পরিচিত ঘরানার বাইরে হেঁটে জয়ী অখিলেশ
ভাবেও জন্ম হয় নেতার!
গত লোকসভা নির্বাচনের ঠিক পরের কথা। সমাজবাদী পার্টির অন্দরমহলে তখন জোর গোলমাল। ফিরোজপুর উপ-নির্বাচনে হেরে গিয়েছেন মুলায়ম সিংহ যাদবের ছেলে অখিলেশ যাদবের স্ত্রী ডিম্পল। মুলায়মের সঙ্গে বিরোধের জেরে দল ছাড়ার মুখে ছায়াসঙ্গী অমর সিংহ। দলের বিরুদ্ধে ‘গুন্ডাগর্দি’র অভিযোগ, শীর্ষ নেতৃত্বের মধ্যে সমন্বয়হীনতা, দলীয় নীতিতে বাস্তবতার অভাব সব মিলিয়ে এক ছন্নছাড়া দশা। হাল এমনই যে, বারবার জোটবার্তা পাঠালেও গুরুত্ব মিলছে না দিল্লির সরকারে থাকা ইউপিএ-র প্রধান শরিক কংগ্রেসের কাছে।
মাত্র তিন বছরের ব্যবধান। সাল ২০১২। উত্তরপ্রদেশের বিধানসভা নির্বাচনের মায়াবতীর হাতিকে লড়াইয়ের ময়দানে বেশ কয়েক কদম পিছনে ফেলে লখনউয়ের তখ্ত নিশ্চিত করে ফেলেছে সপা’র সাইকেল। নিশ্চিত ভাবেই যার প্রভাব পড়তে বাধ্য দিল্লির রাজনীতিতেও। মাত্র তিন বছরের মধ্যেই ধুলো ঝেড়ে উঠে বসল সমাজবাদী পার্টি আর এই চমকপ্রদ উত্থানের মূল কাণ্ডারী হিসেবে আজ জন্ম হল নতুন এক তারকার। মুলায়ম-পুত্র অখিলেশ যাদব। জাতীয় রাজনীতিতে প্রায় এক দশক ধরে সক্রিয় থাকলেও সম্ভবত আজই সত্যিকারের অভিষেক ঘটল মুলায়মের জ্যেষ্ঠ পুত্রের। যিনি সাবেক সমাজবাদী পার্টির ঘরানায় বড় হয়েও মানসিকতায় আদ্যন্ত আধুনিক। কম্পিউটার শিক্ষার সপক্ষে প্রচার চালানোর সঙ্গে সঙ্গেই গ্রামীণ ভোটারদের বার্তা দিতে সওয়াল করেন, কেন কম্পিউটার বা মোবাইলের সফ্টওয়্যারে হিন্দি বা উর্দু ভাষার ব্যবহার হবে না? প্রশ্ন তোলেন, কেন হিন্দি ভাষা জায়গা পাবে না সরকারের সমস্ত কাজে?
