মাটির মানুষ
চাক-মাটির ছন্দে ঝুমুর বাঁধেন গোবর্ধন
পুরুলিয়া শহর থেকে প্রায় ৪০ কিলোমিটার দূরে চেলিয়ামা। চেলিয়ামার পাশেই সগড়কা গ্রাম। গ্রামের একপ্রান্তে কুমোর গোবর্ধন পালের সবকিছু। যদিও এ সব সাদামাঠা তথ্যের উপর ভিত্তি করে গোবধর্র্ন পালের সঙ্গে আরও কারও তফাৎ খুঁজতে যাওয়াটা একেবারেই উচিত হবে না। তবু আর পাঁচজনের থেকে নিজেকে আলাদা করে ফেলেছেন সগড়কার গোবর্ধন।
নিজস্ব চিত্র।
সগড়কার এই মাটির কারিগর নিজের কুমোর পরিচয়ের আড়ালে দিনের পর দিন লালন করে গিয়েছেন আর এক পরিচয়। তা হল ঝুমুর গানের একনিষ্ঠ এক সেবক। যিনি হাতের কারসাজিতে একতাল মাটিকে যেমন নানা আকার দিতে পারেন, তেমনই কাজের মধ্যেই বেঁধে ফেলেন ঝুমুর গান। কাজের ছন্দেই তাতে বসিয়ে দেন সুর। গেয়ে ওঠেন কলির পর কলি। এ ভাবেই গোবর্ধন তৈরি করেছেন একাধিক ঝুমুর গান।
তবে গান বাঁধতে গিয়ে সাম্প্রতিক বিষয়বস্তুকে সযত্নে এড়িয়ে চলেন শিল্পী। রং ঝুমুর, যার ভিত্তি সময়ানুগ ঘটনা, সামাজিক কেচ্ছা তার ধার দিয়েও যান না গোবর্ধন। বলেন, “উগুলা তো ছেলে-ছোকরার ব্যাপার। আমি বুড়া হচ্ছি। দেবদেবীর কাহিনীই আমার পছন্দ।” কথার মধ্যেই হঠাৎ থামিয়ে দেন ঘুরন্ত চাক। পাশেই রাখা জলের পাত্রে হাত ধুয়ে চাককে নমস্কার করে ফের বলতে শুরু করেন, “কোন ঝুমুর গান শুনবেন? ঠিক আছে, মহাপ্রভুকে (শ্রীচৈতন্য) দিয়েউ শুরু করি।”
গেয়ে ওঠেন শিল্পী,
ওলো সই, গোরা যায় ডহর ভাঙা পথে
পায়ে লাগে পাথর-কাঁটা গো
রাঙা পথে রক্ত চাপে
রহে যায় ছাপ গো
’।
কথিত আছে শ্রীচৈতন্য পুরুলিয়ার সাঁতুড়ি হয়ে পাকবিড়রায়, বুঁদপুর বারাণসী হয়ে মথুরা যান। এর প্রমাণ মেলে চৈতন্যচরিতামৃতে। এবং কীর্তনের যে পাঁচটি ঘরানা রয়েছ তার মধ্যে ঝাড়িখন্ড (ঝাড়খন্ড) একটি। যা প্রায় লুপ্ত। সেই ঘরানা মিশে গিয়েছে রাগপ্রধান বা দরবারি ঝুমুরে। তারই ভাঙা সুর শোনা গেল প্রান্তবাসী এই শিল্পীর গলায়। নামডাকহীন এই ঝুমুরিয়া নিজের মনের তাগিদেই বেঁধে চলেন একের পর এক গান। তবে এই আঞ্চলিক সংস্কৃতির আশঙ্কা একটাই, এই সমস্ত তৈরি হওয়া গান লেখা থাকে না কোথাও। শিল্পী চলে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সবই নিশ্চিহ্ন। পুরুলিয়ার লোকসঙ্গীতের বহু উপকরণ এ ভাবেই হারিয়ে গিয়েছে, যাচ্ছেও।
ইদানীং অবশ্য নানা সংস্থা, সরকারি পর্যায়ে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক কর্মীদের পুরস্কার দেওয়ার ব্যবস্থা হচ্ছে। অর্থ সাহায্যও পাচ্ছেন কেউ কেউ। এটা আঞ্চলিক সংস্কৃতির বিকাশের ক্ষেত্রে নিঃসন্দেহে একটা ভাল দিক। কিন্তু সামগ্রিক ভাবে আঞ্চলিক সংস্কৃতির যে সম্পদ তার সংরক্ষণ হচ্ছে কোথায়? প্রশ্ন উঠে এল বছর পঁয়ষট্টির কুমোর জীবিকাশ্রয়ী গোবর্ধন পালের কণ্ঠে। বলে উঠলেন, “লিখাপড়া তো ভাল জানি নাই। আপনারা লিখে লিলে থাকবে। না হলে আমি মাটিতে মিশাই গেলে সব ঘুচাই যাবে।”
মহাকালের কাছে এমন ভাবেই নিজের সৃষ্টিকে সঁপে দিলেন ঝুমুরশিল্পী গোবর্ধন পাল।



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.