ছেদ নয় চাকরিতে, ধর্মঘটে না আসায় বেতন কেটেই ‘শাস্তি’
র্মঘটের দিন কাজে না-এলে ছুটি মঞ্জুর করা হবে না বলে নির্দেশ জারি করেছিলেন মুখ্যসচিব। ধর্মঘটের আগের দিন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় স্বয়ং সাফ জানিয়েছিলেন, ধর্মঘটের দিন কাজে না-এলে চাকরিতে ‘ছেদ’ (ব্রেক অফ সার্ভিস) পড়বে। বাস্তবে কিন্তু সে সবের ধার দিয়ে গেল না রাজ্য প্রশাসন। ধর্মঘট মোকাবিলায় শাস্তিমূলক ব্যবস্থার নির্দেশ জারি হল ঠিকই। এক দিন চাকরি জীবনের মেয়াদও কমার কথা বলা হল। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রী-সহ রাজ্য প্রশাসনের পূর্ব হুঁশিয়ারি মতো ‘ব্রেক অফ সার্ভিস’-এর কথা বলা হল না।
মঙ্গলবার, ৬ মার্চ রাজ্যের অর্থসচিব এইচ কে দ্বিবেদীর জারি-করা একটি নির্দেশে বলা হয়েছে, গত ২৮ ফেব্রুয়ারির ধর্মঘটে ‘অনুপস্থিত’ কর্মীদের সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলি ‘কারণ দর্শানোর’ নোটিস পাঠাবে। তার উত্তর সরকারের কাছে ‘সন্তোষজনক’ না-হলে তাঁদের এক দিনের বেতন কাটা হবে। তবে নির্দেশে এ-ও স্পষ্ট করে দেওয়া হয়েছে, বেতন কাটা হলেও চাকরিতে ‘ছেদ’ পড়বে না। বিশেষ এই ব্যবস্থাকে পরিভাষায় ‘ডাইস নন’ বা ‘নো ওয়র্ক নো পে’ (কাজ না-করলে বেতন নেই) হিসেবেই ব্যাখ্যা করা হচ্ছে রাজ্য সরকারের তরফে। রাজ্যের মুখ্যসচিব সমর ঘোষ বুধবার বলেছেন, “এটাকে বিশেষ ছুটি হিসেবে দেখা যেতে পারে। এতে চাকরিজীবনে শুধু একটা দিন কমে যাবে। সিনিয়রিটি এবং বেতন বৃদ্ধির ক্ষেত্রে এর কোনও প্রভাব পড়বে না।”
ধর্মঘটের দিন মহাকরণ
ধর্মঘটের দিন কাজে না-এলে চাকরিতে ছেদ পড়বে বলে হুঁশিয়ারি দিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। তার জেরে ধর্মঘটের দিন উপস্থিতির হার ছিল সাধারণ দিনের তুলনায় বেশি। তবে সরকারি কর্মীদের একাংশের দাবি ছিল, অনুপস্থিত কর্মীদের বিরুদ্ধে সরকার কোনও ব্যবস্থা না-নিলে পরের ধর্মঘটে কর্মীদের আর অফিসমুখো করা যাবে না। মহাকরণ সূত্রে খবর, সেই জন্যই শেষ পর্যন্ত এক দিনের বেতন কেটে ‘নামমাত্র শাস্তি’ই দিতে চেয়েছে সরকার। পুর ও নগরোন্নয়ন মন্ত্রী ফিরহাদ (ববি) হাকিমের কথাতেও তার ইঙ্গিত মিলেছে। তিনি বলেছেন, “সরকারে কোনও ছাঁটাই নেই। তাই ধর্মঘটের প্রশ্নও ওঠে না। তবে আমরা কর্মীদের সহযোগিতা চাই। কর্মীদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করতে চাই।”
কোন কোন পরিস্থিতি অনুপস্থিতির কারণ হিসেবে সরকারের কাছে ‘মার্জনীয়’, তা স্পষ্ট জানিয়ে দেওয়া হয়েছে অর্থসচিবের বিজ্ঞপ্তিতে। সেগুলি হল: ধর্মঘটের দিন কোনও সরকারি হাসপাতালে ভর্তি হলে, পরিবারে কোনও বিপর্যয় ঘটলে, আগে থেকেই রোগজনিত কারণে কিংবা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়ে ছুটিতে থাকলে এবং এমন কোনও পরিস্থিতিতে পড়লে, যার উপরে কোনও নিয়ন্ত্রণ সংশ্লিষ্ট অনুপস্থিত