কংগ্রেসের বিপর্যয়ে সঙ্কট বাড়ল কেন্দ্রে
রাহুল গাঁধী বা কংগ্রেস নয়, মায়াবতীর বিরুদ্ধে প্রবল জন অসন্তোষের লাভ শেষ পর্যন্ত একাই ঘরে তুললেন মুলায়ম সিংহ। বিপুল জনমত নিয়ে উত্তরপ্রদেশে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করল তাঁর সমাজবাদী পার্টি। সরকার গড়তে দশ জনপথের উপর তাঁর বিন্দুমাত্র নির্ভরতা তো রইলই না, উপরন্তু পঞ্জাব ও গোয়াতেও বিপর্যয় হল কংগ্রেসের। এমনকী বিজেপি সরকারের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ সত্ত্বেও উত্তরাখণ্ডে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেল না কংগ্রেস।
সব মিলিয়ে ২০১৪-র লোকসভা নির্বাচনের আগে পাঁচ রাজ্যের যে বিধানসভা ভোটকে সেমিফাইনাল বলে মনে করা হচ্ছিল, তাতে ভাল মতো ধাক্কা খেল কংগ্রেস। যার ফলে কেন্দ্রে ইউপিএ সরকারের ভবিষ্যৎ এবং কংগ্রেসের রাজনীতি নিয়েও বড় প্রশ্ন উঠে গেল।
সে দিক থেকে সব চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবশ্যই উত্তরপ্রদেশের ফল। কংগ্রেস নেতৃত্বের আশা ছিল, এ রাজ্যে ফল এমন হবে যাতে সরকার গড়ার জন্য তাদের উপর নির্ভর করতে হবে মুলায়মকে। যার পরিবর্তে সপার সমর্থন নিয়ে কেন্দ্রে ইউপিএ-কে স্থিতিশীল করবে কংগ্রেস। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, শরদ পওয়ারদের মতো শরিকদের চাপ সামাল দিয়ে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া হবে আর্থিক সংস্কার কর্মসূচি। কিন্তু সেই আশা পূরণ তো হলই না, বরং কেন্দ্রে রাজনৈতিক অস্থিরতার পুরোদস্তুর আশঙ্কা তৈরি হয়ে গেল। এমনকী আসন্ন রাষ্ট্রপতি নির্বাচন নিয়েও কংগ্রেসকে বিপাকে পড়তে হতে পারে বলে মনে করছেন অনেকেই।
সমাজবাদী পার্টির জয়ে উচ্ছ্বাস কলকাতায়। রাজীব বসুর তোলা ছবি।
সেই পরিস্থিতির আঁচ পেয়ে এখন থেকেই কোমর কষতে শুরু করে দিয়েছেন বিজেপি নেতৃত্ব। লোকসভার বিরোধী দলনেতা সুষমা স্বরাজ আজ বলেন, “কংগ্রেস কী হারে জনপ্রিয়তা খুইয়েছে পাঁচ রাজ্যের ভোটেই তা প্রমাণিত। এর পর কেন্দ্রে সরকার চালাতে প্রতি পদে হোঁচট খাবে তারা। এই অবস্থায় লোকসভার অন্তর্বর্তী নির্বাচনের সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেওয়া যায় না।”
রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের অনেকের মতে, আজ আরও এক বার স্পষ্ট হয়ে গেল যে, এ দেশে দ্বিদলীয় রাজনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে ওঠা এখনও দূর অস্ত। বরং রাজ্যে রাজ্যে আঞ্চলিক শক্তির দাপট ঘোরতর বাস্তব। আর তাই পুরোমাত্রায় বাস্তব জোট রাজনীতিও। ভবিষ্যতে কংগ্রেস বা বিজেপি-র মধ্যে যে আঞ্চলিক শক্তির সঙ্গে সমন্বয় করে যত শক্তিশালী জোট গড়ে তুলতে পারবে, তার ক্ষমতায় আসার সম্ভাবনা তত উজ্জ্বল হবে।
