|
|
|
|
|
|
|
সিনেমা সমালোচনা... |
|
ঋতুপর্ণার চারুলতা |
‘নষ্টনীড়’-এর মোড়ক। পরকীয়ার সমকালীন প্রয়োগ। সাহসী সংলাপ। লিখছেন সঙ্গীতা বন্দ্যোপাধ্যায় |
রবীন্দ্রনাথের ‘নষ্টনীড়’ কাহিনির অন্তর্গত আত্মাটি অবশ্যই সূক্ষ্মতার সঙ্গে মিলিয়ে দিয়েছেন অগ্নিদেব চট্টোপাধ্যায় তাঁর ‘চারুলতা ২০১১’ ছবির মধ্যে। আর ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত শুধু ক্লোজ-শটের পরে ক্লোজ-শটে প্রায় মেকআপহীন মুখাবয়বকে ভেঙেচুরে অসংখ্য অভিব্যক্তির পর অভিব্যক্তি সম্বলিত অভিনয় দিয়ে ২০১১-র চারুলতার মধ্যে থেকে বের করে এনেছেন এমন এক শহুরে মেয়েকে যে ‘নষ্টনীড়’-এর চারুলতার ভেতর থেকে খসে পড়েও চারুলতা নয়।
‘চারুলতা ২০১১’ আসলে চৈতি বলে একটি মেয়ের ফেসবুক আই ডি। আর অমল যার ফেসবুক আই ডি, সেই সঞ্জয় কিন্তু চৈতির জীবনে কালবৈশাখী ঝড়ের মতো একদিন আচমকা এসে পড়েনি। ফেসবুকের অমলের সঙ্গে অন্তর্গত এক শিক্ষিতা, স্বাধীনচেতা গৃহবধূর একাকীত্বের সঙ্গী ছিল মাত্র, তার মধ্যে ছিল সামান্য রোম্যান্টিকতার ছোঁয়া। কিন্তু সেই অমল যখন লন্ডনের পরবাস থেকে কলকাতায় পদার্পণ করল তখন অমল-চারুর নিছক সাক্ষাৎকার ভদ্রতাপূর্ণ মননশীল যোগাযোগ দুমড়ে-মুচড়ে প্রবল কামনা-বাসনায় রূপান্তরিত হল। হয়ত এটাই সত্যি, একজন বিবাহিতা নারী যখন পরপুরুষের সান্নিধ্যে আসে তখন তার শরীরটাই সর্বপ্রথম দাবি করে পুরুষ। কারণ ধরেই নেওয়া যায় যে পরিপূর্ণ শরীর এবং মনের বন্ধন স্বামীর সঙ্গে থাকলে একটি মেয়ে অন্য পুরুষের প্রতি টান অনুভব করবেই বা কেন? আর এখানে চৈতি বান্ধবীর কাছে স্বীকার করেছিল যে সে ‘সেক্স-স্টার্ভড’। পরিপাটি একটা সংসার ছিল চৈতির। শুধু ছিল না স্বামী-সঙ্গ। সদাব্যস্ত বিক্রম এক পত্রিকার সম্পাদক, যে যদিও চৈতিকে মনপ্রাণ দিয়ে ভালবাসে তথাপি সময় দিতে পারে না। |
|
চারুলতা ২০১১
ঋতুপর্ণা, কৌশিক, দোলন, অর্জুন, দিব্যেন্দু |
একটি দৃশ্যে চৈতি স্বমেহনে প্রবৃত্ত আর সেই সময় ঘরে ঢুকে আসে বিক্রম। স্ত্রীকে এই অবস্থায় দেখে সে চোরের মতো ফিরে যায়। আর এখানেই বোঝা যায় উভয়ের সম্পর্কটা আসলে বহুলাংশে প্রাতিষ্ঠানিক। তা সত্ত্বেও চৈতি অমলের সঙ্গে মিলনের স্মৃতিকে ধুয়ে-রগড়ে মুছে ফেলতে চেয়েছিল। অমলের সঙ্গে আর কখনও দেখা না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। কিন্তু এর পরেই আসে গল্পের আসল মোচড় যখন অমল এসে হাজির হয় চারু-বিক্রমের বাড়িতে! সে ‘নষ্টনীড়’-এর গল্পের মতোই চৈতির পিসতুতো দেওর, নাম সঞ্জয়। কলকাতার কয়েকটা দিন সে বিক্রমের বাড়িতেই থাকবে স্থির হয়।
