সাক্ষাত্কার...
জনতায় বিশ্বাস নেই, তাই সর্বত্র নিজের মূর্তি
মায়াবতীর প্রশাসনটা কিন্তু খুব খারাপ ছিল না। সমস্যাটা হল, ওঁর কিছু খেয়াল ঘিরে। সমাজবিজ্ঞানে একটা কথা আছে, ‘কনস্পিকিউয়াস কনসামশন’। এর সরাসরি বাংলা করা কঠিন, ধরুন, এ হল সেই ধরনের ভোগ, যা আসলে অন্যকে দেখানোর জন্য যে, এই দেখো, আমি এটা করছি! এই যে চার দিকে মূর্তি বানাচ্ছে, নিজের মূর্তি, হাতির মূর্তি, সেটা একটা সময় দলিতদের কাছেও একটু বাড়াবাড়ি বলেই মনে হল। পার্ক-টার্ক বানিয়েছে, মাঝেসাঝে পার্ক-এ গেলাম, ভাল কথা, কিন্তু ওই সব ঢাউস মূর্তি বসানো ওঁর নিজস্ব ভোট-ব্যাঙ্কের কাছেও ঔদ্ধত্যের মতো ঠেকল।

আমি বলব, এই ফিরে আসার পিছনে প্রকৃত নায়ক মুলায়মের পুত্র অখিলেশ। বয়স কম, বাবা ওকে উত্তরপ্রদেশে পড়াননি, অখিলেশ দক্ষিণ ভারতে পড়াশোনা করেছেন, বিদেশ গিয়েছেন, ফলে ওঁর দেখার চোখটা আরও ছড়ানো। উনি সমাজবাদী পার্টির মধ্যে একটা পরিবর্তন নিয়ে এসেছেন।

ও সব সুষম-টম কিছু না, আমার মনে হয়, অখিলেশ দুটো কাজ করেছেন। এক, সমাজবাদী পার্টির মধ্যে উনি একটা সাংগঠনিক শৃঙ্খলা নিয়ে এসেছেন। দলটা চলত মুলায়মের কিছু পেটোয়া লোকদের দিয়ে, তারাই সুবেদারের মতো বহাল থাকত, এবং যখন যা ইচ্ছে, তা-ই করত। দেখার কেউ ছিল না। ওই পরিস্থিতিতে দেখা সম্ভবও নয়। এতে কী হয়, পার্টি মেশিনারি বলে যে জিনিসটা থাকা খুব দরকার, সেটা থাকে না। কারণ, দলের ওপর কোনও নিয়ন্ত্রণই থাকে না। আপনি পশ্চিমবঙ্গের কথাই ধরুন। সেখানে সি পি এম কাদ্রে-ভিত্তিক দল। সেখানে শৃঙ্খলা মারাত্মক। ফলে, ‘পার্টি মেশিনারি’টাও মজবুত। আর, ভোটটা তারাই জোগাড় করে। লোকে ওবামাকে ভালবাসে বলে গিয়ে ভোট দিয়ে এল, ব্যাপারটা কিন্তু অতটা সহজ নয়। এ বার সি পি এম-কে হারানোর জন্য তৃণমূল কংগ্রেসকেও সে রকম একটা সংগঠন গড়তে হল। যাই হোক, অখিলেশ যাদব দলের সংগঠনটা জোরদার করলেন, ওই পেটোয়াতন্ত্রের বাইরে বেরোতে চাইলেন, ফলে দলের ওপর ওঁর নিয়ন্ত্রণটাও জোরালো হল। দুই, অখিলেশের মতো তরুণ নেতারা জানেন এবং বোঝেন, জনপরিসরে গণমাধ্যমের গুরুত্ব ঠিক কতটা। এটা বয়স্ক নেতারা সব সময় বুঝতে পারেন না, অনেক সময় বুঝতে চানও না। অখিলেশ সেই ভুলটা করলেন না। তবে আমি বলব, এই যে ঝাঁসিতে সাংবাদিক নিগ্রহ হয়েছে, অখিলেশের উচিত অবিলম্বে সংশ্লিষ্ট বিধায়ককে বলা যা হয়েছে হয়েছে, এখনই প্রকাশ্যে ক্ষমা চেয়ে নিন। উত্তরপ্রদেশে এই ‘পাবলিক অ্যাপলজি’টাকে বিরাট গুরুত্ব দেওয়া হয়। সুবেদারতন্ত্র মজ্জায় মজ্জায় তো, তাই ক্ষমা চাওয়াটাকে সবাই খুব বড় একটা ‘জেশ্চার’ বলে মনে করে। যদি অখিলেশ সেটা না করেন, তা হলে বলব, এই দফায় এটাই ওঁর প্রথম ভুল হবে। তা ছাড়া, বেয়াদব বিধায়ককে সামলানোর পাশাপাশি এ ভাবে উনি দলের ওপর নিয়ন্ত্রণটাও বজায় রাখতে পারবেন।