এই ‘বোধোদয়’ কংগ্রেসের নেতৃত্বের একাংশের মধ্যেও হচ্ছে। তাঁরা স্বীকার করে নিচ্ছেন, আসলে উত্তরপ্রদেশে সপার সঙ্গে জোট না করে একলা চলাটাই ভুল হয়েছে। দলের এক কেন্দ্রীয় নেতার কথায়, “দিল্লির নেতাদের হয়তো এখনও এটা বুঝতেই অসুবিধা হচ্ছে যে, সনিয়া গাঁধী বা লালকৃষ্ণ আডবাণীর প্রচারে আজকাল বিশেষ ফল দেয় না। আদতে কার্যকরী ভূমিকা নেন আঞ্চলিক নেতৃত্বই। তা সে কংগ্রেসের রাজশেখর রেড্ডি হোন বা বিজেপি-র নরেন্দ্র মোদী, শিবরাজ সিংহ চৌহান। উত্তরপ্রদেশ, পঞ্জাব, উত্তরাখণ্ডে কংগ্রেস এবং বিজেপি-র খামতি রয়েছে সেখানেই।’’
বস্তুত কংগ্রেস বা বিজেপি-র মতো সর্বভারতীয় শক্তি উত্তরপ্রদেশে যে এ বার দাঁত ফোটাতে পারেনি, তা ভোটের ফলেই পরিষ্কার। সেখানে ভরাডুবির পরেও দ্বিতীয় স্থানেও রয়ে গিয়েছে আঞ্চলিক শক্তি মায়াবতীর বহুজন সমাজ পার্টি।
একই ভাবে পঞ্জাবেও জয় হয়েছে আঞ্চলিক দল অকালির। এমনকী যেখানে বিজেপি-র ফল আগের থেকে খারাপ হয়েছে, তখন তার জোটসঙ্গী অকালি দল গত বারের আসনকেও ছাপিয়ে গিয়েছে। পঞ্জাবে যা কিনা অভূতপূর্ব। কেন না, গত আড়াই দশকে পঞ্জাব এক দলকে পরপর দু’বার ক্ষমতায় ফেরায়নি। অথচ এ বার অকালি-বিজেপি সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিষ্ঠান-বিরোধিতার ঢেউ যে ছিল না, তা নয়। দুর্নীতির অভিযোগও ছিল। প্রাথমিক ময়নাতদন্তে অবশ্য কংগ্রেস নেতৃত্ব দলের কলহকেই বিপর্যয়ের কারণ বলে স্বীকার করে নিচ্ছেন। দলের একাংশের বক্তব্য, অমরেন্দ্র সিংহকে অনেক আগেই মুখ্যমন্ত্রী পদপ্রার্থী ঘোষণা করে দেওয়া উচিত ছিল। অন্য অংশ আবার অমরেন্দ্রকেও দায়ী করছেন। অভিযোগ, গত পাঁচ বছর তিনি পঞ্জাবের জমি আঁকড়ে না থেকে অধিকাংশ সময় বিদেশে কাটিয়েছেন। ফলে অবস্থায় অকালি-র মতো স্থানীয় দলকেই বেছে নিয়েছেন ভোটারেরা।
পঞ্জাবের মতো উত্তরাখণ্ডেও কংগ্রেসের সঙ্কট সেই আঞ্চলিক নেতৃত্ব নিয়ে। নারায়ণ দত্ত তিওয়ারির পর তাঁর সমতুল কোনও নেতাই সেখানে কংগ্রেসের নেই। উপরন্তু দল গোষ্ঠীদ্বন্দ্বে জর্জর। দলের বহু বিক্ষুব্ধ নেতা নির্দল প্রার্থী হয়ে কংগ্রেসের যাত্রা ভঙ্গ করেছেন। ফলে বিজেপি সরকারের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও কংগ্রেস একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করতে পারেনি।
আবার সেই আঞ্চলিক নেতৃত্বের দাপটের কারণেই মণিপুরে কংগ্রেসের জয়জয়কার। সনিয়া-মনমোহনের প্রচার ছাড়াই একার ক্ষমতায় কংগ্রেসকে জিতিয়ে এনেছেন ইবোবি সিংহ।
বিজেপি শিবিরের ছবিটাও খুব সুখকর নয়। পঞ্জাবের সাফল্য মূলত অকালি দলের। উত্তরাখণ্ডে তারা সরকার ধরে রাখতে পারেনি। আর উত্তরপ্রদেশে গত বারের থেকে ফল খারাপ হয়েছে। একমাত্র গোয়াতে কংগ্রেসকে পর্যুদস্ত করতে পেরেছে বিজেপি।
তবে রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের মতে, কংগ্রেস বা বিজেপি এই ফল থেকে শিক্ষা নেবে কি নেবে না সেটা পরের প্রশ্ন, এই মুহূর্তে সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে চলেছে সর্বভারতীয় রাজনীতির ভবিষ্যৎ। ইউপিএ-র দ্বিতীয় ইনিংসের বাকি আড়াই বছর কী ভাবে চালাবেন মনমোহন সিংহ?
