|
|
|
|
সম্পাদকীয় ২... |
শুধু ক্রোধ, শুধু ক্ষোভ? |
বৃষ্টি পড়িতেছে, রোদও উঠিয়াছে, এমন ঘটিলে এক বিস্মিত আনন্দ জাগে। তেমনই এ বছর এক দিনে দুইটি উপলক্ষ আসিয়াছে। তিথি-নক্ষত্রের হিসাবে আজ দোলযাত্রা, আবার ইংরাজি ক্যালেন্ডারের হিসাবে আজই আন্তর্জাতিক নারী দিবস। অনেকেই এ দুটিকে বিচ্ছিন্ন করিয়া দেখিবেন। ভাবিবেন, রং খেলিবার সহিত নারীস্বাধীনতা উদ্যাপনের সম্পর্ক কী? কিন্তু দোল কিংবা হোলির উৎসব, যাহা বস্তুত বসন্তের রাসলীলা, তাহা আদতে মেয়েদের বাধাহীন আনন্দোৎসব। তাহার নায়িকা শ্রীরাধা। প্রেমের ক্ষেত্রে সামাজিক বিধিনিষেধ অতিক্রম করিয়াও তিনি মহিমাময়ী। রাধারানি তপস্বিনী নহেন, অভিসারিণী। বৃন্দাবনের দোলযাত্রা তাঁহার প্রেমোচ্ছ্বাস উদ্যাপনের আয়োজন। এই কল্পচিত্র কালজয়ী, আজও নগরে নগরে শ্রীরাধার বসন্তোৎসবের পুনরভিনয় ঘটিতেছে। তাই প্রশ্ন করিতেই হয়, উপলক্ষ যাহাই হউক, বহু মেয়ে একত্রিত হইয়া অবাধে নৃত্যগীতক্রীড়ার মধ্য দিয়া আনন্দোৎসব করিবার এই ছবিটিই কি নারী দিবসেরও ছবি হইবার কথা ছিল না?
নারী আন্দোলনের লক্ষ্য সমাজে ও পরিবারে মেয়েদের মর্যাদা এবং অধিকার নিশ্চিত করা। কিন্তু কেবল ক্রোধের বাষ্প, ক্ষোভের উদ্গিরণই আন্দোলনের চালিকাশক্তি হইবে কেন? তাহা হইলে প্রতিনিয়ত আরও আরও ক্রোধ-ক্ষোভের ইন্ধন জোগাইতে হয়। অথচ স্ফূর্তির স্বাভাবিক শক্তির দ্বারা যে কোনও কঠিন কাজও স্বচ্ছন্দে করা যায়। সকলে মিলিয়া হই হই করিয়া আনন্দ করিবার মধ্য দিয়া যে জীবনীশক্তি উদ্ভূত হয়, তাহার শক্তি অপরিসীম। লোকগীতি, লোকসংস্কৃতির দিকে তাকাইলে দেখা যায়, দরিদ্র মহিলাদের জীবনে যতই অভাব থাকুক, তাহাদের বাঁধা গানে, তাহাদের সমবেত ছন্দোবদ্ধ নৃত্যে আনন্দের কোনও অভাব নাই। অসুন্দর, অন্যায়ের সহিত যুদ্ধের সঙ্গে সঙ্গেই নিজেদের জীবনে সুন্দরের, ন্যায়ের আবাহন করা প্রয়োজন। তাহাতে কাজ হয় আরও অধিক। কুৎসিত গালির উত্তরে গালি না দিয়া নির্মল পরিহাস করিতে পারিলে প্রতিপক্ষ একান্ত পরাস্ত হইয়া যায়।
অবশ্যই ইহা সহজ কাজ নহে। আত্মপ্রত্যয় না থাকিলে রসবোধ জন্ম লইতে পারে না। যাহার আত্মপ্রত্যয় নাই, সে-ই সর্বদা শঙ্কিত থাকে, ওই বুঝি কেহ আমাকে লইয়া রসিকতা করিল। নিন্দুকেরা বলিয়া থাকে, নারীবাদীদের রসবোধ নাই। কথাটা যে সত্য নহে, নবনীতা দেব সেনের লেখা পড়িলেই তাহা স্পষ্ট হয়। কিন্তু নারীবাদীরা মুখ খুলিলেই কেবল বঞ্চনা-নির্যাতনের কথা বলিয়া থাকেন, হাঁটিলেই শূন্যে মুষ্টি ছুড়িতে থাকেন, এমন একটি ছবি জনমানসে খোদাই হইয়া গিয়াছে। কোনও নারীবাদী গুনগুন করিয়া ‘মধুমালতী ডাকে আয়, ফুলফাগুনের ছায়ায়’ গাহিতেছেন, এমন চিন্তা করাও দুষ্কর। অথচ নারীর প্রেম, আত্মনিবেদন, আনন্দ-আয়োজনের সহিত তাহার মর্যাদা ও অধিকারের সন্ধানের কোনও বিরোধ নাই। পুরুষতন্ত্রই প্রকৃত প্রেমের পথ রোধ করিয়া দাঁড়ায়, যাহা আপনি পাইবার তাহা জোর করিয়া দখল করিতে চায়। সেই নির্বুদ্ধিতাকে তাচ্ছিল্য করিতে হইলে নারী দিবসকে লইয়া নূতন চিন্তার প্রয়োজন। এখন নারী দিবসে হয় আলোচনাকক্ষে অন্যায়ের আইনি প্রতিকার লইয়া আলোচনার বাঁধা গত, না হইলে অভিজাত বিপণিতে গহনা-শাড়ির উপর ছাড়ের পরিচিত আকর্ষণ। এই দুইয়ের মাঝে তরুণীরা নিজের পথটি খুঁজিয়া পাইবেন না, যদি না আন্দোলনের সহিত আনন্দ-আয়োজনের, প্রতিবাদের সহিত প্রীতিবন্ধনের সেতু গড়িয়া দেওয়া যায়। এই বসন্ত সেই চ্যালেঞ্জ লইয়া আসিয়াছে। |
|
|
 |
|
|