বড়রা একটু দায়িত্ব নিন
ফিটনেস, কোনও বাবা মা-ই বাজার থেকে কিনে সন্তানকে এনে দিতে পারেন না। এ তো কোনও ওষুধ বা হেলথ ড্রিঙ্ক নয়, যে চিকিৎসক প্রেসক্রাইব করল আর আপনি টুক করে খাইয়ে দিলেন। ফিটনেস প্রত্যেককেই অর্জন করতে হয়, তা সে বয়সে বড় হোক বা ছোট। এক দিকে পড়াশুনার চাপ বেড়ে যায়, অন্য দিকে খেলাধুলোর সুযোগ কমে যায়। তার ওপর কেরিয়ার নিয়ে অভিভাবক অভিভাবিকাদের মাত্রাতিরিক্ত চাপ। এই সব এক সঙ্গে সামলাতে গিয়ে বাচ্চারা আরও বেশি করে ফিটনেসের সমস্যায় পড়ে যাচ্ছে। কয়েক বছর আগেও যে সব অসুখগুলি হতে পারে বলে ভাবা যেত না, সেই অসুখগুলি অজান্তেই ওদের শরীরে বাসা বাঁধছে। যেমন স্ট্রেস, টেনশন সিনড্রোম, উচ্চ রক্তচাপ, অতিরিক্ত স্থূলতা, থাইরয়েড সমস্যা, ডায়াবিটিস, অনিদ্রা, আলসার, হাঁপানি প্রভৃতি। দশ থেকে পনেরো বয়সী ছেলেমেয়েরা সব থেকে বেশি ফিটনেস চায়। বেড়ে ওঠার বয়সে, দৈহিক ও মানসিক ভাবে ফিট থাকা জরুরি। এতে শারীরিক ভঙ্গিমা (Posture) ঠিক হয়। অতিরিক্ত রোগা বা মোটা লাগে না। শরীর চনমনে থাকে, অসুস্থতা বা চোট আঘাত থেকে সহজেই সেরে ওঠে, ধকল নিতে পারে, ঘুম ভাল হয়, হীনম্মন্যতা ইত্যাদি মানসিক সমস্যাগুলো কাটিয়ে ওঠে, এর ফলে ওদের পড়াশুনাও বেশ ভাল হতে থাকে।
এই সব সুফলগুলি পেতে, প্রাথমিক দায়িত্বটা বড়দেরই নিতে হবে। পড়াশুনার সঙ্গেই ভাল স্বাস্থ্যের অধিকারী হওয়া যে জরুরি, সে ব্যাপারে ওদের আগ্রহী করে তোলা প্রয়োজন। সন্তানের ভবিষ্যতের কথা ভেবে, আপনি নিজেই ওদের রোল মডেল হিসাবে ওদের সামনে উপস্থিত হন। এর জন্য আপনার জীবনযাত্রার ভুল ত্রুটিগুলো শুধরে নেওয়া প্রয়োজন। যদি নিজেই কখনও শরীরচর্চা না করেন, নিয়মিত মদ্যপান, ধূমপান, তামাক সেবন করে উচ্ছৃঙ্খল জীবন যাপন করেন, তা হলে কী করে ছোটদের ফিটনেসের পাঠ পড়াবেন? কী ভাবেই বা ওদের ব্যায়াম করতে উৎসাহিত করবেন? আজকালকার ছেলেমেয়েরা কিন্তু বড়দেরই প্রশ্নের সামনে দাঁড় করিয়ে দেবে। ছোটদের ফিট রাখতে চাইলে আগে বাড়ির বড়দেরই ফিট হতে হবে।
ধীরে ধীরে ওদের ব্যায়ামে আগ্রহী করে তুলুন। এতে ওরা নিয়মিত উৎসাহ পাবে। বাচ্চাদের শরীরচর্চার ধরন এমন হওয়া উচিত, যাতে ওদের অভ্যন্তরীণ স্বাস্থ্য, বিশেষত হার্ট আর লাংস অনেক বেশি শক্তিশালী হয়। তা ছাড়া, জয়েন্ট ও মাংসপেশিগুলির নমনীয়তা বৃদ্ধি হয়, পর্যাপ্ত শক্তি ও সহ্যক্ষমতা জন্মায়, শরীরে অতিরিক্ত না জমে এবং ওদের স্বাভাবিক বৃদ্ধি হয়। অর্থাৎ প্রস্থের তুলনায় উচ্চতা বৃদ্ধিকে আরও ত্বরান্বিত করা যায়।
