আদালতের রায়ে বিভ্রান্তি
কলেজ ভোটেও দায়িত্বে মুখ্য নির্বাচনী অফিসার
রাজ্যের সমস্ত কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র সংসদ নির্বাচন পরিচালনার ভার রাজ্যের মুখ্য নির্বাচনী অফিসারের উপরে ন্যস্ত করল কলকাতা হাইকোর্ট। মুখ্য নির্বাচনী অফিসারের সুপারিশমতো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্র সংসদ ভোটে পুলিশি ব্যবস্থা করতে এ দিন রাজ্য পুলিশের ডিজি-কে নির্দেশ দিয়েছেন বিচারপতি তপেন সেন।
কলকাতা হাইকোর্টের এই নির্দেশকে রাজ্য সরকারের উপরে আস্থার অভাব হিসেবেই দেখছেন রাজনীতি ও প্রশাসনের সঙ্গে যুক্তদের একাংশ। তাঁদের মতে, ছাত্র সংসদ ভোটে আইনশৃঙ্খলা বজায় রাখতে রাজ্য প্রশাসনের ‘ব্যর্থতা’র কারণেই এমন নির্দেশ দেওয়া হল। এর আগে বর্ধমান-কাণ্ডেও রাজ্য প্রশাসনের উপরে ‘অনাস্থা’ প্রকাশ করেছিল কলকাতা হাইকোর্ট। সেখানে দুই সিপিএম নেতা খুনের তদন্তভার জেলা পুলিশের হাত থেকে কেড়ে নিয়ে সিআইডি’র হাতে তুলে দিয়েছিল রাজ্যের শীর্ষ আদালত।
বুধবার হাইকোর্ট যে নির্দেশ দিয়েছে তার ফলে রাজ্যের বিভিন্ন কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে স্থগিত হয়ে যাওয়া সংসদ নির্বাচন এখন করা যাবে। নির্বাচনের দিন নির্ধারণ থেকে ফল ঘোষণা যাবতীয় কাজ করবে রাজ্য মুখ্য নির্বাচনী অফিসারের দফতর। সংশ্লিষ্ট কলেজ-কর্তৃপক্ষ বা পুলিশ-প্রশাসনের ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট দিনে নির্বাচন আয়োজনে সমস্যা হলে প্রয়োজনে ওই দফতরই তা স্থগিত রাখার কথা ঘোষণা করবে, পরবর্তী দিনও ঠিক করবে।
কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের লক্ষ্যে এর আগে রাজ্য নির্বাচন কমিশনের দ্বারস্থ হয়েছিল রাজ্যের উচ্চশিক্ষা সংসদ। কমিশন তখন কয়েকটি পরামর্শ দিয়ে জানিয়েছিল, শিক্ষাক্ষেত্রে নির্বাচন পরিচালনা তাদের কাজ নয়। তার পরে উচ্চশিক্ষা সংসদ সিদ্ধান্ত নেয়, এ ব্যাপারে একটি বিধি তৈরি হবে। কিন্তু তা হওয়ার আগে কী ভাবে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে সুষ্ঠু ভাবে সংসদ নির্বাচন আয়োজন করা যায়, তা নিয়ে সংশয়ের সৃষ্টি হয়। এরই মধ্যে কিছু ছাত্র কলকাতা হাইকোর্টে মামলা করেন এই অভিযোগে যে, তাঁরা সংসদ ভোটে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারছেন না। মামলাগুলির কয়েকটি ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট কলেজ-কর্তৃপক্ষ জানিয়ে দেন, তাঁদের পক্ষে অবাধ নির্বাচন পরিচালনা সম্ভব নয়। আর ওই মামলাতেই এ দিন হাইকোর্টের এই নির্দেশ।
এ দিকে হাইকোর্টের নির্দেশ ঘিরে প্রশাসনিক মহলে কিছুটা বিভ্রান্তিরও সৃষ্টি হয়েছে। কী রকম?
