পালাবদলেও উচ্ছ্বাসহীন মুলায়ম মুখ খুললেন না ‘বহেনজি’কে নিয়ে
ঠিক পাঁচ বছর আগে নির্বাচনী ফলাফলের সন্ধ্যায় বহুজন সমাজ পার্টির ‘প্রেরণা কেন্দ্রে’ (পেল্লায় দলিত সৌধ) বসে তীব্র তাচ্ছিল্যের সঙ্গে মুলায়ম সিংহ যাদব সম্পর্কে ‘বহেনজি’ বলেছিলেন, “উত্তরপ্রদেশের মানুষই যাকে মেরে রেখেছেন, তাকে আমি আর কী মারব!”
অলক্ষ্যে মুচকি হেসেছিল ইতিহাস।
আজ লখনউয়ের বিক্রমাদিত্য মার্গে, সপা-র পার্টি অফিসে দু’দিন আগেই হোলি শুরু। বাইরে প্রবল উন্মাদনা। ভিতরে শান্ত ভঙ্গিমায় বসে রয়েছেন ‘পুনরুজ্জীবিত’ মুলায়ম সিংহ যাদব। এই উচ্ছ্বাস যেন তাঁকে বাহ্যত স্পর্শ করছে না। বিজয়ীর উদারতা দেখিয়ে যিনি মায়াবতী সম্পর্কে বলতে পারছেন, “ওঁর সম্পর্কে কখনও তো কিছু বলিনি, তাই আজও বলব না।”
রাজ্য রাজনীতির কেন্দ্রীয় মঞ্চ থেকে বারবার ছিটকে গিয়েও সগৌরবে ফিরে আসার এক অনন্য নজির এর মধ্যেই গড়ে ফেলেছেন ৭২ বছরের এই প্রাক্তন স্কুল শিক্ষক। কেন্দ্রে প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের গুরুদায়িত্ব সামলেছেন। রাজ্যে মুখ্যমন্ত্রিত্বেও হ্যাটট্রিক হয়ে গিয়েছে। চতুর্থ বারের জন্য মুখ্যমন্ত্রী হওয়া শুধু সময়ের অপেক্ষা। এই বিপুল জয়ের পর বিতর্ক শুধু একটি বিষয়েই। তাঁর প্রিয় গোমতী নদীর ধারে লক্ষ্মণমেলাতেই মুলায়ম শপথ নেবেন (২০০৩ সালে তাঁর মুখ্যমন্ত্রিত্বের শপথ অনুষ্ঠানে যেখানে রীতিমতো চাঁদের হাট বসে গিয়েছিল), নাকি প্রথামাফিক রাজভবনে? স্বভাবসিদ্ধ ভাবে এ সব নিয়ে আজ কোনও মন্তব্যই করতে চাইছেন না এই পোড় খাওয়া রাজনীতিক।
দলীয় কার্যালয়ে মুলায়ম সিংহ যাদব। মঙ্গলবার। ছবি: পিটিআই।
উত্তরপ্রদেশের মানুষকে ধন্যবাদ জানিয়ে বলেছেন, “যে আশা নিয়ে মানুষ আমাদের ভোট দিয়েছেন, তা রাখার চেষ্টা করা হবে।” মুখ্যমন্ত্রিত্বের প্রশ্নে শুধু বলছেন, “কে মুখ্যমন্ত্রী হবেন, তা স্থির করা হবে পরিষদীয় দলের বৈঠকে। এখনও এ নিয়ে কোনও ভাবনাচিন্তা হয়নি।”
কিন্তু এহ বাহ্য। আজ সকালে দেওয়াল লিখন স্পষ্ট হতে না হতেই পুত্র এবং সদ্যসমাপ্ত ভোটযুদ্ধে মুলায়ম সিংহের প্রধান সেনাপতি অখিলেশ যাদব হাসিমুখে যা জানানোর জানিয়ে দিয়েছেন। জানিয়েছেন, তিনি নন, অন্য কেউ নয়, মুখ্যমন্ত্রী হবেন ‘নেতাজি’ই। কারণ, সেটাই যে চাইছেন রাজ্যের মানুষ!
