খেলা
জ বিল্টুর মন খারাপ। চুপ করে এক জায়গায় ও গুম হয়ে বসে আছে। মা সমানে তাকে বকে চলেছে। সামনে পরীক্ষা। ও ক্লাস ফাইভে পড়ে। সিক্সে উঠবে। অ্যানুয়াল পরীক্ষা। অঙ্কটা কিছুতেই বাগে আসছে না। মাস্টারমশাই বাড়িতে পড়িয়ে এইমাত্র চলে গেলেন। তিনি কিছুতেই সন্তুষ্ট নন বিল্টুর উপর। বাবা বাড়িতে নেই। অফিসের কাজে বাইরে গিয়েছেন। দাদু ইজিচেয়ারে আধশোয়া। মাস্টারমশাই মাকে নালিশ করেছেন, ‘বিল্টু অমনোযোগী। অঙ্কটা কিছুতেই শিখছে না। এ রকম করলে ভাল নম্বর পাওয়া মুশকিল। ইত্যাদি।’ তাই মাকে ও দাদুকে একটু বেশি করে কেয়ার নিতে বলেছেন।
মা আজ খুব বকাবকি করছেন। দাদু বলছেন, ‘ঠিক করে পড়। না হলে বাবার মতো হবি কী করে? জানিস, আমাদের বংশে সব কত পণ্ডিত মানুষ আছে। অঙ্কে বাঘা ছিলেন আমার ঠাকুরদা, তার বাবা। আর তুমি ছিঃ! পড় ভাল করে। সারা দিন শুধু খেলা আর খেলা।’
মা বলছেন, ‘খেলার অনেক সময় পাবে। কিন্তু পরীক্ষায় ফেল করলে বাবা তোমাকে দেখো কী করে।’ বিল্টু চুপচাপ বসে বসে শুনছে। ভাল লাগছে না। ও কী যে করে। চেষ্টা তো করে প্রচুর। কিন্তু বজ্জাত অঙ্কগুলো না মিললে ও কী করে। ওর একদম ভাল লাগে না অঙ্ক করতে। কী যে শক্ত সব। তবে বেশ ভাল লাগে ইতিহাস পড়তে। রাজায়-রাজায় যুদ্ধ, নতুন সভ্যতার আবিষ্কার হরপ্পা-মহেঞ্জোদড়ো। খুব লাগে সম্রাট অশোককে। ছিলেন প্রচণ্ড যুদ্ধবাজ, রক্তপিপাসু রাজা, কেমন বদলে গেলেন। হলেন বুদ্ধের ভক্ত। লোকের মঙ্গল করলেন। রাজা পুরু কেমন বীর। আলেকজান্ডারকেও ভয় পেলেন না। আকবর খুব ভাল। বিল্টু ওদের মতো হতে চায়। কই ওরা তো অঙ্কে অত সুপণ্ডিত কি? তবে কি ওরা সব বাজে লোক?
মা, দাদু, বাবা বুঝতেই চায় না। ওদের ঝাউতলা লেনের বিশাল বাড়িটা গাছে গাছে ফুলে ফুলে ভরা। চার দিকে বিশাল বাগান। মালি পরেশদা রোজ বাগান পরিষ্কার করে। এখন তো সন্ধেবেলা হব হব করছে। তাই ওই বড় সূর্যটা লাল থালার মতো পশ্চিম আকাশে ডুবে যাচ্ছে। একটা ছোট তারা আকাশের এক কোণ থেকে হাল্কা উঁকি মারছে। একটা কোকিল রোজ এই সময়টা ডাকে। সামনের বড় বট গাছটায় পাখিরা কিচিরমিচির করে রোজ এই সময়।
বিল্টু মনমরা হয়ে ওদের দেখছে। রোজই এই সময় ও দেখে। খুব আনন্দ হয়। এ সময় পাখিরা বাড়ি ফিরে আসে। খুব খানিকটা গান গেয়ে, হুটোপাটি করে বাসায় ঘুমিয়ে পড়ে। আবার রোজ ভোরে ওঠে। বিল্টু দেখেছে ওটা। মাকে জিজ্ঞেস করেছিল বিল্টু। ‘মা রোজ অত সকালে কী করে ওঠে বল তো?’ মা ধমক দিয়েছিল, ‘তোমাকে অত দেখতে হবে না। তুমি পড়তে বসো। যাও।’ খুব মনখারাপ হয়ে গিয়েছিল ওর। দাদুকে আজ জিজ্ঞেস করবে ভেবেছিল। কিন্তু মা আর দাদু আজ তাকে খুব বকছে। আজ আর ভাল লাগছে না। সামনের ইউক্যালিপটাস গাছগুলো হাওয়ায় দুলছে। সুন্দর একটা গন্ধ ছাড়ছে। বিল্টু ভাবে বড় হলে ও সম্রাট আকবর হবে। আর ও পরেশদাকে ওর বাগানের মালি রাখবে। পরেশদা খুব যত্নে বাগান করে। পরেশদার হাতে গোলাপফুল খুব ভাল ফোটে। ওদের বাগানে অসংখ্য গোলাপ গাছ। আরও অনেক ফুল-ফল গাছ। একটা বড় নিম গাছও আছে। সম্রাট আকবরেরও একটা বিশাল বাগান ছিল। তাতে ছিল অসংখ্য গোলাপ। এখন কোথায় বাগানে বেড়াবে, তা না, বসে বসে অঙ্ক করতে হচ্ছে। ভাল লাগে না ওর। কিন্তু কী করবে ও। মায়ের হুকুম।