সংসদের বাজেট অধিবেশন শুরু হচ্ছে সোমবার। সেখানে সরকার তথা কংগ্রেসকে চেপে ধরতে আজ রাত থেকেই বাম ও অন্যান্য আঞ্চলিক দলের সঙ্গে কক্ষ সমন্বয় গড়ে তোলার তৎপরতা শুরু করে দিয়েছে বিজেপি। এই অবস্থায় কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখোপাধ্যায়ের বাজেট কতটা সাহসী হতে পারবে, তা নিয়েই সংশয় তৈরি হয়েছে। আবার সংস্কার সরিয়ে রেখে তৃণমূল রেল বাজেটে আরও জনমুখী পথে হাঁটতে চাইলে কংগ্রেস নেতৃত্ব তাতে বাদ সাধতে পারবেন কি না, সেটাও প্রশ্ন। পাশাপাশি খাদ্য সুরক্ষা, পেনশন, লোকপাল, ব্যাঙ্ক, বিমার মতো গুরুত্বপূর্ণ সব বিল পাশও বিশ বাঁও জলে চলে যেতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে। কারণ, এই সব বিল নিয়ে তৃণমূল আপত্তি তুলছে। বিজেপি-বামেরা আশা করছেন, মুলায়ম যে হেতু রাজ্যে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছেন, তাই কেন্দ্রে সমর্থক দল হলেও কংগ্রেসকে বেগ দেবেন।
রাজ্যসভায় এমনিতেই সরকার সংখ্যালঘু। তার উপর পাঁচ রাজ্যের বিধানসভা ভোটের প্রভাব অনিবার্য ভাবেই রাজ্যসভার আসন্ন ৫৪টি আসনের ভোটের উপর পড়তে চলেছে। সে দিক থেকে সব থেকে লাভবান হওয়ার আশা এখন মুলায়মেরই। সব মিলিয়ে রাজ্যসভায় কংগ্রেসের শরিক-নির্ভরতা আরও বাড়বে।
এই সঙ্কট মুক্তির পথ খুঁজতে আজ সনিয়া-মনমোহনের নেতৃত্বে কংগ্রেস কোর গ্রুপের বৈঠক বসে। পরে দলের এক শীর্ষ নেতা বলেন, মুলায়ম একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেলেও কেন্দ্রে কংগ্রেসের সাহায্য তাঁর প্রয়োজন হবে। ঠিক যে কারণে মমতার কেন্দ্রের সাহায্য প্রয়োজন, উত্তরপ্রদেশের উন্নয়নের জন্য কেন্দ্রকে ততটাই দরকার সপার।
তবে এ সবই কংগ্রেস নেতাদের আশামাত্র। আজকের ফলাফলের পর সর্বভারতীয় রাজনীতির গতিপ্রকৃতি কী হয় এখন সেটাই দেখার।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.