প্রাক্তন কুস্তিগীর, হনুমানভক্ত, গ্রামের স্কুল শিক্ষকের এই সাদামাটা প্রেক্ষাপট থেকে ক্ষমতার শীর্ষে উত্থানের পিছনে একাধিক কারণ কাজ করেছে বলেই মনে করছে রাজনৈতিক শিবির। উত্তরপ্রদেশে তো বটেই, দিল্লির সংশ্লিষ্ট মহলেরও বক্তব্য, ক্ষমতায় আসার পর মায়াবতী ক্রমশ দলিত সমাজ থেকে দূরে সরে গিয়েছেন। নিজের দেওয়া প্রতিশ্রুতির জমিতে শুধুমাত্র তৈরি হয়েছে একের পর এক ‘মায়া-প্রাসাদ’। কমেনি দারিদ্র। যে ‘সোশ্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং’-এর মন্ত্র কাজে লাগিয়ে ২০০৭-এ ক্ষমতায় এসেছিলেন অম্বেডকর-কাঁসিরামের রাজনৈতিক উত্তরসূরি, তা কালক্রমে ফিকে হয়ে গিয়েছে বলে অভিযোগও গত এক বছর ধরে উঠে এসেছে। ‘জিসকে জিতনি ভাগীদারি, উনকে উতনা হিস্সেদারি’ ক্ষমতায় আসার আগে এই স্লোগান দিয়েছিলেন বহেনজি। কিন্তু ভোটের কিছু দিন আগেই বারাণসী বা ইলাহাবাদের প্রয়াগ থেকে ব্রাহ্মণকূলের অভিযোগ ক্রমশ উচ্চস্বরে উঠেছে যে, কোনও প্রতিশ্রুতিই পালন করেনি বিএসপি সরকার। সিদ্ধান্তগ্রহণেও উচ্চবর্ণের ভূমিকা কোথাও রাখা হয়নি।
অন্য দিকে, বরফের মতো ঠান্ডা মাথা এবং বিপুল অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে জাতপাত নির্বিশেষে (মুসলিম-যাদব তো বটেই, সেই সঙ্গে উচ্চবর্ণ এবং পিছড়ে বর্গের বহু মানুষও যে বহেনজিকে ছেড়ে মুলায়মের পাশে দাঁড়িয়েছেন, তা ফলাফলেই প্রমাণিত) মানুষের কাছে পৌঁছনোর চেষ্টা করে গিয়েছেন মুলায়ম। পিতা-পুত্র দু’জনেই নিজেদের স্বর কখনও চড়তে দেননি। সংবাদমাধ্যমে বিবৃতি দেওয়া থেকে বিরত থেকেছেন। এমনকী, এক সময়ের ছায়াসঙ্গী অমর সিংহও যখন আক্রমণাত্মক ভাবে বলেছেন, ‘ভোটের ফল বার হলে মুলায়ম বুঝতে পারবেন তাঁকে ব্রাত্য করে সপা’র কত ক্ষতি হল,’ কোনও প্রতিক্রিয়াই জানাননি তিনি। সংবাদমাধ্যমের বুথ ফেরত সমীক্ষা তাঁকে কিছুটা এগিয়ে রাখার পরেও সংযম রক্ষা করে শুধু বলেছিলেন, “আমার দলের জন্য সমাজের সব শ্রেণির সমর্থন রয়েছে।”
‘সব শ্রেণির’ সমর্থনের জন্য লড়াইয়ের পাশাপাশি কংগ্রেস-সহ সমস্ত ধর্মনিরপেক্ষ দলের সঙ্গে কার্যকরী সম্পর্ক রেখে গিয়েছেন মুলায়ম। বারবার জোটবার্তা পাঠিয়েছেন। অথচ এই জোটবার্তাকেই তাঁর দুর্বলতা ভেবে রাজনীতির দাবা খেলায় মারাত্মক ভুল করেছে রাহুল ব্রিগেড। দিন কুড়ি আগে মুলায়মের প্রস্তাব নস্যাৎ করে দিয়ে কংগ্রেস মুখপাত্র রেণুকা চৌধুরি বলেছিলেন, “সপা নেতার বক্তব্য থেকেই স্পষ্ট, একক ভাবে সরকার গড়ার আত্মবিশ্বাস নেই মুলায়মের।” সপা সূত্রের বক্তব্য, আত্মবিশ্বাস নিজের আস্তিনে লুকিয়ে রেখেছিলেন মুলায়ম, ‘যথাসময়ে’ দেখাবেন বলে।
এ বার সেই সময় এসেছে। পাঁচ বছর আগে বিধানসভা ভোটের ফল প্রকাশের দিন লখনউতে এসে দেখেছিলাম, শহর জুড়ে নীল (মায়াবতীর পতাকার রং) আবিরের ছড়াছড়ি। সঙ্গে ‘পাঁচ হাজারওয়ালা’ পটকার উল্লাস। আর আজ মায়াবতীর মল অ্যাভিনিউয়ের প্রাসাদোপম বাড়িতে শ্মশানের নিস্তব্ধতা। এরই বিপরীত চিত্র সপা দফতরে। আকাশ ফাটানো চিৎকার, ‘জিসকা জলওয়া কায়েম হ্যায়/ উসকা নাম মুলায়ম হ্যায়’। আইনজীবিদের দল, মহিলা, হোর্ডিং হাতে প্রমীলা বাহিনী, নির্ভেজাল পথচারী, এমনকী হুইলচেয়ারে বসা মানুষও দলে দলে এসেছেন ‘নেতাজি’কে দেখতে। পালাবদলের জন্য তৈরি হচ্ছে প্রশাসনও। বিএসপি ক্ষমতায় আসার পর থেকে গত পাঁচ বছর অনাদরে বেহাল হয়ে পড়েছিল গোমতীনগরের লোহিয়া পার্ক। হাওয়া বদলের আন্দাজ পেয়ে, আজ দুপুর থেকেই লখনউ ডেভেলপমেন্ট অথরিটি তাকে সাজাতে শুরু করেছে।
পালাবদলের পালা শেষ। এ বার আগামী পাঁচ বছরের জন্য তৈরি হচ্ছে উত্তরপ্রদেশ।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.