লাভ কী হল, প্রশ্ন তুলে দিল দুই প্রান্তের সমান ভোগান্তি
পথ-দাপটের টক্করে রুদ্ধ তিলোত্তমা
ওহরলাল নেহরু বলেছিলেন ‘মিছিল-নগরী’।
শনিবারের বারবেলায় সেই ‘মিছিল-নগরী’র পুনর্জন্ম হল! যখন কলকাতা শহরের দুই প্রান্ত অবরুদ্ধ করে শাসক এবং বিরোধী পক্ষ তাদের ‘শক্তি জাহির’ করতে রাস্তায় নেমে পড়ল। শাসক পক্ষের মিছিলের পুরোভাগে রইলেন স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। যাঁকে মাত্র ন’মাস আগে বিপুল ভোটে জিতিয়ে ক্ষমতায় এনেছেন রাজ্যের মানুষ। আর বিরোধী পক্ষের মিছিলের নেতৃত্ব দিলেন প্রধান বিরোধী দল সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক বিমান বসু। সবেমাত্র যিনি ‘সফল’ ব্রিগেড সমাবেশ করে উঠেছেন!
সে অর্থে কারও কাছেই কি এই ‘শক্তি প্রদর্শন’ জরুরি ছিল? বিশেষত, যখন নিজের নিজের ‘শক্তি’ তাঁরা সদ্যই প্রমাণ করেছেন? বিশেষত, আমজনতাকে অশেষ দুর্ভোগে ফেলে? যাদের সঙ্গে দুই মিছিলেরই বিন্দুমাত্র সম্পর্ক নেই?
সাধারণ মানুষ বলবেন, ছিল না। যাঁরা মমতার সৌজন্যে ‘যাদবপুরে বঙ্গদর্শন’ (মুখ্যমন্ত্রীর মিছিলকে ‘সফল’ করতে যাদবপুরে মূলত দক্ষিণবঙ্গ-সহ প্রায় গোটা রাজ্য থেকে লোক তুলে আনা হয়েছিল) করলেন, তাঁরা যেমন বলবেন, ছিল না। তেমনই তাঁরাও বলবেন ‘ছিল না’, যাঁরা সিপিএমের মিছিলের জন্য ভিআইপি রোড বা নিউটাউন রোডে আটক হয়ে বিবিধ উড়ান ধরতে পারলেন না।
তবে যুযুধান দু’পক্ষ বলবেন, ছিল।
যাদবপুরে তৃণমূলের মিছিল। নেতৃত্বে মুখ্যমন্ত্রী স্বয়ং। শনিবার অশোক মজুমদারের তোলা ছবি।
রাজ্যের শিল্পমন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় যেমন ‘প্রত্যয়ী’ কণ্ঠে বলেছেন, “প্রাক্তন সেনাধ্যক্ষের সঙ্গে বর্তমান সেনাধ্যক্ষের তফাত সাধারণ মানুষ বুঝতে পেরেছেন। মমতা আর জনতা যে সমার্থক, সেটা প্রমাণ হয়ে গিয়েছে।’’ আর ‘উচ্ছ্বসিত’ বিমানবাবুর কথায়, “জনজোয়ার। আড়াই ঘণ্টা ধরে মিছিল হয়েছে। এ-প্রান্ত থেকে থেকে ও-প্রান্ত দেখা যাচ্ছিল না!” মমতার মিছিলকে ‘কটাক্ষ’ করে সিপিএম রাজ্য সম্পাদকের বক্তব্য, “হাওড়া-হুগলি-বর্ধমান থেকে লোক আনা হয়েছে। আমাদের মিছিলে কিন্তু উত্তর ২৪ পরগনা জেলা ছাড়া আরও কোনও জায়গা থেকে লোক আসেনি।” যার জবাবে আবার রাজ্যের মন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক বলেছেন, “ওদের মিছিলে হাওড়া-হুগলি থেকে লোক আনা হয়েছিল। কোনও স্থানীয় মানুষ ছিলেন না।” মন্ত্রী জানিয়েছেন, আজ, রবিবার রাজারহাটে তাঁরা স্থানীয় মানুষকে নিয়ে মিছিল করে সিপিএমকে দেখিয়ে দেবেন! অর্থাৎ, রবিবারের সন্ধেতেও বিমানবন্দরগামী নাগরিকদের জন্য আগাম ‘সতর্কতা’ রইল!