রাজ্যের মুখ্য নির্বাচনী অফিসারের দফতরের বক্তব্য: যে কোনও রাজ্যেরই মুখ্য নির্বাচনী অফিসার কাজ করেন জাতীয় নির্বাচন কমিশনের নিয়ন্ত্রণে। বিধানসভা, লোকসভা, রাষ্ট্রপতি এবং উপরাষ্ট্রপতি নির্বাচন ছাড়া অন্য কোনও ভোট জাতীয় কমিশন পরিচালনা করে না। কাজেই এ ক্ষেত্রে হাইকোর্ট কী নির্দেশ দিয়েছে, তা না-দেখে দফতর কিছু বলতে পারছে না। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্য নির্বাচনী অফিসার সুনীল গুপ্তের কথায়, “হাইকোর্টের নির্দেশ এখনও পাইনি।” আবার রাজ্য প্রশাসনের একাংশের মতে, হাইকোর্ট সম্ভবত রাজ্য নির্বাচন কমিশনের পরিচালনায় কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ভোট করাতে চেয়েছে। যদিও রাজ্য কমিশনও হাইকোর্টের এমন কোনও নির্দেশ পায়নি বলে এ দিন জানিয়েছেন রাজ্যের নির্বাচন কমিশনার মীরা পাণ্ডে।
ছাত্র সংসদ নির্বাচন ঘিরে রাজ্যের কলেজে-কলেজে হিংসার সূত্রপাত নভেম্বরের শেষে। সেই প্রবণতায় ছেদ পড়েনি। ঝাড়গ্রামের রাজ কলেজ কিংবা কলকাতার দীনবন্ধু অ্যান্ড্রুজের মতো বেশ কিছু কলেজে সংসদ ভোট স্থগিত রাখার নির্দেশ দিয়েছে হাইকোর্ট। শুধু তা-ই নয়, ছাত্র সংঘর্ষ ও অধ্যক্ষ নিগ্রহের ঘটনায় আগে ঘোর উদ্বেগও প্রকাশ করেছেন বিচারপতি সেন। গত ২১ ফেব্রুয়ারি শুনানি চলাকালীন তিনি মন্তব্য করেছিলেন, “গোটা রাজ্য জ্বলছে! প্রতিদিন সকালে খবরে দেখছি। কী হচ্ছে, তা কি আমরা দেখতে পাচ্ছি না?”
এ দিনের সওয়ালে আবেদনকারীদের পক্ষের আইনজীবী সুব্রত মুখোপাধ্যায় বলেন, “সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ, লিংডো কমিশনের সুপারিশ মেনে কলেজে ছাত্র সংসদ নির্বাচন করতে হবে। লিংডো-সুপারিশ মোতাবেক রাজ্য সরকার গাইডলাইন তৈরি করবে।” সুব্রতবাবু এই সংক্রান্ত কাগজপত্র আদালতে জমা দেন। অন্য দিকে সরকারপক্ষের দাবি: ছাত্র সংসদ নির্বাচন অবাধ ও শান্তিপূর্ণ করতে এবং লিংডো-সুপারিশ খতিয়ে দেখতে রাজ্য ইতিমধ্যে একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি গড়েছে, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য সুরঞ্জন দাসের নেতৃত্বে। সাত সদস্যের কমিটিতে রয়েছেন ছয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যেরা। ২১ ফেব্রুয়ারি কমিটির বৈঠকও হয়েছে।
তবে যে সূত্রে এই সব প্রসঙ্গের অবতারণা, সংসদ ভোট নিয়ে বিভিন্ন কলেজের কিছু পড়ুয়ার (মূলত এসএফআই সমর্থক) দায়ের করা সেই মামলাগুলি এ দিন খারিজ করে দিয়েছে কলকাতা হাইকোর্ট। তাতে আসল অভিযোগ ছিল শাসকদলের সমর্থনপুষ্ট ছাত্রগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে। বিচারপতি মনে করেছেন, ওই সমস্ত মামলাই রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। আদালতের বক্তব্য: ছাত্রদের মধ্যে পারস্পরিক শত্রুতারও কারণ হল রাজনীতি। কলেজের ভোটে অংশগ্রহণ করাই যেতে পারে, কিন্তু দেখতে হবে, সংসদ যেন শিক্ষা ও শিক্ষালয়ের উন্নয়নের স্বার্থে কাজ করে। বিচারপতির মতে, ছেলেমেয়ের ভবিষ্যৎ গড়ার ক্ষেত্রে কলেজে পড়ার সময়টা হল সবচেয়ে দামি। সেখানে শিক্ষা ও পঠন-পাঠনের বদলে রাজনীতি প্রাধান্য পেলে পড়ুয়াদের শিক্ষা ও ভবিষ্যৎ ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
