প্রতিপক্ষ প্রবল ভাবে ধরাশায়ী। কিন্তু এর পর যে প্রশ্নটিকে কেন্দ্র করে আজ উত্তরপ্রদেশের রাজধানী আবর্তিত হল, সেটা হচ্ছে, লখনউয়ের তখতে কে, পিতা না পুত্র? মুলায়ম সিংহ যাদব না অখিলেশ? এবং দিনের শেষে মোটামুটি ঠিক, মুলায়ম সিংহই চতুর্থ বারের জন্য উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী হতে চলেছেন। তবে অখিলেশ যাদবকে ওই পদে দেখতে চেয়েও আজ বিরাট দাবি তৈরি হয়েছে সমাজবাদী পার্টির ভিতরে। সমাজবাদী পার্টি সূত্রে খবর, এখনই না হলেও আর দু’-এক বছরের মধ্যে অসুস্থ মুলায়মের জায়গায় অখিলেশকে নিয়ে আসা হতে পারে। আর সেটা হতে পারে ২০১৪-র সাধারণ নির্বাচনের আগেই।
উত্তরপ্রদেশের বিধানসভা নির্বাচনে সমাজবাদী পার্টির এই বিশাল জয়ের পর চব্বিশ ঘণ্টাও অতিক্রান্ত হয়নি। কিন্তু আনন্দে গা ভাসানো দূরে, রাজ্যজুড়ে ‘গণউন্মাদনা’ সম্পর্কে সম্পূর্ণ উদাসীন থেকে সমাজবাদী পার্টির শীর্ষ নেতারা (মুলায়ম এবং অখিলেশ-সহ) বিক্রমাদিত্য মার্গের দলীয় অফিসে ডুবে রইলেন রুদ্ধদ্বার বৈঠকে। সেই বৈঠক শেষে প্রথামাফিক রাজ্যপালের কাছে গিয়ে সরকার গঠনের দাবি করেছেন মুলায়ম। সঙ্গী ছিলেন অখিলেশ। আজ কিন্তু মুখ্যমন্ত্রীর নাম ঘোষণা হল না। রাজ্যপালকে জানানো হয়েছে, হোলির পর ফের বসবে বিধায়কদের বৈঠক। তার পর ঘোষণা করা হবে ভাবী মুখ্যমন্ত্রীর নাম। শপথগ্রহণের সম্ভাব্য তারিখ ১২ মার্চ।
দলীয় সূত্র জানাচ্ছে, আজকের বৈঠক শেষে আপাতত স্থির হয়েছে, মুখ্যমন্ত্রী মুলায়মই হবেন। অখিলেশ নিজেও আজ বৈঠকের পর এ কথা জানিয়েছেন। কিন্তু সমস্ত বিধায়কের সঙ্গে আলোচনা করার পরই এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত ঘোষণা করতে চাইছেন সপা নেতৃত্ব। কেন না, সমাজবাদী শিবির আজ দিনভর উত্তাল থেকেছে অখিলেশকে মুখ্যমন্ত্রী করার দাবিতে। দলের একটি বড় অংশের বক্তব্য, অখিলেশকে সামনে রেখেই এই বিরাট জয় এসেছে। তিনি প্রতিটি জেলায় গিয়ে মায়াবতীর ‘অপশাসনের’ বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছেন, এমনকী জেলেও গিয়েছেন। রাজ্যের যুব সমাজকে ঐক্যবদ্ধ করার প্রশ্নে অখিলেশ অনেক দূরে ছিটকে দিয়েছেন নেহরু-গাঁধী পরিবারের নতুন প্রজন্মকে। তাই দলের তরুণ প্রজন্ম এবং পুরনো সমাজবাদী নেতাদের একটি অংশ (যাঁদের মধ্যে রয়েছেন জ্ঞানেশ্বর মিশ্রের মতো প্রবীণ নেতাও) চাইছেন, অখিলেশই আসুন নেতৃত্বে। নতুন রক্ত সঞ্চারিত হোক উত্তরপ্রদেশের প্রশাসনে। |
অখিলেশ-পন্থীরা আরও বলছেন, অখিলেশ বয়সে রাহুলের থেকে কিছুটা ছোটই। কিন্তু তাঁর ভাবমূর্তি এখন আকাশ-ছোঁয়া। তাঁকে যদি এখনই মুখ্যমন্ত্রী করা হয়, তা হলে ‘তারুণ্যের প্রতিযোগিতায়’ অন্তত উত্তরপ্রদেশে রাহুলকে আর অদূর ভবিষ্যতে মাথা তুলে দাঁড়াতে হবে না। তা ছাড়া দলীয় সূত্রে খবর, অখিলেশকে তখ্তে বসাতে কর্পোরেটেরও একাংশের চাপ ছিল। তবে শেষ পর্যন্ত যে পাল্টা যুক্তিটি সকলে মেনে নিয়েছেন, তা হল আগামী দু’বছর মুলায়মই মুখ্যমন্ত্রী থাকুন। এর মধ্যে তাঁর অভিজ্ঞতা, রাজনৈতিক বুদ্ধি, প্রশাসনিক কৌশল আয়ত্ত করে