পঞ্জিকায় বিধান এক দিনের, মুর্শিদাবাদে কিন্তু দোল দু’দিনেরই। শতবর্ষ আগের সেই ট্রাডিশন সমানে চলে আসছে আজও।
অন্য বছরের মতো এ বারও তাই শুক্রবারও জেলা জুড়ে দোকানপাট-হাটবাজার বন্ধ। বন্ধ স্কুল-কলেজ-আদালত। রিকশাও চলাচল করছে না। যাত্রীবাহী বেসরকারি বাসের নামগন্ধ নেই। জেলা সদর বহরমপুর থেকে মফস্সলের লালগোলা পর্যন্ত সর্বত্র এ দিন যেন স্বতঃস্ফূর্ত সর্বদলীয় বন্ধের হাওয়া। রাস্তাঘাট সুনসান। কখনও কখনও রাজপথের দখল নিচ্ছে আপাদমস্তক রঙে চোবানো যুবকেরা।
ব্যতিক্রম কেবল মুর্শিদাবাদ জেলার কেন্দ্রীয় প্রশাসনিক ও জেলাপরিষদ ভবন দু’টি। দু’টি ভবনেরই দরজা এ দিন খোলা ছিল। কিন্তু কার্যালয়ে কর্মীদের টিকির দেখা মেলেনি। বহরমপুর মহকুমাশাসক অধীরকুমার বিশ্বাস বলেন, “এ দিন কর্মীদের হাজিরা টেনেটুনে শতকরা ৫ ভাগ। বাকিরা ছুটি নিয়েছেন।” জেলাপরিষদের চিত্রটি কিঞ্চিৎ ভিন্ন। মুর্শিদাবাদ জেলাপরিষদের শাসক বামফন্টের পরিষদীয় নেতা প্রণব বিশ্বাস বলেন, “দোলের প্রথম দিন ছিল কেন্দ্রীয় সরকারের ছুটি। দোলের দ্বিতীয় দিন শুক্রবার স্থানীয় নিয়ন্ত্রিত ছুটি হিসাবে প্রথমে ঘোষণা করা হয়। কিন্তু পরে জেলাশাসকের কথা মতো স্থানীয় নিয়ন্ত্রিত ছুটি বাতিল করা হয়। ফলে দরজা খুলতে হয়।” তাতে অবশ্য জেলাপরিষদের অভ্যন্তরের ছবিটা বদলায়নি। হাজিরার হার শতকরা হিসাবে মিলবে না।
এ বছর দোলের জন্য সরকারি ছুটি তো কেবল বৃহস্পতিবার। তবুও কেন এমন দশা?
সাধারণ মানুষের বক্তব্য, উৎসবের ক্ষেত্রে প্রথাই গুরুত্বপূর্ণ, সরকারি ঘোষণা নয়। কলেজ শিক্ষকদের সংগঠন ওয়েবকুটার মুর্শিদাবাদ জেলা সম্পাদক পার্থ দাস, বহরমপুর উকিলসভার সভাপতি আবু বক্কর সিদ্দিকি ও হাসানপুর রাজেশ্বরী উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধানশিক্ষক গৌরাঙ্গ ভাদুড়িতিন জনই মনে করেন, মুর্শিদাবাদে দোল উৎসবের উন্মাদনা প্রথম দিনের থেকে অনেক বেশি দ্বিতীয় দিন। তাই বরাবরের মতো এ বারও শুক্রবার জেলার স্কুল-কলেজ-আদালতে স্থানীয় নিয়ন্ত্রিত ছুটি ছিল। বেসরকারি বাস মালিক ও শ্রমিকদের সংগঠনের জেলা সম্পাদক যথাক্রমে তপন অধিকারী ও জয়দেব মণ্ডল দু’জনেই বলেন, “বরাবর দোলের দু’দিন শতকরা ৮ থেকে ১০ ভাগ বাস চালানো সম্ভব হয়। সেই আদ্যিকাল থেকেই তার বেশি বাস বের করা অসম্ভব।”
দু’দিনের দোলের সেই কাহিনির জন্ম শতবর্ষের আগে। তারও আগে নবাবি আমলে বহরমপুরের উত্তর ও উত্তর-পূর্বপ্রান্তে ফরাসডাঙা, কাশিমবাজার, সৈয়দাবাদ, কুঞ্জুঘাটা, ঘাটবন্দর ও খাগড়া--বনেদি ও বর্ধিষ্ণু এলাকা হিসাবে খ্যাত ছিল। মহারাজা নন্দকুমার ওই এলাকায় তাঁর জামাই-এর বাড়িতে অনেক দিন বসবাস করেন। মহরাজা মণীন্দ্রচন্দ্র নন্দীর রাজবাড়ি, ফরাসি ও আর্মেনিয়ান বণিকদের কুঠিও ওই এলাকায়। পরে ব্রিটিশ আমলে বহরমপুরের দক্ষিণ প্রান্তে গড়ে ওঠে গোরাবাজার, বহরমপুর, রাধারঘাট ও নতুনবাজার এলাকা। ওই এলাকার আদি বাসিন্দা ছিলেন জমিদার পুলিনবিহারী সেন ও তাঁর জ্ঞাতিরা। শতাধিক বছর আগে রাজবাড়ির সঙ্গে সেনবাড়ির বিস্তর বিবাদের পরে বহরমপুর শহরে দু’দিন ধরে দোল উৎসব পালন শুরু হয়। দোল নিয়ে রাজা-জমিদারের ওই বিবাদ সহজে মেটেনি। বহরমপুর শহরের বিশিষ্ট নাগরিক প্রয়াত রাধারঞ্জন গুপ্তও জানিয়েছিলেন, দু’পক্ষর দু’দিনের দোলের বিবাদ মেটাতে পুরসভায় বেশ কয়েক বার আপোস মীমাংসার বৈঠকও হয়। এমনকী ওই বিরোধ আদালত পর্যন্ত গড়ায়। এক বার তো দ্বিতীয় দোলের দিন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষার দিন পড়েছিল। দোলের জন্য ওই দিনের পরীক্ষার কর্মসূচি পর্যন্ত বাতিল করতে হয়। এ ভাবেই এ জেলায় দু’দিনের দোল উৎসব প্রতিষ্ঠা পায়। জেলার প্রশাসনিক ভবন থেকে শুরু করে সর্বত্র ছুটি দেওয়া হত ‘স্থানীয় নিয়ন্ত্রিত ছুটি’ থেকে। সরকারি ছুটির ওই ট্রাডিশনে প্রথম ছেদ পড়ে ২০০৩ সালে। কর্ম দিবস বাড়নোর জন্য দোলের দ্বিতীয় দিন ‘স্থানীয় নিয়ন্ত্রিত ছুটি’ থেকে ছুটি দেওয়ার প্রথা বাতিল করে দেয় রাজ্য সরকার। তাতে অবশ্য খাতা কলমেই কেবল ছুটি বাতিল করা হয়। মুর্শিদাবাদ জেলাপরিষদ ও জেলা প্রশাসনিক ভবনে বিগত বছরগুলির মতো এ বছরের দোলের দ্বিতীয় দিনে শুক্রবারের কর্মী হাজিরার পরিসংখ্যানই তার প্রমাণ। |