একটা পোস্টারও কেউ ছিঁড়ে ফেলেননি, বলছেন কিরণময় |
সন্দীপন চক্রবর্তী • কলকাতা |
ভোটের আগে ‘নেতাজি’ যে দিন ইস্তাহার প্রকাশ করছেন, পাশে তিনি। ভোটগণনার পরে ‘নেতাজি’-পুত্র অখিলেশ যাদব যখন হাসি মুখে ক্যামেরার সামনে, পাশে তিনি।
হিন্দি বলয়ের হৃৎপিণ্ড উত্তরপ্রদেশে এ বারের নির্বাচনের সঙ্গে অবিচ্ছেদ্য জড়িয়ে থাকল এক বঙ্গসন্তানের মুখ।
গণনা শুরুর পরে মঙ্গলবার লখউয়ের তখ্ত আর মুলায়ম সিংহ যাদবের ব্যবধান যত কমে আসতে শুরু করেছে, পশ্চিমবঙ্গ থেকে তত কল গিয়েছে তাঁর মোবাইলে!
দিনের শেষে লখনউ থেকে যিনি সহাস্য বলছেন, “বুথ-ফেরত সমীক্ষা যখন চলছিল, তখনই আমি বলেছিলাম, এখানে আমরা থামব না! দু’শো ছাড়িয়ে যাব। এখন সকলের বিশ্বাস হল তো!” রাজ্যে ২২৪ আসন পেয়ে ক্ষমতাসীন হওয়ার পরে সমাজবাদী পার্টির সাধারণ সম্পাদকের এই প্রতিক্রিয়া স্বাভাবিক।
কিন্তু বঙ্গবাসীর কাছে তাঁর পরিচয় এ রাজ্যের প্রাক্তন মৎস্যমন্ত্রী হিসাবেই। মুলায়মদের এ বারের সাফল্যের কাহিনিতে কিরণময় নন্দের জন্যও একটা অধ্যায় থাকবে, হিন্দি বলয় থেকে দূরে বসে এতেই ‘আপ্লুত’ এ রাজ্যের রাজনৈতিক শিবির। মাত্র দশ মাস আগে নিজের রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচনে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে পর্যুদস্ত হওয়া বামফ্রন্টের অন্যতম শরিক কিরণময়বাবু এই অল্প দিনেই নিজের জন্য পৃথক রাজনৈতিক ইনিংস গড়ে নিলেন মুলায়ম-অখিলেশদের সঙ্গে ঘটনাপ্রবাহ যথেষ্টই ভাবিয়ে ছেড়েছে এ রাজ্যের বাম নেতাদের! কিরণময়বাবুর যে ‘গৌরবে’র আলোয় এ রাজ্যে তাঁর দলের একমাত্র বিধায়ক চাঁদ মহম্মদের কপালেও এসে পড়েছে টিভি চ্যানেলের টিআরপি!
পশ্চিমবঙ্গে বহু নির্বাচনী যুদ্ধের সৈনিক কেমন দেখলেন উত্তরপ্রদেশের রণক্ষেত্র? সে রাজ্যে ভোট হয়েছে মোট ছ’দফায়, আগাগোড়া ঘাঁটি গেড়ে পড়েছিলেন কিরণময়বাবু। পূর্ণাঙ্গ ফলপ্রকাশের পরে দলের গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক সেরে উঠে কলকাতার জন্য তাঁর উত্তর “বাংলায় এত নির্বাচন করেছি। কিন্তু এখানে যা দেখলাম, এত শান্তিপূর্ণ নির্বাচন ভাবতে পারিনি! কোনও স্লোগান নেই, মারামারি নেই। কেউ কারও একটা পোস্টার-পতাকা ছেঁড়েনি। যে যার মতো প্রচার করছে, চলে যাচ্ছে।” তাঁর অভিজ্ঞতায়, “উত্তরপ্রদেশের মানুষের যে রাজনৈতিক অগ্রগতি দেখলাম, শেখার মতো!” এ রাজ্যে যেমন মমতা বনাম সিপিএম, তেমনই উত্তরপ্রদেশে মুলায়ম বনাম মায়াবতী রাজনৈতিক তিক্ততা কিছু মাত্র কম নয়। তবু দুই যুযুধান শিবিরের লড়াই যে রাজনৈতিক লড়াই হয়েই থেকেছে, রাস্তার বিবাদে নামেনি এই অভিজ্ঞতাকেই দামি ধরছেন পশ্চিমবঙ্গের প্রাক্তন মন্ত্রী।
বাংলার গড়পড়তা রাজনৈতিক শিবিরের ধারণা, হিন্দি বলয় মানেই বাহুবলের
লড়াই। কিরণময়বাবু বলছেন, “অনেকে বলেছিল, সমাজবাদী পার্টি আবার ক্ষমতায় ফিরলেই গুন্ডা-গর্দি হবে। আমরা নির্বাচনী প্রতিশ্রুতিতে বলেছিলাম, তার কোনও সম্ভাবনা নেই। আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করা আমাদের অগ্রাধিকার। লোকে সেই কথায় ভরসা রেখেছে।”
বঙ্গ রাজনীতির কিরণময়বাবু কি বদলেছেন? সহজেই ধরে ফেলার মতো ‘পরিবর্তন’ বলতে, কথার মাঝে অনেক বেশি হিন্দি শব্দ আসছে আজকাল! দীর্ঘ দিন মুলায়ম-মুলুকে ঘাঁটি গেড়ে থাকার সুুবাদেই। যেমন, তাঁর কথায়, “এ বারের মুদ্দা ছিল দু’টো। ভ্রষ্টাচার আর বিকাশ। দিল্লির কংগ্রেস এবং এখানে মায়াবতী ভ্রষ্টাচারের জনক-জননী হিসাবে উত্তরপ্রদেশের মানুষের কাছে চিহ্নিত হয়েছেন। বিকাশ অবহেলিত হয়েছে। যেটা আমরা করব বলেছি।” বিশুদ্ধ বাংলা করলে দাঁড়ায়, দুর্নীতি আর উন্নয়নের প্রশ্নেই উত্তরপ্রদেশের ফয়সালা হয়েছে।
উত্তরপ্রদেশ বিধানসভা বা উচ্চ কক্ষ বিধান পরিষদে আসতে গেলে সে রাজ্যের ভোটার হতে হয়। যে ‘শর্ত’ কিরণময়বাবু পূরণ করছেন না। তা হলে মুলায়ম-জমানায় কোন ভূমিকায় তাঁকে দেখা যেতে পারে। “আমি সমাজবাদী পার্টির এক জন সৈনিক হয়ে থাকব!” হাসলেন। ভাঙলেন না কিরণময় নন্দ। |