|
|
|
|
|
|
|
পুস্তক পরিচয় ১... |
|
নাগরিক মননেও আলোড়ন তোলে |
তপস্যা ঘোষ |
বন পরব, সাত্যকি হালদার। মিত্র ও ঘোষ, ১৫০.০০
বিয়োর, শুভঙ্কর গুহ। করুণা, ২০০.০০ |
পাখমারা ও মাগান্তা ক্ষীয়মাণ হতে হতে দু’টি পেশাই আজ অবলোপের পথে। হারাতে হারাতে পেশা দু’টি আখ্যানবন্দি হয়েছে দু’জন কথাকারের সৌজন্যে। এক জন সাত্যকি হালদার, অন্য জন শুভঙ্কর গুহ। বন পরব এবং বিয়োর উপন্যাস দু’টি ওই বিষয়ের বিশেষত্বে নজরকাড়া হয়ে উঠতে পেরেছে। এই পেশা দু’টি হারিয়ে যাচ্ছে কালেরই নিয়মে; সমাজে প্রান্তিক হতে হতে প্রায় অস্তিত্বহীন হয়ে গিয়েছে। ক্রমশ সমাজ যত নাগরিক হয়েছে, দূরত্ব কমেছে নাগরিকতা-গ্রামীণতার। সুগমতর হয়েছে যোগাযোগ, তত অনেক পেশা তার প্রাসঙ্গিকতা হারিয়ে প্রান্তিক হয়ে পড়েছে। এমনটাই স্বাভাবিক। পেশাজীবী মানুষগুলি বেঁচে থাকার তাড়নায় পেশান্তরে যেতে বাধ্য হয়েছে কখনও বা, কখনও গিয়েছে স্বেচ্ছায়। সেই দুর্নিবার যাওয়ার মধ্যে যন্ত্রণা আছে, টানাপড়েন আছে। কিন্তু পেশা-র ক্রম-অবলুপ্তিই হয়ে দাঁড়িয়েছে অনিবার্য পরিণতি।
সাত্যকি এবং শুভঙ্কর দু’জনেই বিশ্বাস করেন সহজ-সরল আখ্যান নির্মাণে। বিন্যাস সহজ, চলনবলনও সাদামাটা, কিন্তু জীবনযাপনের খুঁটিনাটি বর্ণনায় দু’জনেই আন্তরিক। অনুভব আর অভিজ্ঞতার মেলবন্ধনে সিদ্ধহস্ত দু’জনেই। এঁরা পেশাগুলিকে দেখেছেন নিবিড় করে, ভালবেসেছেন এবং লিখেছেন। বা বলা ভাল, ওই পেশাজীবী মানুষগুলোর জীবনযাপনের গল্প বলার তাগিদ বোধ করেছেন। আঙ্গিকের কলাকৌশলে বিভ্রান্ত করতে চান না এঁরা। ওই মানুষগুলোর জীবনের মতোই যেন তাঁদের আখ্যানও এক ভাবে বয়ে-চলা; কখনও চকিত উচ্ছ্বাস, কখনও বা নিরুত্তাপ। ওই নিস্তরঙ্গ জীবনও যেমন মাঝে মাঝে হয়ে ওঠে উথালপাথাল আখ্যানের মাঝেও তেমনই কখনও কখনও আছে নাটকীয়তা গড়নে এর বেশি চমৎকারিত্ব নেই। দীর্ঘ অভিজ্ঞতাই প্রাণিত করেছে তাঁদের। দু’জনেই এই পেশা দু’টিকে দেখেছেন ওই পেশাজীবী মানুষের এক জন হয়ে। ভেতর-বাইরের ব্যবধান তাই ঘুচে গিয়েছে এই আখ্যান দু’টিতে। শুধু জ্ঞান নয়, আছে প্রেম। বন পরব ও বিয়োর শিক্ষিত নাগরিক মননেও আলোড়ন তোলে, তার অনুরণন পৌঁছয় সংবেদনশীল পাঠকচেতনায়।
