ক্লাসে পড়ুয়ারা হা-পিত্যেশ করে বসে রয়েছেন শিক্ষকের জন্য। অথচ শিক্ষক-চিকিৎসক তখন বেসরকারি হাসপাতালে রোগী দেখতে কিংবা অস্ত্রোপচার করতে ব্যস্ত!
রোগীদের ফাঁকি দিয়ে সরকারি হাসপাতালের চিকিৎসকদের প্রাইভেট প্র্যাকটিসের ‘রেওয়াজ’ ছিলই। এ বার শুধু রোগী নয়, ডাক্তারি পড়ুয়াদের ফাঁকি দিয়ে বেসরকারি হাসপাতালে অস্ত্রোপচার করা বা রোগী দেখার অভিযোগ উঠল মেডিক্যাল কলেজগুলির শিক্ষক-চিকিৎসকদের একাংশের বিরুদ্ধে। স্বাস্থ্যকর্তাদের একটা বড় অংশও মেনে নিচ্ছেন, সরকারি চিকিৎসকদের প্রাইভেট প্র্যাকটিস নিয়ে রাজ্য সরকার যতই নিয়ম নীতি তৈরি করুক, কার্যত তাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়েই এমনটা চলছে বিভিন্ন মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে। তাঁদের আশঙ্কা, এমনিতেই
এ রাজ্যে মেডিক্যাল শিক্ষার মান নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে। তার উপরে পঠনপাঠনও যদি এমন অনিয়মিত হয়, তা হলে তার হাল কী দাঁড়াবে?
রাজ্যের স্বাস্থ্য-শিক্ষা অধিকর্তা সুশান্ত বন্দ্যোপাধ্যায় অবশ্য বলেছেন, “এই অনিয়ম একেবারেই বরদাস্ত করা হবে না। মেডিক্যাল কলেজগুলির অধ্যক্ষদের ডেকে এ বিষয়ে সতর্ক করে দেব। যে যে মেডিক্যাল কলেজ থেকে এই ধরনের অভিযোগ আসবে, সেখানে সংশ্লিষ্ট শিক্ষক-চিকিৎসকের পাশাপাশি অধ্যক্ষদেরও জবাবদিহি করতে হবে।”
কলকাতার কয়েকটি মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালের একাধিক বিভাগের শিক্ষক-চিকিৎসক তাঁদের ক্লাসের সময়ে বেসরকারি হাসপাতালে উপস্থিত থাকছেন, এমন অভিযোগ তুলেছেন পড়ুয়ারাও। মূলত পড়ুয়াদের অভিযোগই বেশি ভাবিয়ে তুলেছে স্বাস্থ্যকর্তাদের। এসএসকেএম হাসপাতালের এক এমবিবিএস পড়ুয়ার অভিযোগ, “প্র্যাক্টিক্যাল ক্লাসে বেশ কয়েক জন স্যার নিয়মিত অনুপস্থিত থাকেন। আমরা খবর নিয়ে জেনেছি, ওই একই সময়ে আলিপুরের এক বেসরকারি হাসপাতালে তাঁদের পাওয়া যায়।”
কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের এক এমবিবিএস পড়ুয়া আবার অভিযোগ করলেন, “আমাদের লেকচার ক্লাসের সংখ্যা খুবই কম। তাতেও মাঝে-মধ্যে স্যাররা থাকেন না। এ ভাবে আমরা কী-ই বা শিখব।”
দিন কয়েক আগে সাগর দত্ত মেডিক্যাল কলেজ পরিদর্শনে এসে সেখানকার বেহাল পরিকাঠামো স্বচক্ষে দেখে গিয়েছিলেন ‘মেডিক্যাল কাউন্সিল অফ ইন্ডিয়ার’ প্রতিনিধিরা। তখন স্বাস্থ্য-শিক্ষা অধিকর্তার মন্তব্য ছিল, “কে আর কবে সব শিখে বেরোয়? কাজ করতে করতে সব শিখে নেয়।” এ ক্ষেত্রে কী বলছেন তিনি? সুশান্তবাবুর মন্তব্য, “হাতে-কলমে কাজ শেখার গুরুত্বের কথা কেউ অস্বীকার করতে পারবেন না। সেটাই বলতে চেয়েছি। তা বলে সরকারের কাছ থেকে বেতন নিয়ে কেউ অন্যত্র কাজ করে যাবেন, সেটা বরদাস্ত করা হবে না।”
কর্তৃপক্ষ কেন কোনও ব্যবস্থা নেন না? এক মেডিক্যাল কলেজের অধ্যক্ষ বলেন, “ব্যবস্থা তো স্বাস্থ্য দফতরের নেওয়ার কথা। আমরা এর আগে একাধিক বার বিষয়টি স্বাস্থ্য ভবনে জানিয়েছি। কিন্তু কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। আমরা শুধু এগুলো বলে অপ্রিয় হচ্ছি।” এসএসকেএম সূত্রের খবর, প্রাইভেট প্র্যাকটিস ঠেকাতে হাসপাতালের এক কর্তা নিজে সংশ্লিষ্ট কয়েকটি বেসরকারি হাসপাতালে হানা দিয়ে কয়েক জন চিকিৎসককে হাতেনাতে ধরেছিলেন। স্বাস্থ্য ভবনে সেটা জানানোর পরেও কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। কলকাতা মেডিক্যালের প্রাক্তন এক অধ্যক্ষও কোন কোন সরকারি চিকিৎসক কখন ক্লাস ফাঁকি দিয়ে কোন কোন বেসরকারি হাসপাতালে ডিউটি করেন, তার তালিকা তৈরি করেছিলেন। কিন্তু তাতেও বিষয়টি বন্ধ করা যায়নি।
কলকাতার একটি মেডিক্যাল কলেজের অধ্যক্ষ বলেন, “মেডিক্যাল শিক্ষার বড় অংশ জুড়ে থাকে প্র্যাক্টিক্যাল ক্লাস। হাসপাতালের প্রতিটি ইউনিটে তিন-চার জন করে চিকিৎসক থাকেন। বহু সময়েই দেখা যায়, ওই তিন-চার জনের মধ্যে থেকে এক জন চলে যান। তাঁদের নিজেদের মধ্যে ব্যবস্থা থাকে। এক এক দিন এক এক জন চলে যান। যে হেতু ক্লাস বাতিল হয় না, তাই সহজে বিষয়টা ধরা পড়ে না।” ক্লাসের সময়ে মেডিক্যাল কলেজে নিজের উপস্থিতির প্রমাণ হিসেবে চিকিৎসকেরা অনেকেই নিজেদের গাড়ি হাসপাতালে রেখে ট্যাক্সি নিয়ে অন্যত্র চলে যান বলেও জানিয়েছেন মেডিক্যাল কলেজগুলির অধ্যক্ষরা।
তা হলে কি সরকারি চিকিৎসকদের প্রাইভেট প্র্যাকটিসের অনুমোদনের বিষয়টি নিয়ে নতুন করে ভাবতে হবে স্বাস্থ্য দফতরকে? দফতরের এক শীর্ষ কর্তা বলেন, “প্রাইভেট প্র্যাকটিস রাতারাতি বন্ধ করে দেওয়া যাবে না। তবে রাশ টানতে নতুন লাগাম পরাতে হবে। সে নিয়ে ভাবনা-চিন্তা চলছে।” |