কলেজ নির্বাচন পরিচালনা করিবার দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের উপর ন্যস্ত করিল কলিকাতা হাইকোর্ট। কলেজ ইউনিয়নের নির্বাচনকে কেন্দ্র করিয়া তুমুল অশান্তি রোধ করিতেই এই ব্যবস্থা। উদ্দেশ্য অবশ্যই যথাযথ। কিন্তু নিদানটি বিধেয়টি হইল কি না, মহামান্য আদালতের প্রতি সম্পূর্ণ শ্রদ্ধা রাখিয়াই সেই প্রশ্ন তোলা সম্ভবত অযৌক্তিক নয়। কলেজ নির্বাচন উপলক্ষ করিয়া রাজ্যের কলেজ-ক্যাম্পাসগুলি যে হিংস্র রণভূমি হইয়া উঠিয়াছে, ইহা সংকটের বহিঃপ্রকাশ মাত্র। সংকটের স্বরূপ হইল, ছাত্র ইউনিয়নের ভূমিকা এবং উদ্দেশ্য বিষয়ে ভ্রান্ত ধারণা। ছাত্রদের স্বার্থরক্ষায় ছাত্র প্রতিনিধিরা কলেজ পরিচালকদের সহিত মতের আদানপ্রদান করিবে, ইহা সঙ্গত। ছাত্ররা গণতান্ত্রিক উপায় নিজেদের প্রতিনিধি চয়ন করিবে, ইহাও প্রত্যাশিত। কিন্তু ছাত্র সংগঠনগুলি রাজনৈতিক দলের প্রশাখা হইতে পারে না। ছাত্ররা তাহাদের নিজস্বতা হারাইয়া বড় রাজনৈতিক দলগুলির ক্রীড়নক হইয়া উঠিয়াছে, তাই এ দেশে ছাত্র রাজনীতি এমন বিকৃত রূপ ধারণ করিয়াছে। কলেজ ক্যাম্পাসগুলি রাজনৈতিক দলগুলির রঙ্গমঞ্চে পরিণত হইয়াছে, ছাত্র ইউনিয়নের নেতা হইয়া বসিয়াছেন সেই সব ব্যক্তি যাঁহাদের সহিত কলেজের কোনও যথার্থ সংযোগই নাই। কখনও বিধায়ক, কখনও পুরপ্রতিনিধি, কখনও এলাকার প্রভাবশালী নেতা ক্যাম্পাসে ছড়ি ঘুরাইতেছেন। ছাত্র ইউনিয়নের নির্বাচনের সময়ে কলেজে বহিরাগতদের প্রবেশের সুযোগ করিয়া দিতেছেন। এখন তিনিই ‘ছাত্র নেতা’ বলিয়া খ্যাতিলাভ করিতেছেন যিনি অনুপস্থিত কিংবা অকৃতকার্য ছাত্রদের পরীক্ষায় বসিবার অনুমতি আদায় করিতে পারেন, অধ্যক্ষ-শিক্ষকদের হেনস্থা করিতে পারেন। ইহা রাজনীতি নহে, রাজনীতির ব্যঙ্গচিত্র।
যে কোনও ছাত্র সক্রিয় রাজনীতি করিতে পারেন, সমমতের ভিত্তিতে সংগঠিতও হইতে পারেন কিন্তু তাহা ক্যাম্পাসে নয়, যথাযথ ক্ষেত্রে। পশ্চিমের দেশগুলিতে দেখা গিয়াছে, ছাত্র সংগঠনগুলি বার বার প্রধান রাজনৈতিক দলগুলির সমালোচনা করিয়াছে। ষাটের দশকের যুক্তরাষ্ট্রে ভিয়েতনাম যুদ্ধের বিরোধিতা, ফ্রান্সে পুঁজিবাদ-বিরোধী বামপন্থী আন্দোলন হইতে সাম্প্রতিক কালে ইরাক যুদ্ধের বিরোধিতা, নয়া-উদারবাদ লইয়া ক্ষোভ প্রকাশ, প্রভৃতির দ্বারা ছাত্র রাজনীতি গণতন্ত্রে বাড়তি মাত্রা যোগ করিয়াছে। কিন্তু তাহা কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে দলাদলির রাজনীতি নহে। ক্যাম্পাসে ছাত্র-নির্বাচনের উদ্দেশ্য রাজনৈতিক দলের নির্বাচনের মকশো নহে। আশঙ্কা হয়, কলিকাতা হাইকোর্টের রায় ছাত্র রাজনীতির এই বিকৃত রূপকে এক প্রকার প্রাতিষ্ঠানিক মর্যাদা আনিয়া দিবে না কি? কলেজ নির্বাচন যে কলেজগুলির একান্ত নিজস্ব বিষয়, তাহার বিষয়ে অন্যে সিদ্ধান্ত স্থির করিলে কলেজের স্বাতন্ত্র্য লাঘব হয়, সেই সত্যটি এই নির্দেশের ফলে আরও বেশি করিয়া আড়ালে চলিয়া গেল না কি? যাহা ছিল ছাত্র নির্বাচন বিষয়ে একটি নীতিগত প্রশ্ন, তাহাকে আদালত কেবল মাত্র আইনশৃঙ্খলার প্রশ্ন বলিয়া দেখিল, ইহা অত্যন্ত আক্ষেপের বিষয়। কেবল বাস্তব পরিস্থিতির দিক হইতে নহে, ছাত্র সংগঠনের চরিত্র এবং ক্রিয়াকলাপ সম্পর্কে ভুল সঙ্কেত দিবার কারণেও। |