|
|
|
|
রঙের আড়ালে আসলে আমি কে |
রং খেলা একটা সর্বজনীন কর্মকাণ্ড, কিন্তু রং তোলাটা ভীষণ ব্যক্তিগত।
চিন্তা
একটাই,
ধুতে ধুতে মুছতে মুছতে যদি আসল রংটা বেরিয়ে পড়ে? শুভময় মিত্র |
আসল ব্যাপার রংটা নয়। মতলব হল একটু রঙ্গ রসিকতা করার। রিস্ক একটাই। রহস্যময় রগড়টা সবাই বুঝবে তো?
দোলের সময় রং খেলা হবে, এই ভাবনাটা মাথায় আসে বছরের বিশেষ একটা সময়ে। তখন শীত যায় না, কিন্তু গরম লাগে মাঝে মাঝে। খবরের কাগজ তৃতীয় বার হুমকি দেয়, এ বার রেকর্ড গরম পড়বে। কলকাতার গভীর দক্ষিণের খোলা মেট্রো স্টেশন থেকেই চোখে পড়ে আরবান ল্যান্ডস্কেপে লাল পলাশের ছোপ। প্রথম দুপুরে চায়ের বদলে নজর যায় কোল্ড ড্রিংকসের বোতলে। একটু দেরি থাকা সত্ত্বেও নববর্ষের লাল সাদা স্ক্রিনসেভারটা কলিং বেল বাজায় পুরনো নিউ ইয়ারের নীল মনিটরে। এই সময়েই খেয়াল হয় যে বোলপুরের কোনও ট্রেনেই রিজাভের্শন পাওয়া যাচ্ছে না। বাজারের সবজিওয়ালা মত পাল্টে লেবু, টম্যাটো, ক্যাপসিকাম ছেড়ে হঠাৎ রং, পিচকিরি, বেলুন, আবির বেচতে বসে।
দোলটা আসে হঠাৎ। তার পর ধাঁ করে সরে যায়, দুপুর না গড়াতে। অ্যানাউন্সমেন্টের আগেই এসে পড়া এবং একটু দাঁড়িয়ে দুদ্দাড় করে চলে যাওয়া গোত্রহীন স্পেশাল ট্রেনের মতো।
সকালে একটু কুয়াশাহীন ঠান্ডা। এখানে ওখানে এক ছটাক রবীন্দ্রনাথ। হালকা করে আলতো ছোঁয়ায় ফাগের ধোঁয়া। একটু বেলায় পাড়ায় পাড়ায় জোকার টুপি। বারান্দা থেকে ভিতু ভিতু বেলুন হানা। কোন এলাকার ছেলে, কাদের বাড়ির মেয়ে হিসেব না করেই ভূত কালো চকচকে মুখে গোলাপি আবির মাখানোর অধিকার। এক চ্যানেলে টইটম্বুর অ্যাংরি হিরোর হাংরি হোলির ক্লিপিং। বদলে দিলে খেলব হোলি রং দেব না। চড়া রোদে, গাছের ছায়ায় তুমুল হাসির ছররা। কাউকে চিনতে না পেরে পাড়ার কুকুরদের বেমক্কা ভৌ, বেরংগিন ফুটপাথ রাস্তার কিনার ঘেঁসে থমকে থাকা হলুদ সবুজ ঘাস।
বিকেল হতেই সব চুপচাপ। সব ট্যাক্সি ঘুমোচ্ছে। |
|
সন্ধেবেলা নিউটাউনে নিয়মমাফিক চাঁদ। নিঃশব্দে শুষে নিচ্ছে টায়ার পোড়া আগুনের শীর্ষে ওঠা কমলা জোনাকিদের।
