প্রবন্ধ...
‘হেতা কেউ পুরুষ নাই যে লাজ করব,
কাপড় মোরে পরাতে দিব নাই’

‘চাঁদ কিছু জ্যোৎস্না বমি করে ঘুমোতে যায়। থাকে শুধু অন্ধকার। একটি বাধ্য হয়ে পা ফাঁক করে চিতিয়ে থাকা নিশ্চল দেহ। তার ওপর সক্রিয় মাংসের পিস্টন ওঠে ও নামে, ওঠে ও নামে।’

‘দ্রৌপদী’, মহাশ্বেতা দেবী

এ কোন বিশ্বাসহীনতার অন্ধ গহ্বরে তলিয়ে যাচ্ছি আমরা! চোখের তারায় আমাদের অনিঃশ্বেস সন্ধিগ্ধতা, দিশেহারা আতঙ্ক আমাদের নিত্য সহচর এ ভাবে পুরুষকে পাশে নিয়ে কী ভাবে বাঁচবে মেয়েরা? অল্প চেনা থেকে অতিপরিচিত, এমনকী নিকটতম পুরুষ বন্ধুটিকে ঘিরেও আমাদের সম্পর্কের নামে সর্বদা সন্দেহের পাঁচিল তুলে রাখতে হয়। কোনও সম্পর্কের কি এটাই গভীর ট্রাজেডি নয়?
আসলে সমাজ যৌনতার সঙ্গে নারীকে লগ্ন করেই যাবতীয় বৈধতা দিয়ে এসেছে বরাবর। তাই মহাভারতে দ্যূতসভায় সর্বসমক্ষে দ্রৌপদীকে ঊরু প্রদর্শন করে দুর্যোধন যে কুৎসিত যৌন ইঙ্গিত করেছিল, দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণের যে অভাবনীয় স্পর্ধা দেখাতে পেরেছিল দুঃশাসন সকল বিশুদ্ধ জ্ঞানীজন, বয়োজ্যেষ্ঠ গুণিজন নীরব দর্শক ছিলেন সে দিনও। কারণ, চিরটা কাল মেয়েদেরকে মনে করা হয়েছে যৌনতার প্রতিরূপ। রামায়ণে সীতার অগ্নিপরীক্ষার মধ্যে নিহিত ছিল তার সতীত্বের প্রতি কদর্য সন্দেহ, সীতার নির্বাধ অশ্রুজলে কি প্রশ্ন উঠে আসেনি যে রাম-লক্ষ্মণের সঙ্গে রাবণের বিরোধের সমস্ত জের কেন সীতাকে বইতে হয়েছিল? রাজবধূদেরই যখন এই দশা, তা হলে সাধারণ মেয়েরা দাঁড়ায় কোথায়? আসলে মেয়ে ও ধর্ষণ, নারীর সঙ্গে নারকীয়তা, কন্যা-জায়া-জননী আর যৌনতা পরস্পরের বিকল্প শব্দ হিসেবে মেনে নেবার সেই ট্র্যাডিশন আজও চলেছে। তাই বিগত কয়েকদিনের ঘটনায় পরপর পত্রিকার শিরোনামে উঠে আসে পার্ক স্ট্রিট, বরাহনগর, কাটোয়া, বাঁকুড়া। ভেতরের পৃষ্ঠায় থাকে একাধিক মর্মান্তিক ধর্ষণের ঘটনা। এই ভয়ানক সামাজিক প্রবণতার দহনে ক্ষয়ে যেতে থাকে আমাদের বাইরের সব শক্তি, ভেতরের সঞ্চিত সব অঙ্গীকার কুঁকড়ে যেতে থাকি আমরা, মেয়েরা। মহিলা ধর্ষণের অভিযোগ দায়ের করলে তার কথার যাবতীয় সত্যতা প্রমাণের দায় একমাত্র মহিলারই ওপর বর্তায় (যদিও সুপ্রিম কোর্টের অবস্থান এর বিপরীত বিন্দুতে), কত সহজে কেবল মহিলাটিকেই ‘বাজে’ ‘খারাপ’ ‘নষ্ট’ বিশেষণে দেগে দেওয়া যায়!
