|
|
|
|
|
|
|
চিত্রকলা ও ভাস্কর্য ১... |
|
অনুভব ছাড়াও আছে মানবী চেতনার স্নিগ্ধ প্রকাশ |
অ্যাকাডেমিতে চলছে সুমনা ঘোষের একক প্রদর্শনী। ঘুরে এসে লিখছেন মৃণাল ঘোষ। |
সুমনা ঘোষের ষষ্ঠ একক প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হচ্ছে অ্যাকাডেমি অব ফাইন আর্টসের ওয়েস্ট গ্যালারিতে। তাঁর প্রথম একক অনুষ্ঠিত হয়েছিল ২০০৫-এ। তার পর থেকে তিনি নিয়মিত কাজ করে যাচ্ছেন এবং বিবর্তনের মধ্য দিয়ে নিজস্ব এক রূপরীতি তৈরি করেছেন। সেই রূপরীতির মূলে আছে উপস্থাপনা ও প্রয়োগের সারল্য। সেই সারল্য ঠিক লৌকিকের সারল্য নয়। বরং এক নাগরিক সচেতনতা ও বিদগ্ধ অনুভব আছে তাঁর রূপায়ণে। আছে মানবী চেতনার স্নিগ্ধ প্রকাশ। মানবী চেতনার ভিত্তি থেকেই তিনি জীবনকে দেখেন। তার অন্তর্লীন আনন্দ, জটিলতা, আশা ও হতাশাকে ধরতে চেষ্টা করেন। তিনি প্রধানত অবয়বী ছবি আঁকেন। সেই অবয়ববিন্যাস স্বাভাবিকতার ভিত্তি থেকে শুরু হয়। কিন্তু কখনওই অনুপুঙ্খ স্বাভাবিকতা বা ‘অ্যাকাডেমিক ন্যাচারালিজম’-এর দিকে যায় না। তাঁর কোনও প্রাতিষ্ঠানিক শিল্পশিক্ষা নেই। রূপায়ণের আপাত দুর্বলতাকে তিনি যে ভাবে নান্দনিক বৈভবে রূপান্তরিত করেন, তাতেই তাঁর ছবির শক্তি ও স্বকীয়তা। এই সারল্য, ইংরেজিতে যাকে বলে ‘নাইভিটি’, তার প্রকৃষ্ট ব্যবহারের মধ্য দিয়ে তিনি উন্মীলিত করেন জীবনের আনন্দ ও বিষাদ। যার মধ্যে তাঁর নিজস্ব জীবন খুব বেশি করে জড়িয়ে থাকে। তাঁর অধিকাংশ ছবিই খানিকটা আত্মজৈবনিক।
স্বাভাবিকতাকে তিনি কল্পরূপ ও ফ্যানটাসির দিকে নিয়ে যান। স্বাভাবিক ও কল্পরূপ, এই দুইয়ের সমন্বয় ও টানাপোড়েনে গড়ে ওঠে তাঁর নিজস্ব প্রকাশভঙ্গি। যা অনেক সময়ই কৌতুকদীপ্ত, স্নিগ্ধ ও গভীরতর সমাজচেতনা ও জীবনভাবনায় দীপ্ত। এখানেই তাঁর ছবির স্বকীয়তা। সম্প্রতিকালে চিত্রকলার আঙ্গিক খুবই জটিল হয়ে উঠেছে। সুমনার ছবি তা থেকে অনেকটাই দূরবর্তী। জীবনের জটিলতাকেও তিনি সহজ ছন্দে রূপ দিতে চেষ্টা করেন। ঐতিহ্য ও সাম্প্রতিকতার এক সংশ্লেষ চলে তাঁর মধ্যে। এই সংশ্লেষ থেকে বেরিয়ে আসে চিত্রকলার দেশজ আত্মপরিচয় গড়ে তোলার একটা ধরন। |
|
শিল্পী: সুমনা ঘোষ |