দোলটা যেন এক বেলায় শুটিং করা শর্টফিল্ম। ফিরে যাই কয়েক ঘণ্টার ফ্ল্যাশব্যাকে। জোর করে স্প্রিং ভেঙে পিছিয়ে দিই ঘণ্টার কাঁটা। সময় মুচড়ে দেওয়ার রংবাজিতে আতঙ্কে কাঁপতে থাকুক সেকেন্ডের তির, থরথর করে।
ড্রাই দোল আর ওয়াটার কালার হোলির মাঝপথে তড়িঘড়ি খসে যান কেউ কেউ। এটা এক ধরনের বয়স বাড়া অবসর। চশমা মুছে, চোখের পাতা ঝেড়ে, ময়লা পাঞ্জাবি ছেড়ে স্নান করে শুদ্ধ হয়ে নেন। নিয়েই আড়চোখে টেলিভিশনে দেখে নেন বিদ্যা বালনের কালারফুল নটি-পনা। এর পর গীতবিতানের পেজমার্ক সরিয়ে ওরে গৃহবাসী। কফি বা ফ্রুট জুস নিয়ে নিশ্চিন্ত আশ্রয় বাঙালি ইগলুতে।
ছোকরাছুকরিরাও ব্যতিক্রম নয়। অনেকের কাছে স্কিনটা জরুরি। কোল্ড প্রোটেকশন, হিট প্রোটেকশন, ডাস্ট প্রোটেকশন স্টক থইথই করছে। কিন্তু কালার গার্ড বাজারে নেই, মল-এও আসেনি। কালো মানুষ ফিকে হচ্ছে, ফ্যাকাশে লোক ফর্সা। ত্বক বদলের ফেয়ার প্লে-তে সবাই রাখে আস্থা। অথচ জাঁকিয়ে বসা বাঁদুরে রঙের খোসা ছাড়ানোর গ্যারান্টি নেই আজ তক।
তবু কিছু বেহিসেবি ছোট বড় উঠোন ফুটপাথ আঁকড়ে খেলে যায় রং নিয়ে। যাকে পারে তাকে রে রে করে তেড়ে গিয়ে রং মাখিয়ে। নিজের মাথায় শেষ বালতি উপুড় করে মাঝদুপুরে থম্। সূর্য তখন মাথার উপর টং।
পরের এপিসোড বাথরুমে, চলো সব দলে দলে। বেডরুমের চাদর, ড্রয়িং রুমের দেওয়াল বাঁচিয়ে সবার মাথা নত। যাদের বেসিন নেই, তারা টিপকলে।
কেরোসিন, নারকেলগন্ধী তেল, তেঁতুল-ছোবড়ার কাউন্টার অ্যাটাক। গোলাপির ওপর সবুজ, তার ওপরে বেগুনি, বেগুনির ওপর রুপোলির রঙিন ফসিল মোকাবিলা সহজ নয়। ইচ্ছেটাই আসল, মনের, হাতের জোরটাই বড় কথা। নতশির টেকনিকালার মিকেলাঞ্জেলো ধুয়ে গেলেন, ধীরে ধীরে বদলে গেলেন গেভাকালার নন্দলালে, এমনটাই দেখে আসছি ছোটবেলা থেকে।
দোল একটা জনগণমন ঘটনা, রং খেলাটা তো বটেই। কিন্তু রং তোলাটা ভীষণ ব্যক্তিগত, প্রায় একক ব্যাপার। সারা বছর প্রশ্নই উঠছে না, কিন্তু ওই বিশেষ দিনে হাফ চেনা, অর্ধ-অপরিচিত অথবা বুজুম বন্ধুর উদ্দাম হাত চালানোটা নিজের শরীরের ক্যানভাসে দেখতে, অনুভব করতে কেমন লাগে, সেটা তিনিই জানেন। কেউ কেউ হয়তো ভাবেন, অদৃশ্য লাইসেন্সধারী শিল্পীদের একেবারেই আনপ্ল্যানড শিল্পকর্ম রেখে দিলে কেমন হয়! তা হলে নিজেকে মিউজিয়ম বা গ্যালারি ভাবতে হয়। |
|
