নির্মাণ হয়নি ফ্লাইওভার, সমস্যায় আদ্রার বাসিন্দারা
দৃশ্য-১: বন্ধ রেলগেটের এক দিকে দাঁড়িয়ে রয়েছে রেলের অ্যাম্বুল্যান্স। অন্য দিকে দমকলের ইঞ্জিন। সাউথ সেটলমেন্ট থেকে অ্যাম্বুল্যান্স যাচ্ছে নর্থ সেটলমেন্টে রোগী আনতে। রঘুনাথপুর থেকে দমকল যাচ্ছে কাশীপুরে আগুন নেভাতে। ঝাড়া আধ ঘণ্টা ধরে অপেক্ষমান ‘জরুরি পরিষেবা’-র দুটি গাড়ি!
দৃশ্য-২: বেলা দশটা। শহরের মধ্যে বন্ধ রেলগেটের এক দিকে দাঁড়িয়ে স্কুলের ছাত্রছাত্রী। অন্য দিকে অফিসগামী লোকজন। রেললাইন ধরে শম্বুকগতিতে যাচ্ছে বিশাল মালগাড়ি। প্রায় ১৫ মিনিট সময় নিয়ে মালগাড়ি চলে যাওয়ার পরে স্কুল ও অফিসে পৌঁছতে ভিড়ের মধ্যে প্রাণান্তকর চেষ্টা।
দুটি দৃশ্যই রেলশহর আদ্রার। কারণ, যাত্রাবাহী ও মালগাড়ির অহরহ যাতায়াত করলেও রেল কর্তৃপক্ষ এখানে উড়ালপুল বা ফ্লাইওভার তৈরি করেনি। তাই প্রতিদিন চরম ভোগান্তিতে পড়তে হয় রেল শহরের বাসিন্দাদের। আদ্রার ডিআরএম অমিতকুমার হালদারও স্বীকার করে নিয়েছেন, “ফ্লাইওভার না থাকার জন্যই এই সমস্যা।” তবে দক্ষিণ-পূর্ব রেলওয়ের জেনারেল ম্যানেজার এ কে বর্মা সম্প্রতি আনাড়ায় এসে এ ব্যাপারে বলেন, “ ফ্লাইওভার নির্মাণের প্রস্তাব শীঘ্রই রাজ্য সরকারকে দেওয়া হবে।”
ডিভিসনের বিভাগীয় শহর আদ্রাকে দু’ভাগে বিভক্ত করেছে দক্ষিণ-পূর্ব রেললাইন। শহরের দক্ষিণ দিকে সাউথ সেটলমেন্টে রয়েছে ডিআরএম-এর কার্যালয়-সহ রেলের বিভিন্ন দফতর, বিভাগীয় হাসপাতাল। আর উল্টো দিকের নর্থ সেটলমেন্টে রয়েছে মূল বাজার-সহ রেলের প্রাথমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক স্কুলগুলি। প্রতিদিনই রেললাইন পারাপার করতে হয় শহরের বাসিন্দাদের। আর এই প্রেক্ষিতেই প্রতিদিন ভোগান্তিতে পড়তে হয় শহরবাসীকে। বস্তুত, আদ্রায় ফ্লাইওভার অথবা একটি সাবওয়ে তৈরি করার দাবি দীর্ঘ দিনের। এগুলির মধ্যে যে-কোনও একটি নির্মিত হলেই রোজকার এই সমস্যার অবসান হত। ঘটনা হল, সময়ের সঙ্গেই এখানে প্যাসেঞ্জার, এক্সপ্রেস ট্রেন ও মালগাড়ির সংখ্যা বেড়েছে। সেই সঙ্গেই রেলগেটে আটকে থাকার যন্ত্রণাও বেড়েছে। পাল্লা দিয়ে জোরালো হয়েছে বিকল্প একটি সড়ক-পারাপার ব্যবস্থার দাবি। অভিযোগ, সেই দাবি কর্ণপাত করেনি রেল দফতর।
আদ্রা রেল শহরে এ ভাবেই জীবনের ঝুঁকি নিয়ে চলছে পারাপার। ছবি: সুজিত মাহাতো।
ভোগান্তি শুধু আদ্রার বাসিন্দাদেরই নয়, ফ্লাইওভার না থাকায় সমস্যায় পড়েন রঘুনাথপুর থেকে কাশীপুরে যাতায়াত করা গাড়ির যাত্রীরাও। আদ্রার মধ্য দিয়েই রঘুনাথপুর থেকে কাশীপুর যেতে হয়। এ ক্ষেত্রেও পেরোতে হয় রেলগেট। অথচ ট্রেন চলাচলের জন্য দিনের মধ্যে বেশির ভাগ সময়েই বন্ধ থাকে রেলগেট। ফলে দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে হয় গাড়িগুলিকে। এই তালিকায় রয়েছে দমকল বা অ্যাম্বুল্যান্সের মতো জরুরি পরিষেবার গাড়িও। এমনকী, বাদ পড়ে না পুলিশের গাড়িও।
