ইংরেজ ক্রিকেট-লিখিয়ে শিল্ড বেরি এক বার লিখেছিলেন, “তাঁর মাঠে ঢোকাটা দেখে মনে হত এক জন সম্রাট তাঁর সাম্রাজ্যে ঢুকছেন। বিশ্বে এমন কোনও কোরিওগ্রাফার নেই যে সমস্ত রকম আলো এবং শব্দের ছটায় কোনও নায়কের এর চেয়ে ভাল প্রবেশ-দৃশ্য দেখাতে পারবে।”
সেই উন্নত শির। শক্ত চোয়াল চুইংগাম চিবিয়ে যাচ্ছে। প্রতিপক্ষের দিকে চরম ঔদ্ধত্যপূর্ণ চাহনি। আজকের মহাতারকাদের মতো হেলমেট নয়। মাথায় মেরুন রঙের টুপি। আজীবন। হেলমেট মানে যে আগে থেকেই ভয় পেয়ে যাওয়া। তা হলে তুমি আর কীসের বীর? ডান হাতে ধরা স্ল্যাজেঞ্জার ব্যাট। যা দিয়ে তিনি দুনিয়া শাসন করে গিয়েছেন।
তিনি মানে স্যর আইজ্যাক ভিভিয়ান আলেকজান্ডার রিচার্ডস। বুধবার যিনি ৬০ হচ্ছেন। আর তাঁর সেই ৬০ বছরের জন্মদিন পূর্তি উৎসব নিয়ে ভেসে যাচ্ছে ওয়েস্ট ইন্ডিজ এবং সারা বিশ্বের ক্রিকেটমহল। অ্যান্টিগায় ধুমধাম করে এক সপ্তাহ ধরে উৎসব চলছে। বুধবার একটা গল্ফ টুর্নামেন্টের আয়োজন হচ্ছে। যেখানে খেলতে আসছেন গ্যারি সোবার্স, রিচার্ড হ্যাডলি, ইয়ান বোথামের মতো মহাতারকারা। রাতে থাকছে স্যর ভিভ ব্যাঙ্কোয়েট। ডিনারে বিশেষ বক্তার নাম? ব্রায়ান চার্লস লারা।
স্তন ক্যান্সার-আক্রান্তদের জন্য টাকা তুলতে ভিভ হাঁটছেন অ্যান্টিগা রিক্রিয়েশন গ্রাউন্ড থেকে স্যর ভিভিয়ান রিচার্ডস ক্রিকেট গ্রাউন্ড পর্যন্ত। কোনও ক্রিকেট ইতিহাসবিদ উপস্থিত থাকলে হয়তো তৎক্ষণাৎ মনে করিয়ে দেবে, অ্যান্টিগা রিক্রিয়েশন গ্রাউন্ড এই সেই মাঠ যেখানে টেস্টের দ্রুততম সেঞ্চুরি করেছিলেন স্যর ভিভিয়ান। বোথাম-ফস্টার-এমবুরিদের বেধড়ক ঠেঙিয়ে ৫৬ বলে করা সেঞ্চুরি। ছাব্বিশ বছর হয়ে গেল। আজও কেউ ভাঙতে পারেনি। কোনও ব্রায়ান লারা নয়। কোনও সচিন তেন্ডুলকর নয়। অ্যাডাম গিলক্রিস্ট শুধু কাছাকাছি এসেছিলেন এক বার। এক বলের জন্য পারেননি।
এ দিন আবার চার্চে বিশেষ অনুষ্ঠান করা হল অ্যান্টিগার দুই সেরা রত্নকে জন্মদিন উপলক্ষে সম্মানিত করার জন্য। ভিভ রিচার্ডস এবং ম্যাকলিন এমানুয়েল। এক জন ক্যালিপসো ক্রিকেটের সম্রাট। অন্য জন ক্যালিপসো সঙ্গীতের। ভিভ বুধবার ৬০ হচ্ছেন। এমানুয়েল সম্প্রতি ৭০ হয়েছেন। অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন অ্যান্টিগার প্রধানমন্ত্রী বল্ডউইন স্পেনসার স্বয়ং। ভিভ সম্পর্কে যিনি বলে গেলেন, অ্যান্টিগার একমাত্র জীবিত মহানায়ক। বললেন, বিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ ক্রিকেটার।
ইতিহাসের দিকে তাকালে বোঝা যাবে, প্রধানমন্ত্রী এতটুকু বাড়িয়ে বলেননি। ভিভের আগমনের আগে অ্যান্টিগা মানে ছিল ক্রিকেটের ব্যাকবেঞ্চার। ভিভ এবং রবার্টস মিলে শুধু অ্যান্টিগাকে চ্যাম্পিয়ন টিমই করেননি, পর্যটকদের কাছে দ্বীপপুঞ্জটাকেই সেরা আকর্ষণ বানিয়ে দিয়েছেন! একা ভিভের ব্যাটের দাপটেই অ্যান্টিগা টেস্ট কেন্দ্রের আখ্যা পায়।
একই জিনিস তিনি ঘটান সমারসেট এবং গ্ল্যামরগানের হয়ে কাউন্টি খেলতে গিয়েও। ভিভ আসার আগে এই দুই কাউন্টিকে ক্রিকেট মাঠে কেউ পাত্তাই দিত না। ট্রফি তো অনেক দূরের ব্যাপার। কিন্তু ভিভের সময় সমারসেট হয়ে ওঠে ক্রিকেটের ম্যাঞ্চেস্টার ইউনাইটেড। পাঁচ মরসুমে পাঁচটা ট্রফি জেতে তারা। তেমনই তিরানব্বইতে জীবনের শেষ প্রতিযোগিতামূলক টুর্নামেন্টে গ্ল্যামরগানকে সানডে লিগ জিতিয়ে তবেই ক্রিকেট থেকে বিদায় নেন।
৬০তম জন্মদিন উৎসবে এ সবেরই স্মৃতিচারণ। আর ভারতীয় ক্রিকেটভক্ত মানেই নানা মণিমুক্তো স্মরণের পাশাপাশি অবধারিত ভাবে থাকবে আঁতকে ওঠা, “কী হত যদি তিরাশির পঁচিশে জুন কপিল দেব ওই দুর্ধর্ষ ক্যাচটা না ধরতেন! লর্ডস ব্যালকনিতে ইতিহাসটাই হয়তো হত না। যে রকম বল্লা চলছিল ভিভের!” জায়েন্ট স্ক্রিনে চলবে বিধ্বংসী সব ইনিংসের ক্লিপিংস।
এ যুগের বোলাররা সে সব দেখতে দেখতে নিজেদের ভাগ্যকেই ধন্যবাদ দেবে “বেঁচে গেছি। স্যর ভিভকে বল করতে হয়নি!”
|