পরেশদা বাগানে কাজ করছে। একটা কাঠবেড়ালি খুব নাচানাচি করছে। আকাশটা লাল হয়ে আছে। বাবা বলেছিল, ‘এই সময় রামচন্দ্র আকাশে রথ নিয়ে বেরোন তো। তাই রথের চাকার ঘর্ষণে চার দিক লাল হয়ে যায়।’ রোজ ভাবে আজ রামচন্দ্রকে ও দেখবে কিন্তু দেখতে পায় না। ‘কোথা দিয়ে যে উনি যান, পরেশদাকে জিজ্ঞেস করতে হবে।’
পাশের বাড়ির রানা আর মনা বল খেলছে। ওদের হাসির আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে। ওরও খুব খেলতে ইচ্ছে করে কিন্তু মা’র বারণ। একরাশ হোমওয়ার্ক। মা এখন একরাশ কলেজের খাতা নিয়ে দেখতে বসেছেন। এখন বেচারা বিল্টুকেও যত রাজ্যের শক্ত শক্ত অঙ্ক করতে হবে। মা-র বেশ মজা। পড়তে হয় না, পড়াতে হয়। বড় হয়ে ও মা-র মতোও হতে পারে।
দাদুর সঙ্গে পাশের পাড়ার সিধুদাদু দেখা করতে এসেছে। রোজই আসেন উনি। দু’জনে গল্প করেন। সিধুদাদু দারুণ মজার সব গল্প বলতে পারেন। বিল্টুকে অনেক গল্প শুনিয়েছেন। বিশেষ করে ওঁর ফুটবল খেলার গল্পগুলো। ওর বিকেলে সময় হয় না বলে খেলতে যেতে পারে না। ইস্, আজও গল্প শোনার ইচ্ছে ছিল। কিন্তু আজ অবস্থা অন্য রকম। এখন একমনে ওকে শুধু অঙ্ক করতে হবে। কী আর করবে ও। ও একা বড় ঘরটার টেবিলে বসে অঙ্ক করছে। বাইরে সেই কোকিলটা আবার ডেকে উঠল। এক দৃষ্টিতে বিল্টু পাখিটার দিকে তাকিয়ে আছে। মনটা খুবই খারাপ।
বিল্টু, বিল্টু, এই বিল্টু। বিল্টু চমকে উঠে তাকিয়ে দেখল, এ কী! এ তো বিল্টু একটা বড় বাগানে দাঁড়িয়ে। বিল্টু দারুণ ক্রিকেট খেলে। ওর একটা ব্যাটও আছে বাবা কিনে দিয়েছিল। ওর দিকে তাকিয়ে লোকটা ওকে ডাকছে। গায়ে দারুণ কাজ করা জরির পোশাক। বিল্টু অবাক। এ কী কে ও? অনেকগুলো লোক ও দিকে ঘুরছে। বিল্টুর যেন চেনা চেনা লাগল। ইতিহাস বইয়ের পাতায় মনে হল যেন দেখেছিল। লোকটা আবার ডাকল। ‘কী বিল্টুবাবু, আমাকে চিনতে পারলে না তো? আমি সম্রাট অশোক।’ এ বার বিল্টু চিনতে পারল। তাই তো, ইতিহাস বইয়ে তো এই ছবিটাই ছিল। ও বলল, ‘আরে আপনিই তো অশোক। আপনার ছবি দেখেছি।’ ‘অবাক হচ্ছ কেন? আমাদের তো আজ ক্রিকেট খেলা চলছে। আকবরও তো আছে।’ অবাক হল ও।
দেখে আরে, সোনালি দাড়িওলা একটা লোক ভীষণ জোরে বল ছুড়ছে। সম্রাট অশোক বললেন, ‘লোকটাকে চেনো?’ তাই তো কে ওটা? বিল্টু তো চিনতে পারছে না। ‘আরে উনি পুরু রাজা। আলেজান্ডারকে বল ছুড়ছেন।’ অশোক বললেন, ‘কী হে, খেলবে নাকি? তুমি তো দারুণ ক্রিকেট খেলো?’ বিল্টু অবাক, সম্রাট অশোক জানলেন কী করে? ও অবশ্য ভালই খেলে। পাশের বাড়ির কোনও ছেলে ওর মতো জোরে বল মারতে পারে না। ও রাজি হল।
খেলা শুরু হল। ওর দিকে আকবরও আছেন। অশোকও। আকবরকে কী সুন্দর দেখতে। অবাক কাণ্ড! পরেশদা সম্রাট আকবরকে গোলাপফুল দিচ্ছে। কাছে যেতেই আকবর বাদশা হাসলেন। সস্নেহে বিল্টুর পিঠে হাত রাখলেন। ‘কী হে, বিল্টুবাবু তোমাকে আমার দলে খেলতে হবে।’ বিল্টু কেঁদে ফেলল।
আকবর বাদশাহ ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। ‘আহা, কাঁদছ কেন?’
