প্রতি পক্ষ
চিত্রপথিক
তিনি আগেও এ শহরে এসেছেন। এ বার নিয়ে দ্বিতীয় বার। কিন্তু, এক অর্থে এটাই হয়তো প্রথম।
আগের বার শহরটা ততটা ঘুরে দেখতে পারিনি, ঠাসা কাজ ছিল, এ যাত্রায় খানিক ঘুরে দেখা গেল, হেসে বললেন ট্রেসি লি স্টাম, স্ট্রিট পেন্টিং-এ যাঁর দুনিয়াজোড়া নামডাক।
কী দেখলেন?
অনেক কিছু। শহরের একদম প্রাণকেন্দ্র থেকে শুরু করে শহর ছাড়িয়ে একটু প্রান্তের দিকে কিছু জায়গা...
মানে, ডাউনটাউন থেকে শুরু করে শহরতলি... সব?
ওই আর কি, ঘুরতে ঘুরতে যতটুকু দেখা যায়! তবে, আমি সারাক্ষণ ক্যামেরা নিয়ে ঘুরি তো, প্রচুর ছবি তুলেছি।
কোন জিনিসটা দেখে সবচেয়ে ভাল লাগল?
প্রাণশক্তি।
ক্ষমা করবেন, এটা একটু রুটিন উত্তরের মতো শোনাচ্ছে... কলকাতায় বিদেশ থেকে যাঁরাই আসেন, তাঁরাই এই একই কথা বলেন। স্ফূর্তি, প্রাণশক্তি, আবেগ ইত্যাদি ইত্যাদি...
উঁহু, ঠিক তা নয়, বোধহয়।
এতক্ষণ হাসছিলেন ট্রেসি লি স্টাম। দুপুরের খাওয়া পিছনে ঠেলে সাক্ষাৎকার দিতে বসেছেন তিনি, কিন্তু তাতে তাঁর মুখের হাসিতে টোল পড়েনি একটুও। এই প্রথম পড়ল।
কারণ, তাঁর মুখচ্ছবিটি ঈষৎ চিন্তাশীল হয়ে উঠল। ঠিক যে রকম মন দিয়ে রাস্তাঘাটে বিচিত্র আঁকাজোকা করেন তিনি, খটখটে পিচরাস্তায় ছবি এঁকে আস্ত জলাশয় আর তা থেকে লাফিয়ে ওঠা ডলফিন তৈরি করেন, সে রকমই মন দিয়ে যেন খুঁজছেন কোনও উত্তর। সেটা পেয়েও গেলেন একটু পরে, বললেন, ঠিক তা নয়, জানেন। অন্যে কে কী বলেছে জানি না, কিন্তু আমি যেটা দেখে অবাক হয়েছি, তা হল এই শহরের লোকজনদের ‘লাইফস্টাইল’... কী আশ্চর্য জীবনযাত্রা এঁদের! পশ্চিমি দেশে দাঁড়িয়ে এই শহরের গতি, এত কিছু না-পাওয়া এবং তা সত্ত্বেও এ রকম প্রাণবন্ত জীবনের কথা ভাবতেও কষ্ট হয়, অথচ এই শহরটা তো এরই মধ্যে বেঁচে আছে।
যদি একটা শব্দে ধরতে বলা হয় এই শহরটাকে, একটিমাত্র রেখার টানে আঁকা ছবির মতো, কোন শব্দটা ব্যবহার করবেন?
এনার্জি।
ট্রেসি, আপনি তো রাস্তাঘাটে, পার্কে, বুলেভার্ড-এ থ্রি ডি, মানে ত্রিমাত্রিক ছবি আঁকেন। থ্রি ডি সিনেমাও দেখেন নিশ্চয়ই? যেমন, ধরুন ‘অবতার’!
দেখি।
কী মনে হয়, একটা সময় থ্রি ডি সিনেমাই থাকবে, সনাতন ধাঁচের দ্বিমাত্রিক, মানে টু-ডি ছবি আর চলবে না?
