|
|
|
|
|
|
|
ব্যাগ গুছিয়ে... |
বুকের মধ্যে জল-ছবি
এক দিকে ধু ধু ধানক্ষেত। তার পাশ দিয়ে সারি সারি কটেজ। বারান্দা প্রায়
ঝুঁকে পড়েছে কেরলের বিখ্যাত ‘ব্যাকওয়াটার’-এ। লিখছেন সোমঋতা ভট্টাচার্য |
|
নৌকাবাড়িতে বসে ভরদুপুরে পেটপুজো! কলকাতায় ভিড়ে ঠাসা বাসে বা মেট্রোয় বসে ভাবতে অবাক লাগে, তাই না? ঝকঝকে রোদ উঠেছে। ভেম্বানাড হ্রদ ছাড়িয়ে এসেছি। হাউসবোটের সারেং নৌকা ভিড়িয়েছেন এক টুকরো ডাঙায়। আর ‘ব্যাকওয়াটার’-এর ছলাৎ ছলাৎ শুনতে শুনতে কব্জি ডুবিয়ে ভূরিভোজ!
আগের দিনই চলে এসেছি আলেপ্পি বা আলাপ্পুজায়। রাতটা কেটেছে আর এক মজার জায়গায়। তাকে এক দ্বীপই বলা চলে। গাড়ি থেকে নেমে স্পিড বোটে চড়ে পৌঁছেছি সেখানে। এক দিকে ধু ধু ধানক্ষেত। তার এক পাশ দিয়ে সারি সারি কটেজ। তার বারান্দা প্রায় ঝুঁকে পড়েছে কেরলের বিখ্যাত ‘ব্যাকওয়াটার’-এ। সেখানে চুপচাপ বসে থেকেই সময় কেটে যায় হু হু। কখনও ভিনদেশীদের নিয়ে হাউসবোটের প্রমোদবিহার। কখনও রোজকার অফিস-কাছারি বা স্কুল-কলেজ সেরে স্থানীয়েরা চলেছে নৌকা বেয়ে, আমরা যেমন অটোয়-বাসে বা সাইকেলে যাতায়াত করি আর কী! আবার কখনও বা জেলে-ডিঙি হাঁস তাড়িয়ে বাড়ি ফিরছে।
|
|
ছলছল কলকল বয়ে চলে জল। সূর্য ডুবুডুবু হলে তার পিতলরঙা আলো ছড়িয়ে পড়ে জলে। সেই রঙেই বহুক্ষণ মাখামাখি হয়ে থাকে আকাশটা। আঁধার ঘনিয়ে আসে। পাখিদের বাসায় ফেরার সময় হয়। ভ্রমণ-পিয়াসীদেরও ফিরতে হয় ডেরায়। রাত হয়ে আসে। রাতজাগা পাখিদের কুবকুব ডাক শুনতে শুনতে এগিয়ে আসে ঘুমিয়ে পড়ার সময়।
আর তার পর দিনই তো সক্কাল থেকে নৌকাবাস। গোটা একটা দিন জলে-জলে! আরব সাগরের সমান্তরালে উপকূল এলাকায় অগুনতি লেক আর লেগুন তৈরি করেছে সেই ‘ব্যাকওয়াটার’। সেই জলাশয় এক অর্থে বদ্ধ। তাই কোথাও কোথাও জন্ম নিয়েছে কচুরিপানারা। শাপলা আর পদ্মও চোখে পড়েছে। আর আছে নারকেল গাছ। সারি সারি নারকেল গাছ। কোনওটা লম্বা, কোনওটা উচ্চতায় খাটো। লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে সবুজ ছায়া ফেলছে জলে। সেই জলেই ধীরে ধীরে ভেসে চলেছে আমাদের দোতলা হাউসবোট। ঠিক যেন সত্যিকারের বাড়ি। বসার ঘর, খাওয়াদাওয়ার জায়গা, শোয়ার ঘর কী নেই তাতে! তফাত বলতে সেখানে শুধু বসার ঘরে সোফায় বসে একটু ঝুঁকলেই ছোঁয়া যায় ভেম্বানাডের ঢেউ।
হাউসবোটের রাঁধুনি হ্যারির জবাব নেই! কিছুক্ষণ আগেই একটা বাজারের মতো জায়গায় হাউসবোট ভিড়িয়েছিলেন সারেং। সেখান থেকে সস্তায় কেনা বিরাট বিরাট বাগদা চিংড়ি নিমেষে মশলা মাখিয়ে তোফা রান্না করে দিল হ্যারি। দুপুরের খাওয়াটাও তাই জমে গেল দিব্যি।
