শহর তথা রাজ্যের সর্বত্র বিশাল মূর্তিগুলি অক্ষত রাখার আশ্বাস দিয়েছেন সপা নেতৃত্ব। মায়াবতীর মূর্তিগুলি হয়তো থাকবে, তবে তা ধুলোয় মলিন হয়েই। আজ সকালে রাজ্যপালের কাছে পদত্যাগপত্র জমা দিয়ে যে মায়াবতী তাঁর সুবিশাল অথচ জনশূন্য ‘জলসাঘরে’ এসে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হলেন, তিনি অনেকটাই নিষ্প্রভ।
ঠিক পাঁচ বছর আগে তাঁর জয়ের দিন এই শহরেই দেখেছিলাম এক অন্য মায়াবতীকে। চার দিকে প্রখর আত্মবিশ্বাসের দ্যুতি যেন ঠিকরে পড়ছিল তাঁর নাকছাবির মতই। আর আজ শুধুই দোষারোপ আর সাফাইয়ে নিজেকে আড়াল করা। কখনও বলছেন, “কোনও সহযোগিতা পাইনি কেন্দ্রের কাছে।” আবার কখনও আফশোস, “যে দলের হাতে ক্ষমতা গেল, তারা কয়েক বছর পিছিয়ে দেবে রাজ্যটাকে, এটাই দুঃখ।” আবার সরাসরি সংবাদমাধ্যমের উপরেও খড়্গহস্ত হয়ে বলছেন, “আপনাদের জন্যই মানুষ ভুল বুঝেছে।.....একটি দলিত ভোটও আমার বিরুদ্ধে যায়নি। গেলে আমি দ্বিতীয় স্থান পেতাম না। বিহারে লালুপ্রসাদের যে হাল হয়েছে, আমারও তাই হতে পারত।”
লখনউয়ের মানুষের অবশ্য এ সব শোনার মন নেই। অন্তত আজ। সপা’র সদর দফতরের বিশাল মেলার পরিবেশটি বাদই দিন। হজরতগঞ্জ থেকে লালবাগ, উদয়গঞ্জ থেকে মোতিবাগ--- সর্বত্রই যেন নতুন নায়ককে স্বাগত জানানোর প্রস্তুতি। সে নায়কের নাম অখিলেশ সিংহ যাদব। তাঁকে ঘিরে কৌতূহল, উচ্ছ্বাস, বিস্ময়। আর কিছু না হোক, প্রায় তাঁরই সমবয়সী রাহুল গাঁধীকে যে তিনি উত্তরপ্রদেশের ভবিষ্যৎ রাজনীতিতে এখনই দশ গোল দিয়ে রাখলেন, তা এক দিকে শহুরে মধ্যবিত্ত অন্য দিকে গ্রামের দরিদ্র মানুষ দু’তরফের কথা থেকেই স্পষ্ট। অনেকেই গ্রাম থেকে এসে দলীয় অফিসে হত্যে দিয়ে পড়ে রয়েছেন এক বার অখিলেশকে দেখার জন্য। লখনউয়ে একটি ছোটখাটো শাড়ির দোকান চালান বিমলেশ যাদব। বলছেন, “রাহুল গাঁধী উপরের তলার রাজনীতি করা লোক। কোন খেতে, কোন সময়ে কী ফসল হয় উনি জানেন? কী ভাবে এখানে মহাজনেরা মানুষ ঠকায়, তা ধরতে পারবেন উনি? শুধুমাত্র এক দিন চাষির বাড়িতে রাত কাটালে বা তাদের খাবার খেলেই কি আর সহমর্মী হওয়া যায়?” একই ভাবে বহেনজির প্রতিও সমান বিরাগ তাঁর। বলছেন, “দলিত কে? যার অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থানের ঠিক নেই। মায়াবতী তো রাজ্যের সব চেয়ে ধনী মানুষ। বিদেশ থেকে ওঁর জন্য মেক-আপ আসে, জুতো আসে। উনি দলিত?” |