ষড় রিপুর মধ্যে অন্য কোনও রিপুর চরিতার্থতা নারীকে যৌন আক্রমণের মতো এমন সহজসাধ্য উপায়ে মেলে না বলে ধর্ষকের চরমতম অপরাধও কত অনায়াসে রূপান্তরিত হয়ে যায় কেবল মাত্র ধর্ষিতার লজ্জায়। সমাজের এই দুঃসহ প্রশ্রয় পুষ্টতর হয়ে ওঠে মাননীয় মুখ্যমন্ত্রী বা আমাদের পুলিশ কমিশনারের হঠকারী মন্তব্যে। সমাজের নিরাবরণ চেহারাটা আরও প্রকট ও মারাত্মক হয়ে ওঠে, যখন শুনি মহিলা কমিশনের সর্বভারতীয় চেয়ারপার্সন মেয়েদের প্রতি ‘সেক্সি’ শব্দটি ব্যবহার করার জাস্টিফিকেশন এবং তার সৌন্দর্যসন্ধানে তৎপর হন যৌনতার সঙ্গে রমণীকে লীন করে দেবার আক্ষরিক এই প্রয়াস আমাদের স্তব্ধ করে দেয়। সেই পুরাকালে মুনি-ঋষিদের যৌনতার সুড়সুড়ি দিয়ে তপোভঙ্গ থেকে শুরু করে আজকের টিভির পর্দায় মদের বিজ্ঞাপন পর্যন্ত সর্বত্রই মেয়েদেরকে যৌনতার ভাষ্য হিসেবে ব্যবহৃত হতে দেখছি।
পুরুষতান্ত্রিক বিধানে যৌনতার অনুষঙ্গকে বহন করে চলার আবহমানকালীন অভ্যাস মেয়েদের মেনে নিতে হয়েছে বলে নিজস্ব এক সন্ত্রাসের জগতে বাঁচাটাই হয়ে দাঁড়িয়েছে তাদের অনিবার্য নিয়তি। সে জগতে অবিশ্বাস-ধস্ত আমি, পুরুষের প্রতিপক্ষে একা নারী, আমার মন সেখানে অস্বীকৃত-উপেক্ষিত, কেবল আছে আমার শরীরটুকু আর তাকে ঘিরে আদিমতার উল্লাস। ভোগের সেই উৎসবে শামিল শত-সহস্র-লক্ষ জন। নইলে ব্যক্তিগত শারীর লালসা থেকে পারিবারিক বিবাদের আক্রোশ পর্যন্ত যে-কোনও কারণেরই সহজ শিকার নারী, প্রতিশোধস্পৃহার সহজ নিবৃত্তি ধর্ষণ কেন? এই হিংস্রতার অনালোচিত বৃত্তে ধরা দিতে হয় কখনও নাইট ক্লাবে গমনোদ্যত সপ্রতিভ রমণীকে, কাটোয়া লোকালের যাত্রী নিরীহ গৃহবধূকে, হতদরিদ্র কাগজকুড়ুনিকে। আবার কখনও আট-নয় বছরের স্কুল ছাত্রীকে, মূক-বধির তরুণীকে, এমনকী দুই-তিন বছরের শিশুকন্যাকেও, কারও নিস্তার নেই। শুরুর যেমন অন্য এক শুরু থাকে, সব শেষের থাকে অন্য কোনও শেষ।
ধর্ষণের পরেও থাকে আর এক রকম ধর্ষণ। তাই পুরুষের সঙ্গে সমান আগ্রহে যে মহিলারাও ধর্ষিতার পেশা, জীবনযাত্রা, বিবাহজনিত সুলুকসন্ধান করেন এবং শেষ পর্যন্ত নারীটিকে অভিযুক্ত সাব্যস্ত করে মহাস্বস্তির কাঙ্ক্ষিত শ্বাস ফেলেন তাঁরা যে আসলে পুরুষতন্ত্রেরই মুখ, পিতৃশাসনেরই স্বর, এ কথা বুঝি নিজেরাও বোঝেন না। মনে পড়ে যায় ‘আদালত ও একটি মেয়ে’ অথবা ‘দহন’-এর যন্ত্রণাময় দৃশ্যগুলো। একবার ধর্ষণের পর প্রতিদিনের ধর্ষণ কী ভাবে মেয়েদের জীবন তছনছ করে দেয়, কত সহজে বেদনার দীর্ণতায় ভরে দিতে পারে মেয়েদের অস্তিত্বকে। চূড়ান্ত অবমাননা ও রুদ্ধশ্বাস ক্লেশ বিচিত্র কৌশলে যেখানে নারীকে সইতে বাধ্য করা হয়, সেখানে শোষণ আর যৌনতা মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। তাই গ্রামীণ মোড়লের নির্দেশে নারীকে বিবস্ত্র করে গ্রামে ঘোরানো যায়, ডাইনি সন্দেহে হত্যাও করা যায়। জঙ্গলমহলের সাহাসিনী শোভা মাণ্ডির ডায়েরিও যখন ডুকরে উঠে বলে যে, আন্দোলনের আগ্নেয় পথে হাঁটতে হাঁটতে রাতের আঁধারে পুরুষ সহকর্মীর কামনার কাছে আত্মসমর্পণ করা ছাড়া কোনও বিকল্প থাকে না, তখন দু’মুঠোয় শূন্যতাকেই কেবল আঁকড়ে ধরি আমরা।