কুশীলব। মায়াবতী, রাহুল গাঁধী এবং অখিলেশ সিংহ যাদব।
হ্যাঁ, এই ভদ্রলোককে এরা বেশ সামনেও নিয়ে এসেছিল। টিভিতেও দেখা গিয়েছে তাঁকে। সমাজবাদী পার্টির চেহারা যে বদলাচ্ছে, তা এই ধরনের প্রার্থীর মধ্যে দিয়ে খুব স্পষ্ট।

ঠিকই। সঙ্গে আর একটা জিনিসও খেয়াল রাখা দরকার। মধ্যবিত্ত সমাজ কিন্তু এই ধরনের লোকদের মধ্যেই নিজেদের একটা প্রতিফলন বলুন, প্রতিনিধিত্ব বলুন, খুঁজে পায়। সেটাও জরুরি। সমাজবাদী পার্টির যে পরিবর্তন, তার মধ্যে এটাকেও গণ্য করতে হবে। এক সময় এদেরই লোকে গুন্ডার দল বলত, এবং নেহাত অকারণে যে বলত, তা মোটেই নয়।

এটা একটু অ্যান্টি-ক্লাইম্যাক্সের মতো শোনাবে, কিন্তু আমি বলব, ভারতীয় ভোটদাতারা এত দিনে প্রান্তীয় রাজনীতি এবং জাতীয় স্তরের রাজনীতির মধ্যে ফারাক করতে শিখেছেন। অর্থাৎ, যদি লোকসভা ভোট হয়, তা হলে হয়তো দেখবেন অমেঠি এবং রায়বরেলিতে ফের কংগ্রেসই জিতল! তা ছাড়া, কংগ্রেসের প্রাপ্ত ভোটের শতাংশ বেড়েছে, উত্তরপ্রদেশে কংগ্রেস দলটা যে রকম ছন্নছাড়া পরিস্থিতিতে ছিল, সেখান থেকে লড়ে একেবারে হারিয়ে গিয়েছে বলা যাবে না। উত্তরপ্রদেশে কংগ্রেসের কাঠামোটা নড়বড়ে হয়ে গিয়ে একেবারে সেই ভগ্নদশাই ছিল।

ঘটনাটা কিছুটা তা-ই। প্রান্তীয় রাজনীতি এবং জাতীয় রাজনীতির সমীকরণটা ভারতে বেশ আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছে। আবার, এমনও হতে পারে যে, লোকে ভাবল, ছোট দলগুলো বেশি উচ্চাকাঙ্ক্ষী, দুর্নীতি তাদের বেশি গ্রাস করেছে, ফলে তারা আমাদের দাবিদাওয়ার দিকে নজর দিচ্ছে না। এ রকমও কিন্তু হয়েছে।

বেশ খানিকটা যে বেরিয়েছে, তা তো ভোটের ফল থেকেই পরিষ্কার। তবে, কয়েকটা কথা মনে রাখা দরকার। এক, সর্বভারতীয় স্তরে যদি কোনও দলিত ‘আইকন’ খুঁজতে হয়, তা কিন্তু ওই মায়াবতীই। ভদ্রমহিলা তেমন একটা সর্বভারতীয় স্তরে নিজেকে নিয়ে যেতে পেরেছেন। এ কথা অস্বীকার করার কোনও রাস্তা নেই। পাশাপাশি, এটাও ঠিক যে, অনেক তরুণ নেতা আছেন দলিতদের মধ্যে, মায়াবতী চাননি, চানও না যে, তাঁরা উঠে আসুন। ফলে, তাঁরা ক্ষুণ্ণ হলেন। তার সঙ্গে যুক্ত হল, ওই যাকে বলছিলাম, ‘কনস্পিকিউয়াস কনসাম্পশন’। যে দিকে তাকাও, মূর্তি আর মূর্তি।