মোট ৩০ থেকে ৪০ মিনিট সপ্তাহে ৫ দিন ঘুরিয়ে ফিরিয়ে ব্রিদিং এক্সারসাইজ, স্কিপিং, এজিলিটি রান, হেক্সাগোনাল জাম্প, বল অ্যাক্টিভিটি, সাইক্লিং, স্ট্রেনথ ট্রেনিং, পিলাটিস, যোগাসন এবং মেডিটেশন অভ্যাস করতে হবে। মনে রাখবেন, প্রতিটা বাচ্চার ফিটনেস লেভেল আলাদা। শারীরিক সক্ষমতা, বয়স, চেহারার গড়ন এবং হেরিডিটি অনুযায়ী ব্যায়ামের প্রয়োজনটা আলাদা আলাদা হতে পারে। তাই, সবার আগে, প্রত্যেকের জন্য আলাদা ভাবে একটা ফিটনেস সমীক্ষা করিয়ে নিন।

অনেক সময় শরীরচর্চা ওদের কাছে একটা শাস্তি বলে মনে হতে পারে, যার ফলে কয়েক দিনের মধ্যে হয়তো উৎসাহ হারিয়ে ফেলতে পারে কিংবা একঘেয়ে হয়ে ওঠে। আপনাকে খেয়াল রাখতে হবে, আপনার সন্তান যেন তার প্রয়োজন মতো শরীরচর্চার সুবিধা পায়, ব্যায়াম করতে উৎসাহিত বোধ করে এবং ঠিক মতো মনোনিবেশ করে।
সরাসরি ব্যায়ামের পরিবর্তে বিভিন্ন খেলাধূলার মাধ্যমেও ওদের ফিট রাখা যায়। অবশ্য এই ব্যাপারে আপনাকেও একটা শর্ত মানতে হবে। খেলাধূলার অভ্যাস যেন ঋতুভিত্তিক না হয়, তা হলে খুব একটা ভাল ফল পাওয়া যাবে না। আর কোনও নির্দিষ্ট খেলা ওদের ওপর জোর করে চাপিয়ে দেবেন না। এতে কিন্তু হিতে বিপরীত হতে পারে। আগ্রহ ও আনন্দের সঙ্গে অন্যদের সঙ্গে খেলতে না পারলে অনেক সময় অন্যদের সঙ্গে পেরে উঠতে পারে না। এর ফলে ভিতর ভিতর একটা হীনম্মন্যতা জন্ম নেয়। নিজেদের সাইডলাইনের খেলোয়াড় ভাবতে শুরু করে। কোনও ট্রেনিং সেন্টারে গিয়ে খেলাধুলোর অভ্যাসটাই কিন্তু সব নয়। বাড়ির সামনের মাঠ কিংবা পার্কটাও ওদের ফিট রাখতে সাহায্য করে। ছুটির দিনে বন্ধুদের সঙ্গে একটু খেলতে দিন। এতে ওদের শরীর ও মন তরতাজা থাকবে।
স্কুলের ফিজিক্যাল এডুকেশন প্রোগ্রামগুলির খোঁজখবর রাখুন। ফিজিক্যাল এডুকেশন-এর নাম করে স্কুল যদি শুধু বাচ্চাদের রোদে দাঁড় করিয়ে রাখে, কিংবা যৎসামান্য পি টি বা নিয়মমাফিক কয়েকটা ড্রিল করিয়েই ছেড়ে দেয়, তা হলে কিন্তু চলবে না। বাচ্চাকে এমন স্কুলেই ভর্তি করান, যেখানে ভাল পড়াশোনার সঙ্গে সঙ্গে সব ছাত্রছাত্রীর জন্য সমান খেলাধূলার সুযোগ থাকে।
নৃত্যাভ্যাস কিন্তু এক ধরনের ‘যোগ চর্চা’। নাচের মাধ্যমেও আপনার সন্তানের যোগাভ্যাস চলতে পারে। নাচের প্রতি যদি আগ্রহ থাকে, নাচের ক্লাসে ভর্তি করে দিন। এতেও ওদের শরীর ফিট থাকবে।
সবচেয়ে ভাল হয়, নিয়মিত ব্যায়াম, খেলাধূলা, উপযুক্ত খাদ্যাভ্যাস, ঘুম, বিশ্রাম, ওদের শারীরিক ক্ষমতা, মানসিক চাহিদা, আনন্দ, উৎফুল্ল ভাব এই সব কিছু মাথায় রেখে ধীরে ধীরে আপনার বাড়িতেই একটা ফিটনেস-এর সংস্কৃতি তৈরি করতে পারেন। এতে সাফল্য পাবেন সবচেয়ে বেশি।

সারা দিন শরীরে শক্তি জোগানোর প্রাথমিক দায়িত্ব ব্রেকফাস্ট-এর। তাই ভিটামিন ‘সি’, পটাশিয়াম, আয়রন, অ্যামাইনো অ্যাসিড, গ্লুকোজ এবং কমপ্লেক্স কার্বোহাইড্রেট সমৃদ্ধ স্বাস্থ্যকর প্রাতরাশ দিন। যেমন দুধ, কর্নফ্লেক্স, ওট্স, আটাব্রেড স্যান্ডউইচ, কলা, আপেল সহ বিভিন্ন টাটকা ফল ও ফলের রস, ডিম প্রভৃতি।
