শ্বশুরকে খুন করতে পাঁচ লক্ষ টাকা দিয়ে খুনি ভাড়া করেছিল জামাই। বৌবাজারের ব্যবসায়ী নীতীশ জয়সোয়ালের (৫৫) হত্যাকাণ্ডের কিনারা করতে গিয়ে এমনই দাবি করল পুলিশ। তদন্তকারীদের দাবি, টাকার লোভেই শ্বশুরকে খুন করায় ওই ব্যক্তি। জামাই ও তার তিন শাগরেদকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ।
গত ২০ ফেব্রুয়ারি রাত থেকে চাঁদনি চক এলাকার বাসিন্দা নীতীশের খোঁজ মিলছিল না। ২১ ফেব্রুয়ারি সকালে সোনারপুরের খেয়াদা এলাকার একটি খাল থেকে তাঁর মৃতদেহ উদ্ধার হয়। পুলিশ জানিয়েছে, বিভিন্ন পানশালার ‘মিউজিক ব্যান্ড’ মালিকদের সুদে টাকা ধার দিতেন নীতীশ। এই কাজে তিনি প্রায় ৩০ লক্ষ টাকা খাটাতেন। পুলিশের দাবি, নীতীশকে খুনের মূল পরিকল্পনা তাঁর জামাই অমিত চৌধুরীর। বড়বাজার এলাকায় অমিতের রেডিমেড পোশাকের ব্যবসা ছিল। প্রচুর টাকা লোকসানের ফলে সেই ব্যবসা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় শ্বশুরের ব্যবসার কাজকর্ম দেখাশোনা করত অমিত।
পুলিশ জানায়, বছর চারেক আগে নীতীশের বড় মেয়ের সঙ্গে বিয়ে হয় খিদিরপুরের বাসিন্দা অমিতের। নীতীশের আরও এক মেয়ে ও এক ছেলে রয়েছে। তদন্তকারীরা জানান, অমিতের ধারণা হয়েছিল, নীতীশকে সরাতে পারলে মিউজিক ব্যান্ডকে টাকা ধার দেওয়ার ব্যবসাটি সে কব্জা করে ফেলতে পারবে। তাদের দাবি, জেরায় অমিত জানিয়েছে, শ্বশুরমশাইয়ের টাকা হাতিয়ে সে ও তার বন্ধু রাজীব সোনারপুরে একটি পানশালা খোলারও পরিকল্পনা করে ফেলেছিল।
|
ধৃত অমিত চৌধুরী |
পুলিশের দাবি, খুনের পরিকল্পনাতেও অমিতের সঙ্গে ছিল রাজীব। রাজীবের একটি মিউজিক ব্যান্ড রয়েছে। অভিযোগ, তারা দু’জনে মিলে নীতীশকে খুনের জন্য শঙ্কু গঙ্গোপাধ্যায় ও বিশ্বজিৎ ঘোষকে ভাড়া করে। ওই দু’জনের নামে সোনারপুর এলাকায় একাধিক দুষ্কর্মের অভিযোগ রয়েছে। তদন্তকারীরা জানান, নীতীশকে খুনের জন্য দু’জনকে পাঁচ লক্ষ টাকা দেওয়ার কথা হয়। আগাম দেওয়া হয় দু’লক্ষ। খুনের পরে যে গাড়িতে নীতীশের দেহ খেয়াদায় নিয়ে যাওয়া হয়, সেটি অবশ্য এখনও পাননি তদন্তকারীরা।
কী ভাবে খুন হন ওই ব্যবসায়ী?