নারীর যৌনতাকে ব্যবহার করার সমাজসিদ্ধ অন্য একটি প্রসঙ্গের অবতারণা বোধ হয় বাহুল্য হবে না। আমাদের বাক্বিন্যাসে যত ধরনের গালাগালি প্রচলিত তার সিংহভাগের সঙ্গেই জড়ানো আছে নারীর যৌনতা। পুরুষের যে কোনও মাত্রার ক্ষোভ-ক্রোধ-জ্বালা প্রকাশে মেয়েদেরকে এমন কদর্য ভাবে যুক্ত করে তোলার দিকটিও সেই পিতৃতান্ত্রিক দমনেরই ভিন্নতর প্রতিচ্ছবি। দু’বর্ণের ক্রিয়াযোগে বা অমুকের ছেলে ইত্যাদি অশ্রাব্য শব্দাবলি বাদ দিয়ে ‘অপেক্ষাকৃত নির্মল’ একটি গালি ‘শালা’র অর্থগত বিশ্লেষণ করলে দেখব এখানে বক্তা উদ্দিষ্ট ব্যক্তির দিদি বা বোনের সঙ্গে নিজের যৌন সম্পর্কের ইঙ্গিত সূচিত করছে।
এত বেদনার পরম্পরা আমরা কোন উত্তরাধিকারে পেয়েছি জানতে মন চায়। তবে হ্যাঁ, মানবাধিকার কর্মীরা শুনলে প্রীত হবেন নখের বদলে নখ কিংবা ফাঁসির নির্মমতা আমরা ধর্ষকের জন্য চাই না, সে বড় পুরনো প্রস্তাব। আমাদের নতুন পথের দিশা দেখিয়েছেন সাম্প্রতিক দুই ধর্ষণ কাণ্ডের অন্তরালে থাকা অন্য দু’জন নারী। পার্ক স্ট্রিট ঘটনায় নির্যাতিত মহিলার সুশিক্ষিতা পিতামহী, যিনি নাতনিকে সারাক্ষণ মনোবল জুগিয়ে পাশে থেকেছেন, আর কাটোয়া ঘটনায় সুদূর বর্ধমানের প্রত্যন্ত কেতুগ্রামের বৃদ্ধা শাশুড়ি প্রত্যয়ী উচ্চারণে পুত্রবধূর সম্পর্কে ছেলেদের স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন ‘সে কোনও অন্যায় করেনি। তাকে আগলে রাখার দায়িত্ব আমাদেরই।’ পুরনো প্রজন্মের হাত ধরেই নারীর বাঁচার জগতে বিপ্লব আসুক, এমন ভাবেই সুচেতন ক্লীব সমাজের জাগরণ ঘটুক। আমরা মেয়েরাই সামলে রাখব মেয়েদের, ধর্ষণ আর পাঁচটা অঘটনের মতোই একটা অঘটন মাত্র। জীবনে গুরুত্ব দেওয়ার মতো অন্য অনেক বড় ঘটনা থাকবে, ধর্ষণ নয়।
মনে করতে চাইছি ২০০৪ সালে মনোরমার ওপর মণিপুর রাইফেলস-এর অত্যাচারের বিরুদ্ধে মণিপুরের বীরাঙ্গনা মায়েরা নগ্নতায় তাদের প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন ‘Indian Army Rape Us’, সবাই হতচকিত হয়েছিল। শরীরী নিগ্রহে আর কোনও শঙ্কা নেই আমাদের, উলঙ্গতায় নেই কোনও সংকোচ। মহাভারতে সে দিনের যাজ্ঞসেনীর যন্ত্রণার বর্ণমালা আজকের যমুনাবতীদের বুকের বারুদ হয়ে ঝরে পড়ছে। তাই দোপ্দি মেঝেনের মতো আজকের দ্রৌপদীরা সমাজের আপাত-সাদা জামায় থুতু ফেলে বলবে ‘হেতা কেউ পুরুষ নাই যে লাজ করব। কাপড় মোরে পরাতে দিব না। আর কী করবি?’
কাপুরুষ সমাজ, সেই ‘ভীষণ ভয়’-এর দিনটি তোমার দোরগোড়ায়।

লেখক সাউথ ক্যালকাটা গার্লস কলেজে বাংলার শিক্ষক


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.