বন পরব-এর শুরুতে জানিয়েছেন সাত্যকি, ‘প্রাত্যহিক নাগরিকতার বাইরে যে জীবন, সে জীবন নিজের নিয়মে বয়ে যায়, সে কারও অপেক্ষা করে না। লালমাটির দেশে সেই জীবন তুসু গান গায়, জঙ্গলে পাখি ধরতে যায়, আবার কখনও দেশ ছেড়ে, চেনা সীমানা ছেড়ে ভিন্ দেশে কাজের খোঁজে চলে যায়। জঙ্গলের মাঝে আর ওপার বাংলার মানুষের ভিন্নতর কলোনিও গড়ে ওঠে। বন পরব প্রকৃতপক্ষে আমার বছর চারেক বাঁকুড়া-বাসের দায়বদ্ধতা।’
দীর্ঘ তিন বছর ধরে তাঁর বিয়োর-এর আখ্যান নির্মাণ করেছেন শুভঙ্কর। মাঝে মাঝেই তিনি ঘুরে বেড়িয়েছেন সাপুড়িয়া-পাড়ায়। তাঁর কথায়, ‘সাপুড়িয়াদের সঙ্গে মেলামেশা, সাপখেলা দেখা, শিকার দেখা, ভোজন, আড্ডা, রাত্রিবাস, মাইলের পর মাইল পায়ে হেঁটে বিচরণের মাধ্যমে যতটুকু জেনেছিলাম এক গভীর বাউল মনের অনন্ত যাত্রা। ওদের জীবনদর্শন, ভাষা ও সংস্কৃতির প্রতি আকর্ষণ অনুভব করি।’ এই আকর্ষণেই তৈরি হয় বিয়োর। মুর্শিদাবাদ জেলার নবগ্রামের বেদেপাড়া লেখককে অভিভূত করে। তিনি ভূমিকায় লেখেন, ‘সাপ নয়, সাপুড়িয়াদের জীবনদর্শনই’ তাঁকে মুগ্ধ করেছে। সাপুড়িয়াদের এই অনন্ত যাত্রাই বিয়োর রচনার উদ্দীপক।
দায়বদ্ধতা অথবা আকর্ষণ, এই দু’টি বোধই এখানে মূলত এক। এই বোধেই তাঁরা তাঁদের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা অনুভবজারিত করে নির্মাণ করেন তাঁদের উপন্যাস। চিত্রনাট্যের মতো সাজানো সাত্যকির উপন্যাস যেন পরতে পরতে আঁকা হয়ে যায় কতকগুলো ছবি। বাঁকুড়া জেলার জয়পুর গ্রামের আখ্যান, জয়পুর থেকে শুরু হয়ে যায় জঙ্গলের সীমানা। জঙ্গল শেষ হলে বিষ্ণুপুর। বাঁকুড়া জেলা এবং তারই সংলগ্ন পুরুলিয়া মেদিনীপুর এই বিশেষ অঞ্চলের পটভূমিতে তৈরি হয়েছে আখ্যান। এই অঞ্চলের পাখমারাদের ভরপুর জীবন আর ক্রমশ বিলীন হয়ে যাওয়ার গল্পের মধ্য দিয়ে সাত্যকি পৌঁছে যান তাঁর জীবনদর্শনে। সময়ের রূপবদলের সঙ্গে সঙ্গে পাখমারাদের এক জন হয়ে গেল মোটর মেকানিক। শেষ পর্যন্ত এঁদের জীবনে কী ঘটল তার জন্য আমাদের অপেক্ষা করতে হবে। তিনি মনে করেন, ‘পাখমারাদের যে কথা বলা হল, সেই পাখমারারা মহাভারত যুগের কিরাত বনবাসী পক্ষীশিকারি সম্প্রদায় এখানে মোটর মেকানিক হল।’ পাখমারারা নলের গোছা নিয়ে ঘুরত জঙ্গলের আনাচে-কানাচে। জঙ্গলের ভেতরে দশ-বারো ঘর পাখমারার বাস। ছড়ানো-ছিটানো। ঘরগুলো সাদামাটা, এলোমেলো। ভোটার লিস্টে এদের নামের পাশে লেখা হয় ‘নোলে’। নোলেটাই হয়ে গিয়েছে তাদের পদবি। জয়পুর অঞ্চলের লোকের মুখে এরা পাখমারা। গোল আর সরু করে কাটা বাঁশের নল পরপর লাগিয়ে পাখি ধরত এরা। উপরের নলের মাথায় ছোট কাঠিতে বটের আঠা লাগিয়ে দিত। পাতার আড়ালে বসে থাকা পাখির ডানায় সেই আঠা মাখিয়ে দিলেই ডানা ঝাপটে নীচে পড়ে পাখি। এরা অভ্যস্ত ছিল ঘুরে-বেড়ানোয়। প্রবীণ পাখমারা ভূষণ তার নাতিকে গল্প বলে পাখি ধরার। ছেলেটির বাবা-কাকা এ পেশাকে প্রত্যাখ্যান করেছে, তারা গিয়েছে গ্রামান্তরে। বরং ‘লেবারি’-তেই মজল এদের মন। নোলেরা চাষ-বাসের কাজেও তেমন ঠাঁই পায় না। কেউ কাজের খোঁজে নিখোঁজ, কেউ মুটে, কেউ বা চায়ের দোকান খুলেছে। এই নোলেদের গল্পের মাঝে আকর্ষণীয় বর্ণনা আছে হাতি তাড়ানোর বৃত্তান্তে। পাকা ধানের জন্য মত্ত হাতির দল যখন তাণ্ডব শুরু করে, তখন সকলে মিলে হাতি তাড়ানোয় শামিল হয়। মশালের আলো আর চিৎকারে হাতিরা বিভ্রান্ত হত অতীতে, এখন আর গায়ে মাখে না ও-সব। এমনকি গায়ে আগুন ছুড়ে দিলেও পাশে সরে গিয়ে ধান খায়। এই তাড়ানোর জন্য আছে হুলা পার্টি। রাত প্রতি এরা পায় চল্লিশ টাকা। মানুষের স্থানান্তরের পাশাপাশি হাতির স্থানান্তরের গল্প শোনান সাত্যকি। অনেক দূরের দলমা পাহাড়ের হাতিরা পাকা ধানের গন্ধে হাজির হয় এই জঙ্গলে। আগে বনে থাকত বরা, খরগোশ, সজারু আর ভালুক। হাতি আসার পরে অন্য সব প্রাণী উধাও। রাঢ় বাংলায় লৌকিক দেবদেবীর মধ্যে ঢুকে পড়ে হাতি। ধর্মরাজের থানে ঘোড়ার জায়গায় হাতি পড়তে থাকে। মানুষের অভ্যেস বদলে যায়। হাতির মূর্তিকে এরা সম্মান জানায়। এমনকি একজন বিড়াইয়ের জলে স্নান করতে গিয়ে হাতির মাথার মতো দেখতে একটি পাথর খুঁজে পায়। এতদঞ্চলের ডোমেরা কোথাও যায় না সন্ধেবেলায় চিরকাল একই রকম বাজে তাদের ঢোল-কাঁসর-বাঁশি তৈরি হয় ‘বন পরবের আবহ’। অবিরত নানা সময়ের মধ্যে দিয়ে এই গ্রাম পাল্টাতে থাকে।
বিয়োর-এর গ্রামেও চলতে থাকে এই রূপান্তর। ছবির মতো সাজানো উপন্যাসের শেষ দৃশ্যটি। ‘একটি বেদের দল ক্রমশ, পরের-পর হাঁটুজল ভেঙে নিজেদের পোশাকগুলি পতাকার মতন ওড়াতে ওড়াতে এগিয়ে যাচ্ছে নবগ্রামের দিকেই। প্রায় শতাব্দীপ্রাচীন এক সর্দার সামনের দিকে ঝুঁকে, লাঠিতে ভর দিয়ে দলটির একেবারে সামনে, এগিয়ে যাচ্ছে।
কেদার সামনে এগিয়ে এসে বলে, ‘কী গো মাগান্তা সর্দার, দল নিয়ে কোন দিকে? কে গো তুমি?
