ট্রেজারির মাধ্যমে ক্ষতিপূরণ বা বেতন। রাজ্য সরকারের এই সিদ্ধান্তে সিঁদুরে মেঘ দেখছেন বন দফতরের কর্মী-আধিকারিকেরা। তাঁদের বক্তব্য, বন্যপ্রাণীর হানায় মৃত্যু হোক, ফসলের ক্ষতি মেটানোতেই হোক বা দৈনিক মজুরির ভিত্তিতে অস্থায়ী বনকর্মীদের এপ্রিলের বেতন দেওয়ায় জটিলতা বাড়বে। সোমবার সুকনায় বনকর্তাদের বৈঠক শেষে এ নিয়েই প্রশ্ন উঠল।
অর্থ দফতরের ট্রেজারি সংক্রান্ত নব্য নিয়মবিধিতে সম্প্রতি স্পষ্ট করে দেওয়া হয়েছে রাজ্য সরকারের সব দফতরেই এখন থেকে আর্থিক লেনদেন হবে ট্রেজারির মাধ্যমে। বন দফতরের ক্ষেত্রেও একই নীতি প্রযোজ্য। দক্ষিণবঙ্গের বনাধিকারিকদের ডেকে গত ২ মার্চ রাজ্যের প্রধানমুখ্য বনপাল তা জানিয়ে দিয়েছিলেন। এ দিন উত্তরবঙ্গের বনকর্তাদের ডেকে প্রায় দু’ ঘণ্টার বৈঠকে সরকারি সেই সিদ্ধান্তের কথাই ফের এক বার জানিয়ে দেওয়া হল।
কিন্তু ট্রেজারির মাধ্যমে আর্থিক লেনদেন হলে তা প্রলম্বিত সময়ের ব্যাপার। এ দিনের বৈঠকে উত্তরবঙ্গের একাধিক বনাধিকারিক, রেঞ্জ অফিসারেরা সে প্রশ্ন তোলায় বন দফতরের সচিব সুবেশ দাসের উত্তর ছিল, “অধিকাংশ সরকারি দফতরেই তো ট্রেজারির মাধ্যমে লেনদেন হয়। বন দফতরে অসুবিধা হবে কেন? আপাতত এই ব্যবস্থাই চলবে, সমস্যা হলে পরে দেখা যাবে।” আর, বনমন্ত্রী হিতেন বর্মন বলছেন, “নতুন কোনও ব্যবস্থা চালু করতে গেলে প্রথমে কিছু সমস্যা হতে পারে। ধীরে ধীরে ঠিক হয়ে যাবে।” বৈঠকে উপস্থিত রাজ্যের প্রধান মুখ্য বনপাল মির্জা সুলতান, প্রধান মুখ্য বনপাল (জেনারেল) অতনু রাহা’ও প্রায় একই সুরে জানিয়েছেন, আপাতত এই নিয়মই মানতে হবে বনাধিকারিকদের।
এত দিন আর্থিক লেনদেনের ক্ষেত্রে বনাধিকারিক বা ডিভিশনার ফরেস্ট অফিসারেরাই (ডিএফও) ছিলেন ডিডিও বা ড্রয়িং অ্যান্ড ডিসবার্সমেন্ট অফিসার। অর্থাৎ স্থানীয় রেঞ্জ অফিসারেরা ডিএফও’র অনুমতি নিয়ে প্রয়োজনীয় টাকা খরচ করতেন। দৈনিক হাজিরার অস্থায়ী কর্মী নিয়োগ থেকে হাতির হানায় মৃতের নিকট আত্মীয়কে এককালীন ২০ হাজার টাকা ক্ষতিপূরণ (যা দুর্ঘটনার দু’ঘন্টার মধ্যেই দেওয়া হত), হাতি বা বাইসনের দাপাদাপিতে ফসলের ক্ষয়ক্ষতি হলে জরুরি ভিত্তিতে ক্ষতিপূরণ, এমনকী হাতি তাড়াতে গ্রামবাসীদের পটকা কেনার অর্থ জোগান দিতেন তাঁরা। পরিকল্পনা বহির্ভূত খাতে বরাদ্দ ওই টাকা গ্রামবাসীদের হাতে দ্রুত তুলে দিয়ে প্রাথমিক ক্ষোভ প্রশমনের এটাই ছিল প্রচলিত বন-বিধি। বৈঠক শেষে একাধিক ডিএফও-র তাই প্রশ্ন ছিল, “ট্রেজারির মাধ্যমে ক্ষতিপূরণের বরাদ্দ টাকা আসতে মাস ঘুরে যাবে। জনরোষ সামাল দেওয়া যাবে কী করে?” রেঞ্জ অফিসারদের প্রশ্ন, “গ্রামে বন্যপ্রাণী ঢুকে পড়লে কিংবা জখম বুনো জন্তুর চিকিৎসার জন্য স্থানীয় গাড়ি ভাড়ার টাকা নগদে মেটাতে হয়। ভাড়া গাড়ির মালিককে কী ট্রেজারি দেখানো যাবে?” এখন থেকে সে ব্যাপারে বনাধিকারিকদের ট্রেজারির আগাম অনুমোদন নিতে হবে। কিন্তু অনুমোদন আসা পর্যন্ত গ্রাম ঢুকে পড়া হাতি-বাঘ-গণ্ডারেরা অপেক্ষা করে তো! প্রশ্ন উঠেছে তা নিয়েই।
উত্তরবঙ্গে লোকালয়ে বন্যপ্রাণীর হানা প্রায় নিত্য ঘটনা। দক্ষিণবঙ্গের পশ্চিম মেদিনীপুরেও হাতির দাপাদাপিতে প্রাণহানি নতুন নয়। রবিবার গভীর রাতে আড়াবাড়ির জঙ্গলে তিন ‘রেসিডেন্ট’ হাতির দৌরাত্ম্যে কেশপুর ও চন্দ্রকোনা রোড এলাকায় প্রাণ গিয়েছে তিন জন গ্রামবাসীর। ক্ষতিপূরণ? নব্য নিয়মে তা অবশ্য এখন বিশ বাঁও জলে। প্রধান মুখ্য বনপাল মির্জা সুলতান বলছেন, “অফিসার-কর্মীদের সকলের বক্তব্যই শোনা হয়েছে। আশা করি নতুন নিয়মে চলতে কোনও অসুবিধে হবে না।” এ ব্যাপারে প্রধান মুখ্য বনপাল (জেনারেল) অতনু রাহা অবশ্য বলেন, “আশঙ্কার কারণ নেই। ডিএফও-রা যাতে জরুরি ভিত্তিতে খরচ করতে পারেন সে জন্য অর্থ বরাদ্দ করা থাকবে।”
ডিএফও কিংবা রেঞ্জ অফিসারদের আশঙ্কা অবশ্য উড়িয়ে দিতে পারছেন না উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন পঞ্চায়েত সমিতির কর্তারা। নকশালবাড়ি পঞ্চায়েত সমিতির বন কর্মাধ্যক্ষ সুনীল ঘোষ তাঁদেরই এক জন। তিনি বলেন, “বুনো হাতির হামলায় ফসলের ক্ষতি হলে ক্ষতিপূরণ পেতে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট খুলতে বলা হয়েছে। যার ফসলের ক্ষতি হয়েছে তাঁকে বলব, আগে ব্যাঙ্কে অ্যাকাউন্ট করুন, তার পরে টাকা পাবেন? এটা সম্ভব!” বনকর্তাদের অধিকাংশের কাছেই প্রশ্ন এটাই। |