কর্মীর নেই। অর্থ দফতরের এক কর্তার কথায়, “আচমকাই কেউ অসুস্থ হয়ে পড়লেন। ইচ্ছে থাকলেও শারীরিক কারণে তিনি অফিসে আসতে পারলেন না। সে ক্ষেত্রে চিকিৎসকের শংসাপত্র তাঁর অনুপস্থিতির কারণ হিসেবে বিচার্য হতে পারে।” তবে কোনও পরিস্থিতিতেই পরিবহণ ব্যবস্থায় ত্রুটির কারণ দেখানো চলবে না বলে স্পষ্ট জানিয়ে দেওয়া হয়েছে ওই বিজ্ঞপ্তিতে। কারণ সরকার মনে করে, ধর্মঘটের দিন যান চলাচল আর পাঁচটা দিনের মতোই স্বাভাবিক ছিল।
ধর্মঘট মোকাবিলায় যে পথ মমতার সরকার নিয়েছিল, তা নিয়ে রাজনৈতিক বিতর্ক ছিল তীব্র। ধর্মঘটের দিন অনুপস্থিত কর্মীদের জন্য শাস্তিমূলক নির্দেশিকা জারি হওয়ার পরেও তা প্রত্যাহার করার দাবি তুলেছে রাজ্যের প্রধান বিরোধী দল সিপিএম। বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্রের কথায়, “এই সিদ্ধান্ত বেআইনি, অগণতান্ত্রিক এবং নজিরবিহীন! নির্দেশিকা প্রত্যাহার করে নিলে সরকারের সম্মান রক্ষা হবে। প্রত্যাহার না-করলে রাজনৈতিক ও আইনগত মোকাবিলার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে সরকারকে!” এমন নির্দেশিকার ফলে ভবিষ্যতে ধর্মঘট ডাকা হলে তা আরও ‘সফল’ হওয়ার রাস্তা তৈরি হল বলে দাবি করে সূর্যবাবু এ দিনও ফের বলেছেন, এক দিনের জন্যও ‘ব্রেক অফ সার্ভিস’ করতে পারবে না সরকার। অর্থ দফতরের নির্দেশিকাতে অবশ্য তেমন কথা বলাও নেই।
মন্ত্রী ফিরহাদের ব্যাখ্যা, তাঁরা কর্মসংস্কৃতির উন্নয়ন চান। সেই জন্যই ধর্মঘট মোকাবিলায় ‘কড়া অবস্থান’ নিয়েছে সরকার। বস্তুত, ধর্মঘটের দিন অনুপস্থিতির জন্য বেতন কাটার মতো শাস্তিমূলক সিদ্ধান্ত সাম্প্রতিক কালে কার্যকর হয়নি এ রাজ্যে। বামেদের অবশ্য দাবি, তাদের জমানায় ধর্মঘটের দিন ছুটি চাইলে দেওয়া হত। ছুটি না-নিয়ে গরহাজির থাকা যেত না। মমতার সরকার যে পথে কর্মসংস্কৃতি উন্নত করতে চাইছে, তার বিরোধিতা করে সিপিএমের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য সূর্যবাবু এ দিন বলেছেন, “কর্মসংস্কৃতির উন্নয়ন চাইলে হুমকি-ধমক দিয়ে কিছু হবে না! কর্মচারীরা সরকারের অঙ্গ। সরকারের সঙ্গে তাঁদের প্রভু-ভৃত্যের সম্পর্ক নয়! তাঁদের সঙ্গে আলোচনা করতে হবে। সামন্ততান্ত্রিক মানসিকতা থেকে বেরোতে হবে।”
গরহাজিরার কোপ
• অনুপস্থিতি বেআইনি
• কারণ দর্শানোর নোটিস
• লিখিত ব্যাখ্যায় সন্তুষ্ট না হলে শাস্তি
• এক দিনের বেতন কাটা
• চাকরির মেয়াদ কমবে এক দিন
• লিখিত ব্যাখ্যা না দেওয়া শৃঙ্খলাভঙ্গের সামিল
কোন কোন ক্ষেত্রে ছাড়*
• সংশ্লিষ্ট কর্মী হাসপাতালে ভর্তি থাকলে
• পরিবারের কারও মৃত্যু হলে
• অসুস্থতার জন্য আগে থেকে না এলে
• নির্দেশিকা জারির আগে থেকে ছুটিতে থাকলে
• নিয়ন্ত্রণের বাইরে থাকা এমন কোনও কারণ ঘটলে
(নথিসহ প্রমাণ দাখিল করতে হবে)
বিরোধী দলনেতা ফের স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন, ধর্মঘটে যোগ দেওয়া এবং না-দেওয়া, দু’টো অধিকারই সকলের আছে। তাতে ‘জোর করে হস্তক্ষেপ’ করা যায় না।