বেশ কয়েক হাজার কোটি টাকা নাকি খরচ করা হয়েছে ওই সব মূর্তির পিছনে। ধরুন, যদি ওই টাকাটা দিয়ে অনেকগুলো অম্বেডকর হাসপাতাল করা যেত! প্রচারও হল, জনতার উপকারও হল। একেবারে ‘স্পেশালাইজড’ হাসপাতাল করা যেত। যেমন, উত্তরপ্রদেশের পূর্ব দিকটায় খুব ম্যালেরিয়া হয়। ওখানে ম্যালেরিয়ার একটা ভাল চিকিৎসাকেন্দ্র করা হল। তেমনই, রাজ্যের যেখানে যে ধরনের রোগের প্রকোপ বেশি, সেখানে সেই ধরনের অসুখের জন্য বিশেষ ভাবে নির্দিষ্ট হাসপাতাল করা হল। এ বার সেই সব হাসপাতালের ফটকের সামনে একটা করে হাতির মূর্তি বসিয়ে দিক না, সেটা লোকের কাছে ততটা দৃষ্টিকটু ঠেকত না। সমস্যাটা হল, যাকে ‘ইলেক্টোরেট’ বা নির্বাচকমণ্ডলী বলে, এই কাজটা করার জন্য তাঁদের উপরে একটা ন্যূনতম আস্থা, একটা বিশ্বাস থাকা দরকার। সেটা নেই। ফলে, সর্বত্র নিজের মূর্তি, নিজের দলের প্রতীকের মূর্তি বসানো। আর একটা কথাও ঠিক। এই যে চড়া পর্দার রাজনীতি, স্বর চড়িয়ে, রং চড়িয়ে কিছু একটা বলে বাজিমাতের চেষ্টা করা, আমার কী রকম একটা সন্দেহ হয় যে, গত কয়েক দশকে জনতার কাছে তার আকর্ষণ অনেকটাই কমে গিয়েছে। ব্যতিক্রম আছে। পশ্চিমবঙ্গই অনেকটা ব্যতিক্রম, কিন্তু বড় ছবিটার দিকে তাকালে দেখবেন, ওই উচ্চগ্রামে তোলা রাজনীতি কিন্তু অনেকটাই ফিকে।

মুসলিম ভোট বরাবরই মুলায়মের জোরের জায়গা। মজাটা হল, কংগ্রেস তাতে থাবা বসাতে পারল না। তা ছাড়া, কংগ্রেস বরাবরই রক্ষণশীল মুসলমানদের পাশে থেকেছে, যাঁরা দরিদ্র, সাধারণ মুসলমান, তাঁদের পাশে থাকেনি। খেয়াল করে দেখুন, আওরঙ্গজেব-এর নামে দিল্লিতে বিরাট রাস্তা আছে, কিন্তু দারা শিকো নামে এক জন যে এই শহরেই বাস করতেন এক সময়, তা জানার জন্য আপনাকে গবেষণা করতে হবে। তা ছাড়া, নিজেদের ভাঙারও একটা ব্যাপার থাকে। বি জে পি সেটা বিরাট ভাবে করেছে বলব না, কিন্তু ভেবে দেখুন, নিতিন গডকড়ীর মতো মানুষ, আর এস এস-এর ভাবধারায় দীক্ষিত, তিনিও কিন্তু গোয়ায় প্রচুর খ্রিস্টানদের টিকিট দিলেন, এবং বিপুল ভাবে জিতল বি জে পি। ভারতীয় রাজনীতির ছবিটা বেশ আকর্ষণীয়, তাকে কোনও খোপে পুরে ফেলা কঠিন।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.