অখিলেশ-মুলায়মের পোস্টার, টি-শার্ট, ফেস্টুন, উত্তরীয়, স্টিকার, সাইকেলের (সমাজবাদী পাটির প্রতীক চিহ্ন) মডেল--- এই সমস্ত নিয়ে অসংখ্য দোকান বসে গিয়েছে বিক্রমাদিত্য মার্গের দু’দিকে। প্রত্যেকটিই জমজমাট। আজমগড় থেকে আসা বৃদ্ধ যোগীন্দ্র যাদব বলছেন, “হেলিকপ্টার থেকে নেমে অখিলেশ যখন এগিয়ে আসতেন, মনে হত অল্প বয়সের মুলায়মকে দেখছি। রাহুল গাঁধীকে দেখেছি দূর থেকে হাত নেড়ে চলে গিয়েছেন। কিন্তু অখিলেশ ভাই আমাদের সঙ্গে থেকেছেন, গোটা বছর খোঁজ-খবর রেখেছেন।” মায়াবতীর দল বিগত শাসনকালে অজস্র ভুয়ো মামলা সাজিয়ে গিয়েছেন বলেও অভিযোগ এখানকার আনাচে কানাচে। মুখচলতি নানা রকম গল্প। যেমন একটি শোনালেন স্থানীয় তাঁবু-ব্যবসায়ী রফি শাহমত। তাঁর কথায়, “আমার দোকানের পাশেই একটি চা-ওয়ালাকে মারধোর করছিল কিছু যুবক। বেচারির অপরাধ, চায়ের দাম চেয়েছিল। যুবকদের বক্তব্য ছিল, তারাই সরকার চালায়, সামান্য চা-ও কিনে খেতে হবে! প্রতিবাদ করতে যাই, হেনস্থা হতে হয়। তার পর আমার নামে সাজানো মামলাও ঠুকে দেওয়া হয়। এখনও টানতে হচ্ছে যে মামলা।” সপা দফতরের সামনে দাঁড়িয়ে তাঁর সঙ্গে কথা বলছিলাম। কথা বন্ধ হয়ে গেল। কেন না দেড় মানুষ সমান কেক নিয়ে মিছিল করে আসছেন মানুষ! সে কেকের উপরে সাইকেল আঁকা ।
এরই ঠিক বিপরীত ছবি রাজ্যের বাকি তিনটি বড় দল বসপা, কংগ্রেস ও বিজেপি-র দফতরে। জনশূন্য অফিসঘরে রীতা বহুগুনা জোশী বসে টিভিতে তাঁর নেত্রী সনিয়া গাঁধীর সাক্ষাৎকার দেখছেন। নিজে জিতেছেন, বোধহয় সে কারণেই সামনে লাড্ডুর বাক্স রাখা। কিন্তু খাবার লোক নেই। স্বীকার করে নিলেন, “আমরা কিছুটা বিভ্রান্ত।” কেন এমন ফল হল? “আমাদের ভোটের শতকরা হার অবশ্য বেড়েছে, কিন্তু....।” এই কিন্তু-র কোনও ব্যাখ্যা আপাতত কংগ্রেসের কাছে নেই। বিজেপির মুখপাত্র নরেন্দ্র সিংহ রামা (ভরদুপুরে বিজেপির বিশাল সদর দফতরে একমাত্র তিনিই বসে দুর্গ আগলে) অবশ্য স্পষ্টই জানাচ্ছেন, ‘পিছড়ে বর্গ’-এর তোষণ করতে গিয়ে উচ্চবর্ণের ভোটব্যাঙ্ক হাতছাড়া হয়েছে। সেই জন্যই দলের এই হাল।
আফশোস, দীর্ঘশ্বাস, আত্মবিশ্লেষণ এক দিকে। অন্য দিকে ফলাফলের চব্বিশ ঘণ্টা পর সমাজবাদী পার্টির তরুণ তুর্কি নেতার উপর মানুষের প্রবল প্রত্যাশার চাপ। এই দুইয়ের মাঝখানেই ধক ধক করছে লখনউ তথা গোটা উত্তরপ্রদেশের রাজনৈতিক হৃদ্স্পন্দন। |