বিল্টু বলল, ‘আমি একদম অঙ্ক পারছি না।’ আকবর খুব চিন্তিত হলেন। চারি দিকে চুপি চুপি এক বার তাকিয়ে নিয়ে বিল্টুর কানে কানে বললেন, ‘জানো বিল্টু, আমিও খুব ভাল অঙ্ক জানি না। ওই যে অশোক ও-ও খুব একটা ভাল জানে না।’ বলে হাসতে লাগলেন।
হঠাৎ সামনে আলেকজান্ডার চলে এলেন। ‘আরে বিল্টু যে? কী, খেলবে তো? আরে বিকেলে সব সময় খেলতে হয়। তবে তো চাঙ্গা হবে, না কি? চলো চলো।’
বিল্টু হ্যাঁ বলল। বলেই আবার ভ্যাঁ করে কেঁদে ফেলল। আলেকজান্ডার অবাক ‘কী হল? খিদে পেয়েছে?’ বলেই পকেট থেকে একটা বড় আপেল বের করে বিল্টুর হাতে দিলেন। ‘খেয়ে নাও। এটা মধ্য এশিয়া থেকে এনেছি।’
হঠাৎ তৈমুর লং-ও এসে হাজির। উনি একটা আখরোট খেতে দিলেন। বিল্টু আবার কাঁদতে কাঁদতে বলল যে, ও একটাও অঙ্ক পারছে না। সবাই খুব বকাবকি করছে।
সম্রাট অশোক, আকবর বাদশাহ, আলেকজান্ডার, তৈমুর লং, পুরু রাজা, সবাই ওর দিকে করুণ চোখে তাকিয়ে রইলেন। বললেন, ‘আমরাও কেউ যে ভাল অঙ্ক জানি না। বেশি অঙ্ক জানলেই তো গোলমাল। কারণ, বেশি বুদ্ধিমান হয়ে যাবে যে। আর মানুষ বেশি বুদ্ধিমান হলেই মুশকিল, কেউ মারণাস্ত্র তৈরি করবে, কেউ বিপ্লব করবে, কেউ ধর্মের নামে লোক খ্যাপাবে, ঠকাবে, আরও কত কিছু করবে। তার চেয়ে চলো এখন খেলি।’ বিল্টু এ বার রেডি হল। সামনে একটা বল পড়েছিল, যেই সে ওটা ছুড়েছে অমনি সামনের কাচের জানলায় ঝনঝন আওয়াজ।
চমকে উঠল বিল্টু। মা হঠাৎ ডাকছেন। ‘বিল্টু, বিল্টু, এ কী, তুমি ঘুমোচ্ছে!’ আবার একপ্রস্থ বকাবকি। ‘বইটা ছুড়লে কেন? দেখেছ কাচের জানলাটা কেমন ভেঙে গেল। তুমি অঙ্ক করছ না। খালি ঘুমোচ্ছ। বাবা আসুক। বলে দেব। তুমি পড়ার নামে ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে বই, খাতা, পেন ছুড়ছ, ছি ছি। তোমার আর কিচ্ছু হবে না।’
দাদুও ছুটে এসে বকতে লাগলেন। খালি সিধুদাদু বলল, ‘বেচারা খেলতে না পেয়ে বোধ হয় এমন করেছে।’ সবাই হাঁ হাঁ করে উঠল।
কেউই বিল্টুর কথা শুনল না। অশোক, আকবর, আলেকজান্ডারের কথা বলতে গিয়ে বকুনি খেল খুব। হঠাৎ তাকিয়ে দেখে, আরে! এটা তো সেই আপেলটা। ওকে আলেকজান্ডার দিয়েছিলেন। তবে কি সবই সত্যি! তা হলে ও এত ক্ষণ স্বপ্ন দেখেনি। একমাত্র পরেশদা বোধ হয় সব জানে। বাকি আর কেউ যে বিশ্বাসই করছে না, তা হলে?

ছবি: ওঙ্কারনাথ ভট্টাচার্য


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.