সমর্থকদের মামলা খারিজ হলেও হাইকোর্টের এ দিনের নির্দেশকে রাজ্য সরকারের ‘প্রশাসনিক ব্যর্থতার প্রমাণ’ হিসেবে দেখছে এসএফআই। সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক ঋতব্রত বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথায়, “আদালতের রায়ে রাজ্য সরকারের প্রতি অনাস্থা প্রকাশ পেয়েছে। এটা আসলে সরকারের প্রশাসনিক ব্যর্থতাকে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে।” বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্রের প্রতিক্রিয়া, “আমাদের রাজ্যে এমন অবস্থা যে, আদালতও বুঝতে পারছে কলেজের নির্বাচন নিরাপদ নয়! যত দিন না সরকার গঠিত কমিটি রিপোর্ট দিচ্ছে, তত দিন একটা ব্যবস্থার কথা বলা হয়েছে। আমরা বলে আসছিলাম, এই সরকারের আমলে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে দলতন্ত্র চলছে, গণতন্ত্র নয়। আদালতের নির্দেশে প্রমাণ হল, সেটাই ঠিক।”
অন্য দিকে তৃণমূল ছাত্র পরিষদ (টিএমসিপি) হাইকোর্টের নির্দেশকে রাজ্যের প্রতি ‘অনাস্থা জ্ঞাপন’ হিসেবে দেখতে নারাজ। সংগঠনের উপদেষ্টা বৈশ্বানর চট্টোপাধ্যায় বলেন, “নির্দেশের প্রতিলিপি না-পেয়ে কোনও মন্তব্য করা ঠিক হবে না।” পাশাপাশি তাঁর মন্তব্য, “বিচারব্যবস্থার এই অতি সক্রিয়তা আগে দেখা গেলে ভাল হতো!” ছাত্র পরিষদ কিন্তু এ প্রসঙ্গে বর্তমান সরকারকেই দায়ী করেছে। সংগঠনের রাজ্য সভাপতি রাহুল রায়ের আক্ষেপ, “পরিবর্তনের পরেও রাজ্যের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি বিন্দুমাত্র বদলায়নি! বরং আরও খারাপ হয়েছে।” ছাত্র পরিষদ নেতৃত্বের বক্তব্য, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের সংসদ ভোটে নির্বাচন কমিশনের তদারকি মোটেই কাম্য নয়। তবে এ ভাবে নির্বিঘ্নে নির্বাচন করা গেলে তাঁদের কোনও আপত্তি নেই।
কী বলল হাইকোর্ট
• কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্বাচনে হিংসা বন্ধ হোক।
• ওই ভোট করাবেন রাজ্যের মুখ্য নির্বাচনী অফিসার, পুলিশের সাহায্যে।
• এসএফআইয়ের মামলা খারিজ, কারণ সেগুলি রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।
• কলেজ নির্বাচনে অংশগ্রহণ অপরাধ নয়। রাজনীতির কারণেই ছাত্রদের মধ্যে শত্রুতা।
• ছাত্র সংসদকে কাজ করতে হবে শিক্ষার উন্নয়নের স্বার্থে।
• ভবিষ্যৎ গড়তে কলেজের দিনগুলি সবচেয়ে দামি। তখন রাজনীতি প্রাধান্য পেলে শিক্ষা ও ভবিষ্যতের ক্ষতি।



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.