বেলা ফুরোয়। তার পরে আবার ‘দিনের আলো নিবে এল, সুয্যি ডোবে ডোবে।’ আর আমাদের হাউসবোট নোঙর গাড়ে এক অচিন ডাঙায় এসে। সেখানে আবার ৭০০ বছরের পুরনো বালদুর্গার মন্দিরও রয়েছে। অন্ধকার আরও নিকষ হয়। একটা সময়ে শুধু আশপাশে নোঙর করা অন্যান্য হাউসবোট থেকে ঠিকরে আসা অল্প আলো ছাড়া আর কিচ্ছু নেই। মাঝেমধ্যে জলের মধ্যে কোনও অজানা সরীসৃপের সড়সড় অথবা মশার পিনপিন। আর হাওয়ার তোড়ে জলে ঢেউ উঠে নৌকার গায়ে এসে ধাক্কা লাগার শব্দ। এ ভাবেই শেষ হয় হাউসবোটের নিশিযাপন।
পর দিনই আবার যাত্রা শুরু। এ বার যাব স্বপ্নের কোভালামে। যেখানে ঢেউয়ের সাদা ফেনা এসে বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে অবিরাম। যেখানে সূর্যাস্তের রবি আলতো কমলা আলো ছড়িয়ে দেয় অপরাহ্নের আকাশে। আলাপ্পুজা থেকে মোটরপথেই যাব তিরুবনন্তপুরমে। আর সেখান থেকে তো কোভালাম বেশি দূর নয়।
সারাটা দিন তাই পথে পথে। সক্কাল সক্কাল বেরিয়ে পড়েছি। কোভালাম পৌঁছতে বিকেল গড়িয়ে গেল। আবছা আলোয় দেখলাম আদিগন্ত জলরাশিকে।
তার গর্জন শুনতে শুনতে সকাল হওয়ার অপেক্ষায় রইলাম।
কেরলের বৈচিত্র্য সত্যিই অদ্ভুত। কী নেই এখানে! পাহাড়, চা-বাগান, জঙ্গল তো আগেই দেখেছি। ব্যাক ওয়াটারও বাদ যায়নি। আর শেষে সমুদ্রে এসে পড়েছি। ভোরের আলো ফোটা মাত্র সেই নিঃসীমের রূপবদল দেখার শুরু। আগের দিনই দেখেছি, দিনমণি অস্তাচলে গেলেন আরবসাগরে নরম আলো ছড়িয়ে। আর সকাল থেকে তো সমুদ্রের অন্য রূপ। রাশি রাশি ঢেউ শুধু আসে আর ফিরে ফিরে যায়। যেন কার সঙ্গে কথা বলে চলে অবিরাম। তার বিশ্রাম নেই। মাঝেমধ্যে ডিঙি নৌকার আসা-যাওয়া। নুলিয়াদের ঘোরাফেরা। খালি পায়ে বালি মাড়িয়ে হাঁটতে হাঁটতে পায়ের তলায় পেয়ে যাওয়া ঝিনুকের টুকরো। আবার ঢেউ আসে। আর টেনে নিয়ে যায় পায়ের তলার বালি। ধুয়ে দিয়ে যায় পথ-চলার শ্রান্তি। শুধু পড়ে থাকা ফেনাগুলো রোদ্দুর লেগে চকচক করে।
পাক্কা দু’দিনের বিশ্রাম। আর কিচ্ছু না। সমুদ্রের গর্জন ছাড়া সঙ্গী শুধু নিঃসঙ্গতা। বালুকাবেলায় বসে ভাবছি, চোখের নিমেষে ফুরোলো ছুটির দিনগুলো। কোচি, মুন্নার, পেরিয়ার, আলেপ্পি, কোভালাম মন ভরালো আর উজাড় করে দিল আগামী ক’টা দিন মহানন্দে কাটানোর মতো রসদ।
|
কী ভাবে যাবেন |
কোচি বা তিরুঅনন্তপুরম থেকে গাড়িতে পৌঁছনো যায় আলাপ্পুজা। বাসেরও ব্যবস্থা রয়েছে।
তিরুঅনন্তপুরম বিমানবন্দর থেকে কোভালামের দূরত্ব খুবই কম, পৌঁছনো যায় গাড়ি বা অটোতে। |
কোথায় থাকবেন |
|
আলাপ্পুজা ও কোভালাম, দু’জায়গাতেই সরকারি ও বেসরকারি নানা দামের থাকার জায়গা রয়েছে।
আলাপ্পুজাতে বেশ কয়েকটি জেটি আছে। সেখান থেকে
হাউসবোটে থাকার বন্দোবস্ত করা যায়।
রাত কাটাতে না চাইলেও হাউসবোটে সারা দিন কাটানো যায়। |
|
|
|
|
|
|
|