কিন্তু তার আগে এ দিন যে ছবি রাজ্যবাসী দেখলেন, তাতে মনে হওয়া অস্বাভাবিক ছিল না যে, দিন দুয়েকের মধ্যেই কোনও ভোট আছে এ শহরে।
তথ্য অবশ্য বলছে, কলকাতা পুরসভার ভোট সেই ২০১৫ সালে। বিধানসভা ভোট তারও এক বছর পর। মাঝখানে ২০১৪ সালে লোকসভা ভোট হওয়ার কথা। অথচ এ দিন কলকাতা শহরের দু’প্রান্তে যে দৃশ্য দেখা গেল, তাতে মনে হচ্ছিল ৪৮ ঘণ্টা পরেই বড়সড় ভোট। যুযুধান শাসক এবং বিরোধী পক্ষ প্রচারের শেষ প্রহরে নিজের নিজের শক্তি প্রদর্শন করতে নেমেছে রাস্তায়।
যার নিট ফল আমজনতার প্রবল ভোগান্তি।
রাজারহাটের পুরপ্রধানকে ‘হেনস্থা’র প্রতিবাদে সিপিএমের যে মিছিল বাগুইআটি এবং লাগোয়া এলাকা পরিক্রমা করল, তার জন্য ভিআইপি রোডে সার দিয়ে থমকে গিয়েছে গাড়ি। নিউটাউন রোড আটকে গিয়ে বিমানবন্দরে যাওয়ার দ্বিতীয় পথও বন্ধ। ফলে উড়ান ধরতে পারেননি বহু মানুষ। আর তৃণমূলের ‘সংগঠিত’ মিছিল রুদ্ধ করে দিয়েছে রাজা সুবোধ মল্লিক রোডের একটি লেন। যে মিছিল আদতে ডাকা হয়েছিল প্রথমত, প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের নেতৃত্বে সিপিএমের মিছিলের ‘পাল্টা’ হিসেবে। দ্বিতীয়ত, বুদ্ধবাবুর মিছিলের পর দিনই তৃণমূলের ‘ফ্লপ’ মিছিলের মোকাবিলায় শাসক পক্ষের ‘মুখ্য আকর্ষণ’ মমতাকে সামনে রেখে। যার আনুষ্ঠানিক বক্তব্য ছিল ‘সিপিএমের চক্রান্তে রাজ্যের উন্নয়নের পথে বাধা দেওয়ার প্রতিবাদে’।
ক’দিন আগে বন্ধ-দেখা শহরে সপ্তাহান্তে দু’টি মিছিলের কোনও প্রয়োজন ছিল কি না, সেই প্রশ্ন বারবার উঠেছে রাজনৈতিক শিবিরেই একটা অংশে।
শাসক শিবিরেরই একাংশের বক্তব্য, “যিনি মাত্র কয়েক মাস আগে রাজ্যের মানুষের রায়ে মহাকরণে বসেছেন এবং আরও প্রায় সাড়ে চার বছর সেখানেই থাকবেন, তাঁকে কেন শক্তি প্রদর্শনের জন্য এ ভাবে রাস্তায় নামতে হবে?” যা খণ্ডন করে আবার অন্য অংশ বলছেন, “দলের নেতা-কর্মীদের উজ্জীবিত করার প্রয়োজন ছিল। মানুষ যে আমাদের সঙ্গেই আছেন, তার একটা ‘শো’ করা জরুরি ছিল।” যে ব্যাখ্যা থেকে স্পষ্ট যে, ‘মানুষের জন্য’ নয়। মিছিল হল ‘মানুষকে দেখাতে’। কোন মানুষ? যাঁরা গত বুধবার প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রীর মিছিল দেখেছেন।
রাজারহাটে বামেদের মিছিল। নেতৃত্বে বিমান বসু এবং গৌতম দেব। শনিবার সুদীপ আচার্যের তোলা ছবি।
