হাঁফিয়ে, থমকে দাঁড়িয়ে পড়েছে হুকুম। তার পরে গলা তুলে বলেছে, “যাও, যাও, ভাতিজা। খরগোশটা তোমাকে উপহারই দিলাম। শিকারিরা, শিকার বিক্রি করে না। দানই করে দেয়।” হুকুম যে তাকে ভদ্রতা করে ছেড়ে দিয়েছে, সে কথা কানে গেলে তো বাচ্চার!
খরগোশের জ্ঞান অনেক আগেই ফিরেছিল। এত ক্ষণ বীর শিকারি হুকুমের হাতে ছিল সে। শিকারির সন্মান যাতে নষ্ট না হয়, তাই খরগোশ মটকা মেরে ছিল। বাচ্চার হাতে পড়তেই তার মনে হল, ‘একটা সে দিনের ছোঁড়া আমার কান ধরে নিয়ে যাবে? আফটারঅল আমারও সম্মান আছে।’ তাই খরগোশ মেরেছে মস্ত লাফ। গিয়ে পড়েছে ঘোড়ার নাকের উপরে। যন্ত্রণায় ঘোড়াও চিঁহি চিঁহি করে দু’পা তুলে দাঁড়িয়েছে। আর ঘোড়ার পিঠ থেকে পাকা আমের মতো টুপ করে খসে পড়েছে বাচ্চা! পড়ে তার কোমরই যেন ভেঙে গিয়েছে। কষ্টের চোটে, বাবা গো, মা গো, বলে কাঁদতে শুরু করেছে।
ফাঁকা মাঠের মধ্যে বাড়ি পথ ধরা হুকুমের কানে গিয়েছে সেই কান্না। সে ছুটে এসেছে বাচ্চার কাছে। তাকে ঘাড়ে নিয়ে পৌঁছে দিয়েছে মোড়লের বাড়িতে। মোড়ল কানপাত্লা সিং সব শুনে গম্ভীর হয়ে গিয়েছেন। নিজের ছেলে দোষ করেছে বলে চুপ করে বসে থাকেননি। বিচারসভা ডেকে বাচ্চাকে ১০০ বার ওঠবোস করার সাজা দিয়েছেন। আর হুকুমের জন্য বরাদ্দ করেছেন দুবেলার আহার। বিনিময়ে, হুকুমকে সারা দিন গ্রামের খেত পাহারা দিতে হবে।
সুখেই আছে হুকুম। কাঁধে ফাঁকা গাদা বন্দুক নিয়ে সে খেত পাহারা দেয়। এই পাহারা দেবার কথা রটে গিয়েছে গ্রামগ্রামান্তরে। তার নামডাকের বহরে পাখিটাখিতেও ওই দূর পাহাড়ি গ্রামের খেতে উঁকি মারতেও আসে না। দেখা হলেই এক দল পাখি অন্য দলকে বলে, ওখানে ভুলেও যেয়ো না। খবরদার, হুকুম সিং আছে!
|