নিতিনের নীতি নিয়েই প্রশ্ন দলে |
দিগন্ত বন্দ্যোপাধ্যায় • নয়াদিল্লি |
নির্বাচন পাঁচ রাজ্যে হলেও বাজি ধরেছিলেন উত্তরপ্রদেশে। এবং শেষ পর্যন্ত বাজিমাত করতে পারলেন না বিজেপি সভাপতি নিতিন গডকড়ী। গোয়া, পঞ্জাবে সরকার গড়ে এবং উত্তরাখণ্ডে সরকার গড়ার যুদ্ধে টিকে থাকলেও উত্তরপ্রদেশে কিন্তু পঞ্চাশের কোঠা পেরোতে পারল না বিজেপি। উত্তরপ্রদেশে গত বিধানসভা ভোটে পাওয়া আসনের থেকেও কমে সন্তুষ্ট থাকতে হল বিজেপিকে। দেশের বৃহত্তম রাজ্যে ভোটে এমন শোচনীয় ফলাফলের পরেই নিতিনের কৌশল নিয়ে এখন প্রশ্ন উঠছে দলের অভ্যন্তরে।
লালকৃষ্ণ আডবাণীর মতো প্রবীণ নেতারা গত দু’বছর ধরে বারবার বলে এসেছেন, উমা ভারতী যখন চিঠি লিখে মধ্যপ্রদেশের রাজনীতি বর্জন করে উত্তরপ্রদেশকে কর্মভূমি করার কথা জানিয়েছেন, তখন তাঁকেই মুখ্যমন্ত্রীর পদপ্রার্থী করে ভোটে যাক দল। আরএসএসের পূর্ণ সমর্থন সত্ত্বেও দলের অন্তর্কলহের জন্য গডকড়ী সে কাজটি তো করতে পারলেনই না, উল্টে সঞ্জয় জোশীকে সংগঠনের দায়িত্বে এনে নরেন্দ্র মোদীর কোপে পড়লেন। কংগ্রেসের দুর্নীতির বিরুদ্ধে বিজেপি যখন আন্দোলন করছে, তখন দুর্নীতির অভিযোগে মায়াবতীর দল থেকে বিতাড়িত বাবুসিংহ কুশওয়াহাকে দলে নিয়ে এলেন গডকড়ী! রাহুল গাঁধী থেকে অখিলেশের মতো তরুণ মুখেরা যখন গোটা রাজ্য দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন, তখন বরুণ গাঁধীর মতো তরুণ নেতাকে ব্যবহারই করতে পারলেন না বিজেপি সভাপতি।
দলের যাবতীয় সমালোচনা বন্ধ করে দিতে পারতেন বিজেপি সভাপতি, যদি তাঁর কৌশলে ভর করে গত বারের তুলনায় আসনসংখ্যা অন্তত দ্বিগুণ করতে পারত দল। কিন্তু তা হল না। ফলে দলের মধ্যেই এখন প্রশ্নের মুখে নিতিন। ভোটের ফল বেরোনোর পর সংসদীয় দলের বৈঠকে লালকৃষ্ণ আডবাণী, সুষমা স্বরাজরা প্রশ্ন তোলেন, পঞ্জাব-উত্তরাখণ্ড-গোয়ার মতো রাজ্যে যেখানে কাউকে না কাউকে মুখ্যমন্ত্রী পদপ্রার্থী করে এগোনো হল, তখন উত্তরপ্রদেশের মতো বড় রাজ্যে কেন তা করা হল না? কেন সরকার গড়ার লক্ষ্য নিয়ে দল এগোতে পারল না? ভোটারদের কাছে তো দল তিন নম্বর হওয়ার জন্যই রয়ে গেল! |
গডকড়ী নিজেও আজ তাঁর কৌশলগত ত্রুটির কথা কবুল করছেন। তিনি বলেন, “উত্তরপ্রদেশের নির্বাচন গোটাটাই মেরুকরণ হয়ে গিয়েছে। যাঁরা মায়াবতীর অপসারণ চেয়েছিলেন, তাঁরা বিজেপিকে বিকল্প হিসেবে দেখতে পাননি। তাই মুলায়মের দলকে ভোট দিয়েছেন।” ভোটের ফল থেকে স্পষ্ট, উচ্চবর্ণের তো বটেই, ওবিসি ভোটও বিজেপির পরিবর্তে গিয়েছে মুলায়মের ঝুলিতে। বস্তুত ভোটের ফল একটু স্পষ্ট হতেই এ নিয়ে বিজেপির নেতৃত্বের মধ্যে প্রশ্ন উঠতে শুরু করে। দলের দফতরে এসে ক্ষোভ উগড়ে দিয়ে যান সুষমা। বলেন, “উত্তরপ্রদেশে আমরা আরও ভাল ফল করতে পারতাম। কেন হল না, তার গভীর অনুসন্ধান প্রয়োজন।”
