চারিদিকে অশোক-বকুলের মৃদু সুবাস। দখিনা বাতাস আর ফাগুনের চাঁদের আলো যেন বলতে চায় ‘এসো হে শ্যাম রাই হোলি খেলিতে’। এই সময়েই ঐতিহ্যের সঙ্গে ফাগুনের রঙ মিশিয়ে হয় মেদিনীপুরের ওড়িশা সীমান্ত লাগোয়া মোহনপুরের চৌধুরি (করমহাপাত্র) বাড়ির প্রাচীন দোল উৎসব। তিনশো বছরের পুরনো এই উৎসবকে ঘিরে প্রাচীন মন্দির প্রাঙ্গণে বসে মেলাও।
ওড়িশার রাজা মুকুন্দদেবের রাজত্বকালে সামন্ত রাজা ছিলেন করমহাপাত্র পরিবারের এক পূর্বসূরী। সেই সময়ে মোহনপুরের গড় প্রতিষ্ঠার সময় (১৫৬০) তৈরি হয় জগন্নাথ মন্দির। প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ ও মন্দির সমীক্ষক ডেভিড ম্যাকাচ্চন তাঁর ‘গ্রেট লেট মিডিয়েভল টেম্পলস অফ বেঙ্গল’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন এই করমহাপাত্র (পরে উপাধি চৌধুরি) পরিবারই অষ্টাদশ শতকের প্রথমার্ধে জগন্নাথ মন্দিরের পাশে একটি বিষ্ণু মন্দির নির্মাণ করেন। প্রায় পঞ্চাশ ফুট উচ্চতার ওড়িশার শিখর দেউলরীতির এই মন্দিরের চারদিকে রয়েছে দ্বাদশ শিবালয়। বছরভর ওই হিন্দু মন্দিরেই থাকে ধাতব রাধা-কৃষ্ণের মূর্তি। শুধুমাত্র দোলের দিন ভোর থেকে রাত পর্যন্ত জগন্নাথ মন্দিরে অবস্থান রাধা-কৃষ্ণের। সেই সময়েই শুরু হয় দোল উৎসব ও মেলা। |
পরিবারের সদস্য সুব্রত করমহাপাত্র, দেবব্রত করমহাপাত্ররা জানান, আগের জৌলুস না থাকলেও এখনও পুরনো রীতিনীতি মেনে অনুষ্ঠান করা হয়। দোলের আগের দিন থেকেই বিগ্রহকে নানা আচার মেনে অলঙ্কার ও পোশাকে সাজানো হয়। সেই দিন রাত বারোটা থেকে পরের দিন ভোরের আগে পর্যন্ত মোহনপুরের গ্রাম ও রাজপথে সিংহাসনে বসে শোভাযাত্রায় দোল খেলেন রাধা-কৃষ্ণ। প্রাচীন রীতি অনুযায়ী সবুজ ও নীল আবির ছাড়া অন্য কোনও রঙ ব্যবহার করা হয় না। পথ পরিক্রমার সময় বিশেষ ছাতা দিয়ে বিগ্রহকে আড়াল করা থাকে, যাতে অন্য কেউ শ্যাম-রাধার রঙ খেলা দেখতে না পান। কথিত, ওই খেলা দেখলে চোখ অন্ধ হয়ে যায়। পরিক্রমা শেষে মন্দির চত্বরে তৈরি করা ‘চাঁচর বুড়ির ঘর’ পোড়ানো হয়। প্রথা অনুযায়ী, এর পরেই দোল খেলা শুরু করেন গ্রামবাসীরা।
গ্রামীণ কুটির শিল্পের পসরা বসে মেলায়। কীর্তন, শোভাযাত্রা, কৃষ্ণযাত্রার পাশাপশি রাধা-কৃষ্ণকে নিয়ে লোকসংস্কৃতির ধারাগুলিকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও উৎসবের আয়োজন করা হয়। ঐতিহ্য মেনে দু’দিন ধরে কীর্তনীয়ারা গেয়ে চলেন ওড়িশি ভাষায় লেখা দোলের গান। পরিবারের সদস্য কনককান্তি করমহাপাত্র বলেন, “আমাদের দোল উৎসবের এটা বৈশিষ্ট্য। আমাদের বংশের নিজস্ব ঘরানার এই গানগুলি এত জনপ্রিয় যে অনেক গ্রামবাসীর তা মুখস্থ। দোল খেলার সময় অনেকে গাইতেও থাকেন।” আঞ্চলিক ইতিহাস গবেষক শান্তিপদ নন্দ বলেন, “এই মেলার অন্যতম আকর্ষণ ‘চানা-মুকুন্দি’। এগুলি হল ডাল কলাই ভাজা ও থালার আকারের বাতাসা, যা অন্যত্র বিরল।”
মন্দির সংলগ্ন কয়েক বিঘা জায়গায় বসে মেলা ও হাট। বর্তমানে করমহাপাত্র পরিবারের সঙ্গে দোল উৎসব ও মেলা পরিচালনা করে মোহনপুর জগন্নাথ জিউ হাট কমিটি। কমিটির সভাপতি পশুপতি কর ও সম্পাদক কালিপ্রসাদ পাল বলেন, “মন্দিরগুলি ভগ্নপ্রায়। তাই সেগুলি সংস্কারের পাশাপাশি প্রাচীন এই উৎসব ও মেলার জৌলুসকে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা হচ্ছে।” |