স্নানঘরের সাবানজলে শরীরের এমন বর্ণবিপর্যয় দেখতে দেখতে অবাক লাগে। শ্যাম্পুর উচ্ছ্বাসে মাথাভরা বিমূর্ত ভাল-লাগা, সঙ্গে চিনচিনে জ্বালাধরা আনন্দ একেবারে গুলিয়ে দেয় সব রকম ভাবনাচিন্তা, শয়ে শয়ে এক্সপ্রেস ট্রেনের মতো জলের ধারা নিজেদের ট্র্যাক খুঁজে নেয় শরীরের ল্যান্ডস্কেপ-এ, দুরন্ত গতিতে নামতে শুরু করে পায়ের জংশন-এ, সিগনাল মানার প্রশ্নই ওঠে না।
সমানে ছবি তৈরি হয়ে চলে স্নানঘরের মেঝেতে। ছবি ভেঙে যায়। দানাদার পিগমেন্ট ভেসে যায় নর্দমার দিকে। আজব এই আর্ট ফর্ম-এর গড়া-ভাঙা স্পষ্ট দেখা যায় না, কারণ আপ্রাণ চেষ্টা করতে হয় চোখটা বুজে থাকার। জমে থাকা শুকনো রঙের করকরে অস্বস্তিটা এক সময় ফিকে হয়ে আসে চোখের মধ্যে। চোখ খুললে আয়নায় নতুন করে পাওয়া, বন্ধ করলেই অন্ধকারে লাল-হলুদ-সবুজ আলো নেই।
এক মাঘে শীত যায় না। এক স্নানে রংও যায় না। যদি বা যেতে পারে, তবু কেন যাবে?
দোলের দোলায় নাচতে নাচতে কে, কাকে, কী রং মাখাল, সেটা খেয়াল থাকে না। সিদ্ধির শরবত বা লুকোনো ভডকা খাওয়া হোক, না হোক। ভাবনার ধারাগুলো আসে ফিরে ফিরে। অনেক প্রশ্ন উঠে আসে ভিজে মেঝে থেকে জমা হয় রঙে মোড়া মগজের জংশন-এ। বিব্রত হতে হয় বেখাপ্পা খেয়ালের দংশনে, ভয় জমা হয় মনে।
ভয় দানা বাঁধে অন্য কারণে। আয়নায় বার বার দেখি আর ভাবি ধুতে ধুতে, মুছতে মুছতে যদি আসল রংটা বেরিয়ে পড়ে! কোনও দিন মুখ খুলিনি, কোথাও টাইপ করিনি, প্রমাণ রাখিনি চিরকুটে বা ই মেল-এ। নিজেও জানতে চাইনি, আসলে আমি কে? যদি দেখি আমি অন্য কেউ!
দোল ফুরোনো রাতের শহরে এখানে-ওখানে নিভতে চাওয়া লাল, কালো আগুন, সোনালি রং মুছে হাইরাইজ-এর মাথায় এখন ফ্যাকাশে নীল চাঁদ, রাস্তার থোকা থোকা নতুন আলোয় অতিসবুজ পার্কের গাছ, টেবল ল্যাম্প-এর হলুদ আলোর ছায়ায় খোলা ল্যাপটপ। সেখানে এক বিন্দু আলো জানিয়ে দিচ্ছে যে আমি সংযুক্ত মহাকাশে। আর এটাও বুঝতে পারছি হাজার হাজার চেনা-অচেনা রং করা, রং ওঠা, রং তোলা, রংহীন মানুষও তাকিয়ে আছে আমার দিকে।
যদি ভেসে আসে কিছু কথা, সাদা-কালো শব্দ, ‘কী রে, রং গেলো? এখন কী সবুজ না লাল?’
দেখতে ইচ্ছে করে না, ভাবতে ভাল লাগে না, অস্বস্তি হয়। |
|
|
|
|
|
|