পটুয়া দশরথ মাগান্তা।
পাড়া নেই?
না বিচরণ করি।’
এই বিচরণের বৃত্তান্তেই এ উপন্যাসের বিশিষ্টতা। এই বৃত্তান্ত এক চলমানতার। চলতে চলতে এই বেদেপাড়ার মানুষগুলোর সঙ্গে পরিচয় হয় আধুনিকতার। হয়তো মেলাতে পারে না তারা, তবু মেনে নেয়। বিলবোশিয়ার পাড়ে একটি মরা কচ্ছপকে ঘিরে যখন ওই সাপুড়েদের বিশ্বাস আর মমতা পাক খাচ্ছিল, তখন বনরক্ষীরা এসে ওই দুর্লভ প্রজাতির কচ্ছপটি নিয়ে যায় সংরক্ষণের জন্য। বিস্মিত, হতাশ কেদার সাপুড়িয়া বলে, ‘এত দিন একা-একা বিচরণ করত, মরে গিয়ে ও ভদ্দরলোকেদের হয়ে গেল।’ এই অসহায়তা দেখে মন খারাপ হয়ে যায়। মাগান্তা দলের এই পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণে আচ্ছন্ন হয়ে যেতে হয়। সাপের সঙ্গে একাত্ম হতে হতে এদের চেতনায় সাপ পয়গম্বর। এই মাগান্তারা বিচরণ করতে করতে সাপ খোঁজে, সাপের বাঁচা-মরার সন্ধান নেয়। বিলবোশিয়ার পাড়ে গর্তে সাপ আছে কি না, তা বোঝে গর্তের সামনে দাগ দেখে। মাগান্তা দলের রীতিনীতির আখ্যান শুনতে শুনতে এক ভিন্ন জগতে ঢুকে যাই আমরা। কেউ মাগান্তা দল ত্যাগ করলে তাকে বলা হয় ‘দলত্যাগী’, তাকে আর দলভুক্ত করা হয় না। কিন্তু সেই রীতি মেনে নিতে চায় না সবাই। তাদের মধ্যে তৈরি হয় টানাপড়েন। আরও একটি অদ্ভুত তথ্য দেন লেখক; বেদের দলের বিচরণের পথ ধরেই চলত শকুন। কিন্তু এখন নানাবিধ দূষণের ফলে শকুনের দল মরতে বসেছে; বেদেরাও ক্রমশ তাদের চরিত্র পাল্টেছে, হয়ে গিয়েছে সাধারণ গ্রামবাসী। ধীরে ধীরে বেদেপাড়ায় ভাঙন ধরতে শুরু করেছে; যদিও হাঁড়িরাম ঠাকুরের থানে তারা সবাই একাত্ম। দলের সর্দার শতাব্দীপ্রাচীন কিরীটী সাপুড়িয়ার ইচ্ছা ছিল তাকে যেন না পুড়িয়ে বেদেপাড়াতেই কবর দেওয়া হয়। সেই কবরে থাকবে একটি সাপও। এমনই জীবনযাপন, এমনই জীবনদর্শন এদের। বেদেদের এই অন্তহীন যাত্রার এই উপাখ্যান আমাদের সমৃদ্ধ করে। |
|
|
|
|
|