আজকের ফলাফলই বলে দিচ্ছে, সংশয়াতীত ভাবেই উত্তরপ্রদেশের নির্বাচনে ‘ম্যান অফ দ্য ম্যাচ’ হিন্দি বলয়ের নতুন প্রজন্মের নেতা ৩৯ বছরের অখিলেশ। সপ্রতিভ চেহারা, স্বচ্ছ ভাবমূর্তি, ঋজু ব্যক্তিত্ব, জনতার সঙ্গে সরাসরি সম্পর্ক স্থাপন, দলীয় নীতির বাইরে গিয়ে আধুনিক প্রযুক্তির পক্ষে সওয়াল এক কথায় নির্বাচনী কৌশল ও প্রচারের নিজস্বতায় অখিলেশের একার হাতে মাত হয়েছেন রাহুল-মায়াবতী-উমার মতো হেভিওয়েট নেতারা। পাঁচ বছর পরে রাজ্যে ক্ষমতায় এবং জাতীয় রাজনীতিতে আলোর বৃত্তে ফিরেও আজকের এই উচ্ছাসের দিনে ‘নায়ক’ কিন্তু বরাবরের মতোই শান্ত, নির্লিপ্ত। রাহুল গাঁধীর সঙ্গে তাঁর রাজনৈতিক দ্বৈরথ ও তার পরিণতি নিয়ে সংবাদমাধ্যম যখন উত্তাল, তখন অখিলেশ খাদে নামানো গলায় জানিয়েছেন, “রাহুলকে রাজ্যের মানুষ ফিরিয়ে দিয়েছেন। তা ছাড়া নির্বাচনে তো হার-জিত থাকেই।”
রাহুল-তরণীতে ভর করেই এ বারের ভোটে উত্তরপ্রদেশে ভাল ফলের আশা করেছিল কংগ্রেস। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে দেখা গেল রাহুলের ‘অ্যাংরি ইয়ংম্যান’ ভাবমূর্তি বাতিল করে আম-জনতা বরণ করে নিয়েছে আপাত শান্ত, বাস্তবমুখী, ভূমিপুত্র অখিলেশকেই। নীতীশ-লালুপ্রসাদ থেকে শুরু করে মমতা, নবীন পট্টনায়ক বা মায়বাতী আঞ্চলিক নেতাদের ক্ষেত্রে যখন যোগ্য উত্তরসূরির অভাব ফুটে উঠতে শুরু করেছে, তখন কিন্তু অত্যন্ত সুকৌশলে আধুনিক প্রজন্মের নেতা হিসেবে নিজের ছেলে অখিলেশকে হিন্দি বলয়ের রাজনীতিতে প্রতিষ্ঠিত করে ফেলতে সক্ষম হলেন লোহিয়া-শিষ্য মুলায়ম।
অথচ লড়াইয়ের শুরুটা মোটেই সহজ ছিল না। ইউপিএ সরকারের দ্বিতীয় পর্বে দরাদরি মন-পসন্দ না হওয়ায় কংগ্রেসের কাছে ব্রাত্য হয়ে রয়েছে সপা। উত্তরপ্রদেশেও মায়বাতীর চাপে দিশাহারা রাজ্য নেতৃত্ব। ক্ষমতায় ফিরতে মরিয়া সপা ২০১১ সালের শুরুতেই উত্তরপ্রদেশ জুড়ে একটি সমীক্ষা চালায়। তাতে দেখা যায়, রাজ্যের মানুষ মায়াবতীর শাসনে অতিষ্ঠ হয়ে উঠলেও মুলায়ম-শাসনের অভিজ্ঞতাও ভোলেননি! সমীক্ষা আরও জানায়, নেতা হিসেবে মুলায়মের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। সপা’র এক নেতার কথায়, “দলের শীর্ষ নেতৃত্ব তখনই বুঝে যায়, ক্ষমতায় ফিরতে গেলে এমন তরুণ নেতাকে তুলে আনতে হবে, যার স্বচ্ছ ভাবমূর্তি রয়েছে। মুলায়ম থাকবেন নেপথ্যে। আর এ ক্ষেত্রে রাহুল গাঁধীর মোকাবিলায় অখিলেশের থেকে ভাল ব্যক্তি কে হতে পারে।” সেই কৌশল যে খেটে গিয়েছে, ভোটের ফলই তার প্রমাণ।
কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে কোনও যোগ না থাকলেও অসীম শ্রদ্ধা জ্যোতি বসুর প্রতি। দলের সঙ্কটে দায়িত্ব পাওয়ার পরেই অখিলেশ ঠিক করেন, ভয় মুক্ত, নিরপেক্ষ প্রশাসনের যে ছবি তিনি রাজ্যবাসীর কাছে তুলে ধরতে চান, তা বাস্তবেও প্রয়োগ করে দেখাতে হবে। তাই প্রথমেই মুলয়াম-ঘনিষ্ঠ বাহুবলী নেতা ডি পি যাদবকে টিকিট না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। শুধু তাই নয়, ভোটে সপা-র হয়ে দাঁড়াতে ইচ্ছুক চার-পাঁচ হাজার লোকের সাক্ষাৎকারের দায়িত্বও নেন অখিলেশ। সঙ্গে কাকা রামগোপাল যাদব। এই প্রথম বিস্তর ঝাড়াই-বাছাই করে এবং অতীত খতিয়ে দেখে তবেই প্রার্থীদের টিকিট বণ্টন করেন সপা নেতৃত্ব।
প্রচারেও অভিনবত্ব আনেন অখিলেশ। এক দিকে নিজস্ব ভোটব্যাঙ্ককে ফিরিয়ে আনতে মুলায়মকে ভোট প্রচারের একেবারে শেষ লগ্নে ব্যবহার করা, অন্য দিকে রাহুলের মোকাবিলায় গত বছরের শুরু থেকেই গোটা রাজ্য সাইকেলে (একাধারে দলীয় প্রতীকও) ঘোরার সিদ্ধান্ত নেন অখিলেশ। সাইকেলে চড়েই রাজ্যের প্রতিটি জেলার আম-জনতার কাছে পৌঁছে যেতে পেরেছিলেন মুলায়ম-পুত্র। সরাসরি কথা বলেন রাজ্যবাসীর সঙ্গে। শুনেছেন তাঁদের দৈনন্দিন সমস্যা। রাহুল যেমন মায়াবতীর বিরুদ্ধে নেতিবাচক প্রচার চালিয়েছেন, অখিলেশ সে পথে হাঁটেনইনি। বরং ‘ঠেট’ হিন্দিতে রাজ্যের মানুষের সামনে আশার জাল বুনেছেন। আশ্বাস দিয়েছেন, গুন্ডারাজ আর ফিরবে না উত্তরপ্রদেশে। হবে উন্নয়ন।
সিডনিতে পরিবেশ সংক্রান্ত ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে পড়াশুনা করা অখিলেশ নিজে ব্যক্তিগত জীবনে রাহুল গাঁধীর মতোই ‘টেক স্যাভি।’ তাই যে মুলায়ম এত দিন কম্পিউটার বা ইংরেজি শিক্ষার ঘোর বিপক্ষে ছিলেন, এ বার তাঁর দলই অখিলেশের উদ্যোগে ঘোষণা করে, জিতলে দ্বাদশ ও দশম শ্রেণির ছাত্র-ছাত্রীদের যথাক্রমে ল্যাপটপ ও ট্যাবলেট দেওয়া হবে! সপা নেতৃত্বের কথায়, এই প্রচার ছাত্র-যুব ভোটারদের মধ্যে যে কাজ করেছে, তা তো ফলাফলেই স্পষ্ট। তিনি যে উত্তরপ্রদেশের ভূমিপুত্র তথা হিন্দি বলয়ের নেতা তা মাথায় রেখেই সংবাদমাধ্যমেও হিন্দি ছাড়া অন্য কোনও ভাষায় এ যাবৎ কোনও সাক্ষাৎকারও দিতে দেখা যায়নি অখিলেশকে। বাবার ধাঁচেই প্রচারেও জোর দিয়েছেন দেহাতি হিন্দিতে। জনতার মন বুঝতে প্রায় আটশো নির্বাচনী সভা করেছেন তিনি। রাজ্যের মানুষকে ভরসা দিতে চিরাচরিত বাহুবলী প্রার্থীর বদলে যোগ্য ব্যক্তিদের টিকিট দিয়েছেন। অখিলেশ-ঘনিষ্ঠেরা বলছেন, একগুচ্ছ এই ধরনের সিদ্ধান্তই একজোট হয়ে ঝড় তুলেছে ভোটের বাক্সে, যার দাপটে উড়ে গিয়েছে মায়াবতীর হাতি!
দিল্লির রাজনীতিতে একাধিক বার অপাঙক্তেয় হয়েও বারবার সদর্পে ফিরে এসেছেন মুলায়ম সিংহ যাদব। অনেকেই বলছেন, পুত্র অখিলেশও যে জাতীয় রাজনীতিতে তাঁর মতোই লম্বা রেসের ঘোড়া হতে চলেছেন, আজ যেন তারই আভাস মিলল। বাকিটা বলবে ভবিষ্যৎ।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.