স্বভাবতই শাসক-মিছিলে যানজট বা জনতার ভোগান্তি নিয়ে আনুষ্ঠানিক ভাবে মুখ খোলেননি শাসক পক্ষের কেউ। তবে তৃণমূলের প্রথম সারির নেতাদের দাবি, তাঁরা সুবোধ মল্লিক রোডের একটি লেনে মিছিল করেছেন। ফলে অন্য লেন দিয়ে যান চলাচল স্বাভাবিক ছিল। মানুষের কোনও ভোগান্তি হয়নি। মন্ত্রী তথা তৃণমূলের মহাসচিব পার্থবাবুর কথায়, “আমরা তো যানজট না-করার জন্যই একটি লেন দিয়ে মিছিল করেছি। কিন্তু দু’টি লেনের গাড়ি যদি একটি লেন দিয়ে যাতায়াত করে, তা হলে একটু দেরি তো হবেই! তবে মানুষের উদ্দীপনা এবং স্বতঃস্ফূর্ততায় সকলের সমস্ত ভোগান্তিই ম্লান হয়ে গিয়েছে।”
মমতার মিছিল ৮বি বাসস্ট্যান্ড ছাড়িয়ে অবশ্য চলে যায় গড়িয়াহাট পর্যন্ত। তার একটি কারণ যদি হয় ভিড়ের চাপে দুর্ঘটনার আশঙ্কায় বিপুল সংখ্যক মানুষকে ছড়িয়ে দেওয়া, তা হলে অন্য কারণ নিঃসন্দেহে নিজেদের শক্তিকে আরও কিছুদূর বিস্তৃত করা। শক্তির সঙ্গেই অবশ্য দক্ষিণ কলকাতা জুড়ে ছড়িয়ে গেল যানজটও। লেক গার্ডেন্স, সাদার্ন অ্যাভিনিউ, ল্যান্সডাউন, রাসবিহারী, দেশপ্রিয় পার্ক, গড়িয়াহাটে দাঁড়িয়ে যায় সার সার গাড়ি।
সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক অবশ্য প্রথামাফিক ‘ক্ষমা প্রার্থনা’ করেছেন। বিমানবাবুর কথায়, “যানজট হয়েছে। যে জন্য আমাকেও গাড়ি ছেড়ে মোটরবাইকে করে মিছিলে আসতে হয়েছে। অনেকেরই উড়ান ধরতে বিলম্ব হয়েছে। ভিআইপি রোডের উপর যাতে চাপ না-বাড়ে, তাই রাজারহাট রোড দিয়ে মিছিল নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা হয়েছিল। কিন্তু উদ্যোক্তাদের ধারণা ছিল না যে, প্রায় ৩০ হাজার মানুষ চলে আসবেন।
আমি দুঃখিত। মানুষের দুর্ভোগের জন্য আমি দলের তরফে মানুষের কাছে ক্ষমাপ্রার্থী।”
এমন ‘ক্ষমা’ অবশ্য বিমানবাবু চেয়েই থাকেন। বিশেষত, তাঁদের ডাকা বন্ধে বা ব্রিগেড সমাবেশে যখন মানুষের দুর্ভোগ হয়। তবে তখন ক্ষমা প্রার্থনাটা আগাম হয়। এ দিন হয়েছে দুর্ভোগ-উত্তর। টানা আড়াই ঘণ্টা ধরে বাগুইআটি থেকে নারায়ণপুর পর্যন্ত সাত কিলোমিটার রাস্তা সাধারণ মানুষকে তাঁদের ‘দাপট’ দেখানোর পর। মিছিলকারীরা গোটা রাস্তা জুড়ে হেলেদুলে চলার পর। যাঁদের পিছু পিছু ধীরতর গতিতে চলেছে অসহায় গাড়ির দঙ্গল। ভিআইপি রোডে বিমানবন্দরের এক নম্বর গেট থেকে দমদম পার্ক পর্যন্ত, লেকটাউন, কেষ্টপুর, বাগুইআটি, যশোর রোডের সঙ্গে সংযোগ রক্ষাকারী রাস্তা, দমদম, তেঘরিয়া, নিউ টাউন, রাজারহাট, বারাসত, মধ্যমগ্রাম পর্যন্ত যে ‘দাপটে’র ভুক্তভোগী হন সাধারণ মানুষ।
সেই ১৯৬৪ সালে প্রয়াত হয়েছেন নেহরু। ‘তিলোত্তমা’র মিছিল-কল্লোল বুঝিয়ে ছাড়ল অর্ধ শতাব্দী পরেও তিনি সমান প্রাসঙ্গিক।
 
 
 


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.