এতটা কি আগে থেকে ভেবে নেওয়া ভাল? ট্রেসি লি হাসলেন, থ্রি ডি ছবি প্রযুক্তির একটা চেহারা, কিন্তু সেটা আসার পরে টু ডি থাকবেই না, এতটা আমি ভাবতে চাই না...আর, থ্রি ডি-র পাশাপাশি আমি কিন্তু অন্য নানা রকম ছবিও আঁকি।
জানি, আপনি গির্জায় ম্যুরাল এঁকেছেন... আসলে, আপনার সঙ্গে এই থ্রি ডি ছবির ব্যাপারটা এতটাই জুড়ে গিয়েছে, মানে আপনার স্বাক্ষরের মতই হয়ে গিয়েছে যে, আপনার সঙ্গে কথা বলতে গেলে থ্রি ডি-র ব্যাপারটাই মাথায় আসে।
ট্রেসি হাসলেন।
আচ্ছা, আপনি তো এখানে বেশ কয়েকটা ওয়র্কশপ করিয়েছেন। বাইরেও নিশ্চয়ই করিয়েছেন বিস্তর। নতুন অনেকেই আসেন নিশ্চয়ই এই ধরনের ছবি আঁকতে?
প্রচুর, প্রচুর ছেলেমেয়ে আসে, আসছেও রোজই, প্রত্যেকেই খুব উৎসাহী!
যাঁরা আসছেন এই থ্রি ডি ছবি আঁকতে, তাঁদের আপনি একেবারে প্রথমে কী বলেন?
মানে?
মানে, এই ছবি আঁকতে গেলে তো অন্য রকম একটা দৃষ্টিভঙ্গি দরকার হয়...একদম আক্ষরিকই দৃষ্টিভঙ্গি, সবাই যা দেখছে, তার চেয়ে আলাদা, সেই জিনিসটা কী করে শেখান?
এই চোখটা এক দিনে আসে না, এটাকে গড়ে তুলতে হয়, জানেন, একটা জিনিস সকলেই দেখছে, যে থ্রি ডি আঁকে সে দেখছে, যে আঁকে না, সে-ও... থ্রি ডি যে আঁকে না, তারও মাথার মধ্যে কিন্তু থ্রি ডি-র ধারণাটা আছে, না হলে থ্রি ডি-টা দেখে সে থ্রি ডি বলে ধরতেই পারত না...ওই যে একটা জমিন থেকে উঠে আসছে কিছু, এটা তো আর তাকে বলে দিতে হচ্ছে না, সে দেখামাত্র বুঝতে পারছে, কিন্তু সে আঁকতে পারছে না, কারণ তার সেই প্রশিক্ষণটা নেই।
কোন প্রশিক্ষণ?
ওই যে, কী ভাবে আঁকলে জিনিসটাকে ওই রকম দেখতে লাগবে। কারণ, আপনি যেখানে আঁকছেন, সেটা কিন্তু থ্রি ডি নয়, রাস্তা হোক, বুলেভার্ড হোক, ফুটপাথ হোক, সবখানেই আঁকার জমিটা কাগজের মতো, তার একটা দৈর্ঘ্য আছে, আর একটা প্রস্থ আছে, ব্যস...সেখানে আপনাকে ওই থ্রি ডির মজাটা তৈরি করতে হবে?
কী করে?
হ্যাঁ, সেটাই পরীক্ষা। কী করে, তার তো কিছু কলাকৌশল আছে, ছবিটা আঁকার কিছু নিয়মকানুন আছে, কিন্তু সবচেয়ে আগে যা দরকার, তা হল ওই আপনি যাকে বললেন, দৃষ্টিভঙ্গি। পয়েন্ট অব ভিউ।
সেটা কী করে শিখতে হয়?
ওই যে বললাম, ওই চোখটাকে আস্তে আস্তে আয়ত্ত করতে হয়। ধরুন, আপনি দেখছেন একটা ফুটপাথের জমি, সেখানেই ছবিটা আঁকতে হবে। আছে বলতে স্রেফ দৈর্ঘ্য আর প্রস্থ, কোনও বেধ বা গভীরতা নেই, কিন্তু সেটা তো সবাই দেখবে। ত্রিমাত্রিক ছবি আঁকবেন যিনি, তিনি সেখানে স্পষ্ট দেখবেন একটা গভীরতা...ওই তো জমিটা ঢুকে গিয়েছে ভিতর দিকে, সেখানে গর্ত আছে, কিংবা একটা সাঁতারের পুল আছে, সেখান থেকে উঠে আসছে কেউ...এই দেখার চোখটা আপনাকে আয়ত্ত করতে হবে। এটাও একটা অভ্যেস, আর অ্যাপটিটিউড নামে একটা জিনিস তো থেকেই যায়, তাই না?
এরপর আর ট্রেসি লি স্টাম-কে কীই বা বলা যায়, একটি কথা ছাড়া?
ত্রি-নয়ন, ও ত্রি-নয়ন...




অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.