আমাদের শরীরে যে পরিমাণ ক্যালরি ক্ষয় হয়, লাঞ্চ এবং ডিনার সব সময় তাকে পূরণ করতে সাহায্য করে। তাই কখনও পিৎজা, বার্গার, হট ডগ, পেস্ট্রি, চিপ্স, কোল্ড ড্রিঙ্ক (কার্বোনেটেড ড্রিঙ্ক)-এর মতো খাবার দিয়ে লাঞ্চ বা ডিনার করাবেন না। ভাত, আটার রুটি, শাকসবজি, স্যালাড, বিভিন্ন ধরনের ডাল, মাছ, চিকেন, পনির, ঘরে পাতা দই, মিষ্টি ফল, এই ধরনের খাবার সহযোগে লাঞ্চ বা ডিনার ওদের দিন।
স্কুলের টিফিনকে সুস্বাদু এবং স্বাস্থ্যকর বানান। যা খেতে ভালবাসে, কষ্ট করে প্রতি দিন একটু ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে মেনু পাল্টে বানিয়ে দিন। আপনি নিজে হাতে টিফিন বানালে অন্তত আর যা-ই হোক, তার গুণগত মান নিয়ে আপনাকে আর দুশ্চিন্তায় থাকতে হবে না।
ডে বোর্ডিং স্কুল হলে খোঁজ রাখুন স্কুল যেন আপনার সন্তানকে জাঙ্ক ফুড, আর্টিফিশিয়াল ফুড কিংবা সংরক্ষণকারী পদার্থ (প্রিজারভেটিভ) দেওয়া খাবারগুলি না দেয়। মনে রাখবেন, সম্প্রতি ওয়ার্ল্ড হেলথ অর্গানাইজেশন (হু) সারা পৃথিবী জুড়ে স্কুলগুলিতে এবং তার আশেপাশে জাঙ্ক ফুডকে নিষিদ্ধ করার পরামর্শ দিয়েছে। আর আমাদের দেশের ফুড সেফটি অ্যান্ড স্ট্যান্ডার্ড অথরিটি অব ইন্ডিয়া (এফ এস এস এ আই) আগামী দিনে স্কুলের ক্যান্টিনগুলিতে জাঙ্ক ফুড বন্ধের ব্যাপারে বিধিনিষেধ জারি করতে চলেছে।
বাচ্চাদের প্রতি ভালবাসা দেখাতে গিয়ে সব সময় ওদের ক্যান্ডি, চকলেট উপহার না দিয়ে মাঝেমধ্যে এক-আধটা তাজা ফল, কিংবা টাটকা ফলের রস দিন। ন্যাশনাল ডায়াবেটিস ওবেসিটি অ্যান্ড কোলেস্টেরল ফাউন্ডেশন (এন-ডি ও সি) এবং সেন্টার অব নিউট্রিশন অ্যান্ড মেটাবলিক রিসার্চ (সি-নেট)-এর মতো সংস্থাগুলির সাম্প্রতিক সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে ক্যান্ডি, চকলেট, কার্বোনেটেড ড্রিঙ্ক এবং চিপ্স-এর প্রতি বাচ্চাদের অতিরিক্ত আসক্তি, উচ্চ রক্তচাপ, ওবেসিটি, কার্ডিয়োভাসকুলার প্রবলেম এবং গ্লুকোজ ইনটলারেন্স-এর মতো ক্রনিক রোগ ডেকে নিয়ে আসছে।
বাচ্চাদের স্ন্যাক্সও কিন্তু স্বাস্থ্যকর হতে পারে যদি তা অল্প তেল, চিনি, নুন, চিজ, মাখন, ক্রিম দিয়ে তৈরি হয়। তবে স্ন্যাক্স-এর মোট পরিমাণ কখনও যেন লাঞ্চ বা ডিনারের থেকে বেশি না হয়।
আপনার বাচ্চার ক্রমাগত মোটা হতে থাকা, কিছুতেই গায়ে মাংস না লাগতে দেখে যতই আপনি আতঙ্কিত হোন, এমন কোনও কঠিন ডায়েটিং করাবেন না যাতে ওদের স্বাভাবিক শারীরিক বেড়ে ওঠা থমকে যায়, বা কোনও অসুবিধের সৃষ্টি হয়। প্রয়োজনে বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিয়ে ঠিক পদ্ধতি অবলম্বন করুন।

যোগাযোগ: ৯৮৩৬০১৬২১৫



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.