তদন্তকারীরা জানান, ২০ ফেব্রুয়ারি রাতে নিউ মার্কেট থানা এলাকায় একটি পানশালায় গিয়েছিলেন নীতীশ ও অমিত। সেখানকার মিউজিক ব্যান্ডে নীতীশের টাকা খাটে। রাজীবও ওই পানশালায় হাজির হন। আগাম পরিকল্পনা মতো রাজীব নীতীশকে জানায়, সোনারপুরে সে একটি পানশালা খুলতে চায়। তার জন্য যে জমিটি পাওয়া গিয়েছে, সেটি নীতীশকে দেখাতে চায় সে। কারণ, নীতীশের এ ব্যাপারে অনেক অভিজ্ঞতা রয়েছে। পুলিশের বক্তব্য, অমিতও শ্বশুরমশাইকে রাজীবের জমি দেখে আসতে অনুরোধ করে। নীতীশকে নিয়ে রাজীব সোনারপুরে রওনা হয়। আর পরিকল্পনা মতো অমিত ওই পানশালা থেকে খিদিরপুরের বাড়িতে চলে যায়।
তদন্তকারীরা জানিয়েছেন, নীতীশকে সঙ্গে নিয়ে রাজীব সোজা চলে যায় সোনারপুরের মহামায়াতলায়, তার ফ্ল্যাটে। সেখানে আগে থেকেই অপেক্ষা করছিল শঙ্কু এবং বিশ্বজিৎ। পুলিশের দাবি, জেরায় রাজীব স্বীকার করে, ওই ফ্ল্যাটেই শ্বাসরোধ করে খুন করা হয় নীতীশকে।
কী ভাবে পাচার হল ওই ব্যবসায়ীর দেহ? পুলিশের দাবি, জেরায় শঙ্কু ও বিশ্বজিৎ জানিয়েছে, কোন রাস্তা দিয়ে দেহটি পাচার করা হবে, তা ঠিক করতে তারা রাজীবকে নিয়ে একটি গাড়িতে করে বেরোয়। নীতীশের মানিব্যাগটিও তাদের সঙ্গে ছিল। পাটুলির কাছে এসে একটি পুকুরে সেটি ফেলে দেয় তারা। এই মানিব্যাগটিই পরে উদ্ধার করে পুলিশ। তদন্তকারীরা জানান, রাজীব ও তার সঙ্গীরা এর পরে ফিরে যায় মহামায়াতলার ফ্ল্যাটে। সেখান থেকে দেহটি গাড়ির ডিকিতে ভরে তারা নিয়ে যায় কলকাতা লেদার কমপ্লেক্স এলাকায়। সেখানে দেহটি ফেলার সুযোগ মেলেনি। পুলিশের দাবি, শেষমেশ বাইপাস, গড়িয়া হয়ে সোনারপুরের খেয়াদা এলাকার খালে তারা দেহটি ফেলে দেয় বলে জানায় ওই তিন জন।
কী ভাবে ধরা পড়ল অমিত ও তার সঙ্গীরা?
নীতীশের দেহটি উদ্ধারের পরে সোনারপুর থানার আইসি প্রসেনজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে পুলিশের একটি দল তদন্ত শুরু করে। পুলিশের দাবি, নীতিশের মোবাইলের ‘কল ডিটেলস’ থেকে জানা যায়, ২০ ফেব্রুয়ারি অমিত এবং রাজীবের সঙ্গে একাধিক বার কথা হয় তাঁর। অমিত ও রাজীবের ফোনের কল ডিটেলস থেকে খোঁজ মেলে শঙ্কু এবং বিশ্বজিতের। পুলিশের এক ‘সোর্স’ও জানিয়ে দেয়, অমিতের সঙ্গে শঙ্কু ও বিশ্বজিৎকে কয়েক বার বিভিন্ন পানশালায় দেখা গিয়েছে। এর পরেই তদন্তকারীরা জেরা করতে শুরু করেন অমিত ও রাজীবকে। পুলিশের দাবি, জেরায় রাজীবই প্রথমে বলে দেয় খুনের পরিকল্পনার কথা। সেই সূত্র ধরে গ্রেফতার করা হয় শঙ্কু ও বিশ্বজিৎ। শেষে ধরা পড়ে অমিতও। |