সমস্ত মিল থাকা সত্ত্বেও চৈতি যে কেন ‘নষ্টনীড়’-এর চারুলতা নয় তা বোঝার জন্য দর্শককে ছবিটা দেখতে হবে। সুদীপা মুখোপাধ্যায়ের চিত্রনাট্যে যেন একটা ঘুরে দাঁড়ানোর ব্যাপার আছে। এই সাইবার সেক্স আর ওয়ান-নাইট স্ট্যান্ডের যুগে সম্পর্ক যতখানি তলানিতে এসে ঠেকেছেসেখানে চৈতিকে কয়েক দিনের প্রেম-যৌনতা-মোহের ওপর সম্ভবত বিবাহ নামক হাজার হাজার বছরের পুরনো স্থাপত্যকেই অধিক স্বীকৃতি দিতে দেখি আমরা। ‘প্রেগ কালার টেস্ট’-য়ে চৈতি যে অন্তঃসত্ত্বা, তা ধরা পড়ার পর যখন সে স্নানঘরে বসে কপাল ঠুকে আত্মভর্ৎসনা করতে থাকে তখন মনে হয় পরকীয়ার অন্তঃসারশূন্যতার হাত থেকে একবার রেহাই পেয়ে এই অবৈধ সন্তানকে সে নিজেও আর বহন করতে চায় না। চৈতি যদি কিছু চেয়ে থাকে তা হল বিয়েটা বাঁচাতে।
পরকীয়া নিয়ে এখন একের পর এক ছবি হচ্ছে, প্রত্যেকেই নিজের নিজের মতো করে সম্পর্ক, বিবাহ, প্রেম, বিশ্বাস, নির্ভরতার জায়গাগুলোকে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করছেন! ‘চারুলতা ২০১১’ হয়তো শুধু বিষয়ের জন্য নয়, ছবির ঘেরাটোপের মধ্যে ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত, কৌশিক সেন, দোলন রায় এবং অবশ্যই অর্জুন চক্রবর্তীর যে দক্ষ অভিনয় দেখার সুযোগ ঘটে, শীর্ষ রায়ের ক্যামেরা আর ইন্দ্রদীপ দাশগুপ্তের সুর মিলেমিশে যে সার্থক প্রযোজনাটি উপস্থাপিত হয় তা নিশ্চিত ভাবেই ভাল বাংলা ছবির মর্যাদা পেতে পারে। অতীতে ঋতুপর্ণা অসংখ্য ভাল ছবি করেছেন। অনেক বড় বড় পরিচালকের হাত ধরে অনেক গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রকে রূপদান করেছেন। কিন্তু চৈতির চরিত্রে ঋতুপর্ণাকে অন্য মাত্রার এক প্রভাবশালী অভিনেত্রী মনে হয়েছে। তাঁর স্বরক্ষেপণ এবং শরীরী ভাষাকে অস্ত্র করে এ যুগের চারুলতার নতুন সংজ্ঞা নির্ধারণ করেছেন তিনি। কেয়ার চরিত্রে দোলন রায় সরলতা, লোভ এবং পাপবোধের একটা অদ্ভুত মিশ্রণ এনেছেন অভিনয়ে। চৈতির দাদার ভূমিকায় কৌশিক সেন উমাপদর একেবারে একটি আধুনিক সংস্করণ। গলা ডাব করা হওয়ায় এবং এমনিতেও দিব্যেন্দু মুখোপাধ্যায়ের অভিনয় নিয়ে কথা না বলাই ভাল। তবে এটুকু বলা যায় পর্দায় তাঁর উপস্থিতি যথেষ্ট আকর্ষণীয় লেগেছে। অনেক দিন পর এত বড় ভূমিকায় অর্জুন চক্রবর্তীর অভিনয়ও এই ছবিকে সমৃদ্ধ করেছে।
শেষের দৃশ্যে বিক্রম চৈতির গলা টিপে ধরে জানতে চায়, “হু ইজ দ্য ফাদার?” উত্তরে চৈতি বলে “ইউ”। “তা হলে অমল কে?’’ “চারুলতাকে জিজ্ঞেস করো,” বলে চৈতি। আমাদের সামাজিক পরিচয়ের ভেতরেই যে আমাদের নকল পরিচয়গুলো প্রাণ পায় এ কথা সংসারজীবী মানুষ সহজে মেনে নিতে পারে না, আর তাই হয়তো পৃথিবীর সমস্ত সাহিত্য, সিনেমা সেই সত্যিকেই বার বার প্রমাণ করার চেষ্টা করে চলেছে! |
|
|
|
|
|