আলোচ্য প্রদর্শনীর শিরোনাম: ‘গ্রিন বিলো ব্লু অ্যাবাভ’। নীচে শ্যামল পৃথিবী, উপরে সুনীল আকাশ। সীমা ও সীমাহীনতার মধ্যবর্তী অঞ্চলে জীবনের যে বিস্তার তাকেই স্বাভাবিকতায়, কল্পরূপে, কৌতুকে ও করুণায় ধরতে চেষ্টা করেছেন শিল্পী। মোট ২০টি ছবি নিয়ে আয়োজিত এই প্রদর্শনী। ক্যানভাস ও কাগজের বড় ছবিগুলি টেম্পারায় আঁকা। এই মাধ্যমটিকে গোড়া থেকেই চর্চা করে তিনি অনেকটা পরিশীলিত করেছেন। কয়েকটি ছোট ছোট ছবি আছে ক্যানভাসের উপর অ্যাক্রিলিকে আঁকা। এগুলি কয়েক বছর আগের রচনা।
প্রদর্শনীর শিরোনাম নেওয়া হয়েছে এই শিরোনামেরই একটি ছবি থেকে। সেই ক্যানভাসটি তিনটি পরিসরে বিভাজিত। বাঁ পাশে অপ্রশস্ত শূন্য পরিসরে দেখা যাচ্ছে শুধু কয়েকটি ক্যাকটাস। ডান পাশের বিস্তৃত পরিসর দু’ভাগে বিভাজিত। নীচে সবুজ প্রান্তর নানা রকম গুল্মে ভরা। নারী, পুরুষ ও শিশু নিয়ে কৌতুকদীপ্ত এক কল্পরূপের পরিমণ্ডল সেখানে। বিষাদের ভিতর থেকে আনন্দের উৎসারণ। উপরে সাদা মেঘে ভরা নীল আকাশ। এ দুইয়ের মাঝখানে দাঁড়িয়ে মাইক্রোফোন সামনে দিয়ে দু’হাত তুলে কিছু ঘোষণা করছে এক যুবক। হয়তো রাজনীতি আসছে। রাজনীতির সঙ্গে জীবনের স্বাভাবিক ছন্দের এক দ্বন্দ্বাত্মক সম্পর্ক রচিত হচ্ছে।
‘টিয়ারফুল স্প্রিং’ ছবিতে পত্রপল্লবের উপর বসে আছে এক বিষণ্ণ যুবতী। একটি ছাগল এসে দাঁড়িয়েছে তার সামনে। পিছনে এক যুবক ডানায় ভর করে উড়ছে। প্রেক্ষাপটে হলুদ আলোয় রঙিন ছোপের বিচিত্র মোজাইক। এই বর্ণিল মোজাইক তাঁর ছবির একটি বৈশিষ্ট্য। উপরের দিকে বাঁ পাশে জানলা দিয়ে দেখা যাচ্ছে এক ফালি সবুজ। গাছের ডালে বসে আছে একটি কোকিল। সন্ত্রাসের ‘ন্যারেটিভ’ গড়তে চেয়েছেন ‘সূর্য প্রণাম’ ছবিতে। স্নান সেরে সূর্য প্রণাম করছে মধ্যবয়সী এক পুরুষ। পাশে রেলিং-এর উপর একটি ছাগল। সামনে রাইফেল থেকে তাঁর দিকে গুলি ছুঁড়ছে দু’জন সন্ত্রাসবাদী। ‘দ্য সাইক্ল’ ছবিতে দেখাতে চেয়েছেন নারীর জীবনের তিনটি পর্যায় কৈশোর, যৌবন ও বার্ধক্য। তিনটি পর্যায় বোঝাতে তিনটি দৃশ্য-প্রতীক ব্যবহার করেছেন। ধুতুরা ফুলের পাশে কাক, উনুনে ফুটন্ত ভাত ও সব্জির ডালি এবং একটি বৃশ্চিক। ‘দ্য ডান্সিং চাইল্ড’ ছবিতে শিশুটি আনন্দে নৃত্য করছে। উপরে শিব ও দুর্গার আলেখ্য। ডান পাশের লম্বমান পরিসরে উপর থেকে নীচে বিন্যস্ত রয়েছে কয়েকটি প্রতিমাকল্প কুকুর, প্যাঁচা, নারীমুখ ও এক যুবক।
এভাবে জীবনের, মানবী চেতনার, শৈশবের নানা দিককে, নানা অন্তর্লীন জটিলতাকে শিল্পী রূপ দিয়ে গেছেন বিভিন্ন ছবিতে। সব মিলে উঠে আসে এই সময়ের ‘বিপন্ন বিস্ময়’। |
|
|
|
|
|