যে সব কর্মী বিভাগীয় কারণ দর্শানোর নোটিসের কোনও জবাব দেবেন না, তাঁদের বিরুদ্ধে ‘কড়া ব্যবস্থা’ নেওয়ার কথাই বলা হয়েছে সরকারি বিজ্ঞপ্তিতে। একই সঙ্গে অর্থসচিবের নির্দেশে বলা হয়েছে, পুরো প্রক্রিয়াটি আগামী ৩১ মার্চের মধ্যে শেষ করে ফেলতে হবে। সরকারি হিসেবে, ধর্মঘটের দিন গড়ে ৮৪% কর্মী অফিস করেছেন। অর্থাৎ, রাজ্যের চার লক্ষ সরকারি কর্মীর মধ্যে ৬৪ হাজার (মতান্তরে ৮০ হাজার) কর্মী অনুপস্থিত ছিলেন। সরকারি নির্দেশের পরে ওই সব অনুপস্থিত কর্মীর কাছেই কারণ দর্শানোর নোটিস পাঠাবে সংশ্লিষ্ট দফতর। তবে রাজ্য শিক্ষা দফতরের কর্তারা জানিয়েছেন, সরকারি এই নির্দেশিকা এখনও তাঁদের কাছে পৌঁছয়নি। স্কুলশিক্ষা সচিব বিক্রম সেন এবং উচ্চশিক্ষা সচিব সতীশ তিওয়ারি জানিয়েছেন, ওই নির্দেশিকা এলে তা দেখে তাঁরা উপযুক্ত ব্যবস্থা নেবেন। প্রসঙ্গত, ধর্মঘটের দিন কাজে আসা এবং না-আসার অধিকার রয়েছে বলে সদ্যই মন্তব্য করেছেন শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসু। এর পরিপ্রেক্ষিতে বিরোধী দলনেতা সূর্যবাবু এ দিন মন্তব্য করেছেন, “ধর্মঘট নিয়ে মুখ্যমন্ত্রী এবং অন্য মন্ত্রীরাও ওই কথা বললে ভাল!”
রাজ্য প্রশাসনের সিদ্ধান্তে মিশ্র প্রতিক্রিয়া হয়েছে কর্মচারী মহলে। সিপিএম-প্রভাবিত রাজ্য সরকারি কর্মচারী সংগঠন কো-অর্ডিনেশন কমিটির তরফে অবশ্য কোনও বিবৃতি দেওয়া হয়নি। সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক অনন্ত বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “আমাদের সংগঠনে আলোচনা চলছে। কোনও সিদ্ধান্ত হয়নি।” তবে নির্দেশিকার বিরোধিতা করে ওয়েস্ট বেঙ্গল গভর্নমেন্ট এমপ্লয়িজ ইউনিয়ন (নবপর্যায়)-এর নেতা সমীররঞ্জন মজুমদার বলেছেন, “যাঁরা ধর্মঘটের দিন আসেননি বা আসতে পারেননি, তাঁদের বিরুদ্ধে একতরফা শাস্তি হিসেবে বেতন কাটার অগণতান্ত্রিক, স্বৈরতান্ত্রিক আদেশনামা অবিলম্বে প্রত্যাহার করতে হবে।”
আইএনটিইউসি অনুমোদিত কনফেডারেশন অফ স্টেট গভর্নমেন্ট এমপ্লয়িজের তরফে শ্যামল মিত্র, মলয় মুখোপাধ্যায়দের দাবি, “সরকারই শ্রমিক-কর্মচারীদের উপরে ভরসা রাখতে পারছে না! প্রয়োজনে আমরা আদালতে যাব। কিন্তু এ ধরনের সিদ্ধান্ত মানব না।” তৃণমূল প্রভাবিত সংগঠনগুলির পক্ষ থেকে সরকারের সিদ্ধান্তকে ‘স্বাগত’ জানানো হয়েছে। স্টেট গভর্নমেন্ট এমপ্লিয়জ ফেডারেশনের রাজ্য সভাপতি মনোজ চক্রবর্তীর বক্তব্য, “আমরা চাই, বন্ধের সংস্কৃতি বন্ধ হোক। কর্মসংস্কৃতি ফেরাতে সরকারের পদক্ষেপ সমর্থন করছি।” ইউনাইটেড স্টেট গভর্নমেন্ট এমপ্লয়িজ ফেডারেশনের বিশ্বজিৎ ভট্টাচার্য, সৌম্য বিশ্বাসরাও এই সিদ্ধান্তকে ‘সরকারি কর্মচারীদের স্বার্থবাহী আদেশনামা’ বলে অভিহিত করেছেন।



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.