সদ্য গতকালই স্পিকারের ডাকা সর্বদল বৈঠকে সুষমারা ইঙ্গিত দিয়েছেন, পাঁচ রাজ্যের ভোটে কংগ্রেসের ফল খারাপ হলেই সংসদে ঝড় তুলবেন তাঁরা। আজ ভোটের ফল প্রকাশের পরে বিজেপি নেতৃত্ব বুঝিয়েও দিয়েছেন যে, কংগ্রেসের বিরুদ্ধে সুর ক্রমশ চড়াবেন তাঁরা। সুষমা থেকে গডকড়ী সকলেই আজ রাহুল গাঁধীর ব্যর্থতাকে বড় করে তুলে ধরেছেন। অমেঠি-রায়বরেলীর মতো চিরকালীন দুর্গে কংগ্রেসের বিপর্যয় নিয়ে সরব হয়েছেন তাঁরা। এত সবের পরেও অবশ্য দলে প্রশ্নের মুখে নিতিনের নীতি।
নিতিন গডকড়ীর ঘনিষ্ঠ বিজেপির এক শীর্ষ নেতা আজ কবুল করেন, “উমাকে মুখ্যমন্ত্রী পদপ্রার্থী করতে পারলে ভালই হত। কিন্তু দলের নেতাদের রোষকে প্রশমিত করে ভিন রাজ্য থেকে উত্তরপ্রদেশে উমাকে নিয়ে আসাই যথেষ্ট ঝুঁকির ছিল। এর পরে তাঁকে যদি মুখ্যমন্ত্রীর পদপ্রার্থী করা হত এবং তাতে রাজ্যের বিজেপি নেতারা যদি দলের বিরুদ্ধেই কাজ করতেন, তা হলে তো ফল আরও খারাপ হত!” গডকড়ীর এই ‘অসহায়তা’কেই এখন চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছেন দলের অনেক নেতা। বিজেপি নেতা জিভিএনএল রাও বলেন, “যৌথ নেতৃত্বের কোনও অর্থই হয় না। ভোটের আগে কাউকে নেতা হিসেবে তুলে ধরা প্রয়োজন।” নরেন্দ্র মোদী এখনও পর্যন্ত নীরব থাকলেও তাঁর ঘনিষ্ঠ নেতা বলবীর পুঞ্জ ঠারেঠোরে আক্রমণ করছেন গডকড়ীকে। বলছেন, “নরেন্দ্র মোদী উত্তরপ্রদেশে প্রচারে গেলে ফলাফলে তার প্রভাব পড়ত।”
উত্তরপ্রদেশের ভোটকে মাথায় রেখে গত বছর লখনউয়ে জাতীয় কর্মসমিতির বৈঠক করেছিলেন গডকড়ী। আডবাণীও বলেছিলেন, পরের লোকসভায় দিল্লিতে ক্ষমতা দখলের জন্য কোনও অবস্থাতেই উত্তরপ্রদেশের মতো বড় রাজ্যকে হাতছাড়া করা যাবে না।
এ বার তা হলে কী রণনীতি নেবে দল?
বিজেপি নেতৃত্বের আপাতত কৌশল, মণিপুর ছাড়া বাকি চার রাজ্যে কংগ্রেসের ব্যর্থতাকেই প্রচারের অঙ্গ করে তোলা হবে। যে ভাবে রাহুল গাঁধীকে নিয়ে কংগ্রেস উচ্চগ্রামে প্রচার করেও মুখ থুবড়ে পড়েছে, তা নিয়ে জোরকদমে প্রচার চালানো হবে। আর বিজেপিকে সাম্প্রদায়িক দলের তকমা দেওয়া হলেও এ বারের নির্বাচনে আসলে কংগ্রেসই যে সাম্প্রদায়িক রাজনীতি করেছে, তারও ঢালাও প্রচার হবে। নিতিন গডকড়ী এ দিন বলেন, “আমাদের সাম্প্রদায়িক দল বলা হয়। অথচ গোয়াতে আমাদের ছয় ক্যাথলিক খ্রিস্টান প্রার্থী জিতেছেন। আর উত্তরপ্রদেশে আমাদের ভাল ফল হয়নি মেরুকরণের জন্য।” ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনের কথা মাথায় রেখে দলীয় কর্মীদের উজ্জীবিত করার কথা মাথায় রেখে বিজেপি সভাপতি বলেন, “লোকসভা নির্বাচনে মূল লড়াই হবে কংগ্রেস ও বিজেপির মধ্যে। সপা বা বসপা সেখানে একটি আঞ্চলিক দল মাত্র। বিধানসভা নির্বাচন ও লোকসভা নির্বাচনের মধ্যে অনেক ফারাক থাকে। এখানে মায়াবতীকে হঠানো মূল লক্ষ্য ছিল। তখন হবে কংগ্রেসকে হঠানো। বিজেপি সেই যুদ্ধে জিতবে।” |