কিন্তু প্রশ্ন হল, ফ্লাইওভার না থাকায় সমস্যা দিনে দিনে বাড়লেও কেন সমস্যা সমাধানে ব্যবস্থা নিচ্ছে না রেল মন্ত্রক। রেল সূত্রের খবর, প্রথম ইউপিএ সরকারের রেল মন্ত্রকের কাছে আদ্রায় ফ্লাইওভার কিংবা সাবওয়ে নির্মাণের জন্য একাধিক বার দাবি জানানো হয়েছিল। সেই সময় সংসদে রেলের স্থায়ী কমিটির চেয়ারম্যান ছিলেন আদ্রার বাসিন্দা বাঁকুড়ার সাংসদ বাসুদেব আচারিয়া। তিনি জানান, রেলের স্থায়ী কমিটি রেল মন্ত্রকের কাছে আদ্রায় ফ্লাইওভার নির্মাণের প্রস্তাব একাধিক বার দিলেও কাজ হয়নি। পরবর্তীকালে রেলমন্ত্রী থাকাকালীন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছেও আদ্রায় ফ্লাইওভার নির্মাণের প্রস্তাব তৃণমূলের জেলা নেতৃত্বের তরফে দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু দাবি পূরণ হয়নি। এলাকাবাসীর ক্ষোভ, “সিপিএম বা তৃণমূল কোনও দলই আদ্রার এই অন্যতম বড় সমস্যা সমাধানের ব্যবস্থা নেয়নি।”
রেল সূত্রে জানা গিয়েছে, মূলত দুটি নিয়মের গেরোয় আটকে রয়েছে আদ্রার ফ্লাইওভার নির্মাণের কাজ। প্রথমত, নিয়ম অনুযায়ী রেলগেট দিয়ে মাসে কত গাড়ি ও লোকজন পারাপার করে (রেলের পরিভাষায় ‘ট্রাফিক ভেহিকল ইউনিট’ বা টিভিইউ) তার সমীক্ষা করার পরে ‘মাপকাঠি’ পূরণ হলেই ফ্লাইওভার নির্মাণ করা হয়। আদ্রার ডিআরএম বলেন, “নিয়ম অনুযায়ী মাসে এক লক্ষ ‘টি ভি ইউ’ হলেই সেই এলাকায় ফ্লাইওভার নির্মাণ করা যায়। আদ্রায় সেই সংখ্যা ৫৫,৬৯৩। ফলে কর্তৃপক্ষের কাছে ফ্লাইওভার নির্মাণের প্রস্তাব পাঠালেও ওই নিয়মেই তা আটকে গিয়েছে।” অন্য দিকে, আদ্রায় রেল কর্তৃপক্ষের সমীক্ষা অনুযায়ী, এই এলাকায় ফ্লাইওভার নির্মাণে খরচ পড়বে প্রায় ১২ কোটি টাকা। এর মধ্যে অর্ধেক দেবে রেল মন্ত্রক, বাকি ব্যয় বহন করতে হবে রাজ্য সরকারকে। রেল সূত্রে খবর, ইউপিএ ১ এর সময়ে কেন্দ্রে বামফ্রন্ট সমর্থিত সরকার এবং রাজ্যে বামফ্রন্ট সরকার থাকলেও যেমন রেলের তরফে রাজ্যের কাছে ফ্লাইওভার নির্মাণে ব্যয় বহনের কোনও প্রস্তাব আসেনি, তেমনই একই চিত্র রাজ্যে ‘পরিবর্তনের’ পরেও।
এই প্রেক্ষিতেই দাবি উঠেছে, ফ্লাইওভার নির্মাণে আন্তরিক হোক রেলমন্ত্রক। রেলকর্মী সংগঠন মেনস কংগ্রেসের নেতা সুব্রত দে, রবীন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়রা বলেন, “২০১০ সালের অক্টোবর মাসে তৎকালীন রেলমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে ফ্লাইওভারের দাবি জানানোর পরে আদ্রার রেল কর্তৃপক্ষ সমীক্ষার কাজ করে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে পূর্ণাঙ্গ রিপোর্ট পাঠালেও কাজ কিছুই এগোয়নি।” সুব্রতবাবু বলেন, “টি ভি ইউ নিয়ে তিন বছর আগেই রেল কর্তৃপক্ষ সমীক্ষা করেছে। বর্তমানে সেই সংখ্যা আরও বাড়বে। ফের সমীক্ষা করে ঊর্ধ্বতন রেলমন্ত্রকের কাছে প্রস্তাব পাঠাক আদ্রার রেল কর্তৃপক্ষ।” অপর কর্মী সংগঠন মেনস ইউনিয়নের নেতা গৌতম মুখোপাধ্যায় বলেন, “ফ্লাইওভার না থাকা আদ্রার জ্বলন্ত সমস্যা। রেল মন্ত্রক নিয়মের দোহাই দিয়ে সমস্যার সমাধান করছে না। নিয়মের পাশাপাশি সমস্যাকেও সমান গুরুত্ব দিয়ে দেখা দরকার। কারণ আদ্রায় তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র গঠনের আগে এই অঞ্চলের পরিকাঠামো গঠনে ফ্লাইওভার তৈরি একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অংশ।” তবে এলাকার তৃণমূল বিধায়ক স্বপন বেলথরিয়ার আশ্বাস, “আদ্রায় ফ্লাইওভার নির্মাণের দাবি দলের শীর্ষ নেতৃত্বকে জানানোর পরে রেলমন্ত্রক এই বিষয়ে উদ্যোগী হয়েছে। আগামী রেল বাজেটে আদ্রার ফ্লাইওভার বা সাবওয়ে-র মধ্যে কোনও একটি নির্মাণের প্রস্তাব থাকবে।” রেলের ডিআরএম-ও বলেছেন, “ফ্লাইওভার নির্মাণের লক্ষ্যে ফের একটি টিভিইউ সমীক্ষা করা হবে।”



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.