নিন পুত্র। তার পর, ২০১৪ সালে লোকসভা নির্বাচনের আগে অখিলেশের হাতে রাজ্যের দায়িত্ব সঁপে তৃতীয় ফ্রন্ট গড়ার দায়িত্ব নিয়ে নয়াদিল্লি চলে যাবেন মুলায়ম। তবে এই মুহূর্তে অযথা তাড়াহুড়ো না করে সকলের বক্তব্য শুনে তার পর এ ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত ঘোষণা করতে চাইছেন সপা নেতৃত্ব। এর ফলে যাতে কোনও ভুল বার্তা মানুষের কাছে না যায়, অথবা অভ্যন্তরীণ মতবিরোধের ক্ষেত্র না তৈরি হয়, সে কথাও মাথায় রাখা হচ্ছে।
আজ সপা’র বৈঠকেও সব দিক থেকেই সতর্ক থাকার বিষয়ে জোর দিয়েছেন অখিলেশ। তাঁর কথায়, যে ভুলগুলির জন্য আজ আমজনতা মায়াবতীকে ক্ষমতাচ্যুত করেছে, তার পুনরাবৃত্তি যেন না হয়। অর্থাৎ, বদলি এবং চাকরি দেওয়ার প্রশ্নে আমলাদের উপর চাপ সৃষ্টি করা, গুন্ডাগিরি, বাহুবলীদের দাপট (পাঁচ বছর আগে এই সব বিষয় নিয়ে তাঁদের বিরুদ্ধেও যে গণক্ষোভ তৈরি হয়েছিল, তা ঘরোয়া ভাবে স্বীকার করছেন সপা নেতৃত্ব), এ সব আর চলবে না। আনতে হবে নতুন রাজনৈতিক সংস্কৃতি।
তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে, বিজয়ী শিবিরে যখন ভবিষ্যৎ রাজনীতি নিয়ে মন্থন চলছে, তখন বিএসপি সদর দফতরে বসে মায়াবতী সাংবাদিক সম্মেলন করে জানিয়ে দিলেন, অপশাসন বা দুর্নীতি নয়, শুধুমাত্র রাজনৈতিক মেরুকরণের কারণেই হেরে গিয়েছে তাঁর দল। তিনি নিজে বা তাঁর দলের নেতা-মন্ত্রীদের বিরুদ্ধে ক্ষোভ নয়, কংগ্রেস এবং বিজেপির ‘ভ্রান্ত রাজনৈতিক অবস্থানের’ খেসারত দিতে হয়েছে তাঁর দলকে। একই সঙ্গে তিনি এই আশঙ্কাও প্রকাশ করেছেন যে, তাঁর শুরু করা সমস্ত ‘সংস্কার প্রকল্প’ হিমঘরে ঢুকিয়ে দেবে মুলায়মের সরকার। তাঁর সরকারের ‘অপদার্থতা’ এবং ‘দুর্নীতি’ নিয়ে যাবতীয় প্রশ্ন স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে উড়িয়ে দিয়ে মায়াবতী জাতপাতের সমীকরণকেই এই বিপুল বিপর্যয়ের পর ঢাল হিসেবে ব্যবহার করেছেন। তাঁর কথায়, “নিজেদের রাজনৈতিক স্বার্থ চরিতার্থ করতে গিয়ে পিছড়ে বর্গ এবং অনগ্রসর শ্রেণির ভিতরে সংখ্যালঘু সংরক্ষণের তাস খেলেছে কংগ্রেস। তার ফলে বিজেপি-ও পাল্টা মেরুকরণ করতে চেয়ে হিন্দু অনগ্রসর শ্রেণিকে নিজের দিকে টানার চেষ্টা করেছে।” মায়ার মতে, “এতে উচ্চবর্ণের মানুষ ঘাবড়ে গিয়েছেন। সংখ্যালঘুরা কংগ্রেসের উপর ভরসা না রাখতে পেরে সপা-র দিকে চলে গিয়েছে। আবার উচ্চবর্ণের ভোটও বিজেপি থেকে ভাগ হয়ে গিয়েছে সব দলে। ফলে সপা-ই লাভবান হয়েছে।” শুধু তাই নয়, মায়াবতী দাবি করেছেন, উচ্চবর্ণ বা সংখ্যালঘু ভোট ভাগ হলেও তাঁর দলিত ভোটব্যাঙ্কে হাত দিতে পারেননি মুলায়ম।
জাতপাতের এই জটিল সমীকরণ তুলে ধরে মায়াবতী নিজের কথা না-রাখা এবং দুর্নীতির বিষয়টিকে লুকোতে চাইছেন বলে মনে করেছে সপা। দলের অন্যতম নেতা আজম খান বলেছেন, হেরে গিয়ে মায়াবতী নিছকই রাজনীতি করছেন। অন্য দিকে, উত্তরপ্রদেশে কংগ্রেসের অন্যতম নেত্রী রীতা বহুগুনা জোশীর কথায়, “ভোটের মেরুকরণ তো মায়াবতী নিজে কিছু কম করেননি। তা হলে আজ এই অভিযোগ তুলছেন কেন?” |