সার বুঝেছে সারমেয়
জ অনেকটা রাস্তা দৌড়েছি। সেই ইস্তাম্বুল থেকেই ঘ্যাঁক ঘ্যাঁক করতে করতে ছুটছি। বাংলায় দোল দেখব বলে!
ভেবেছিলাম, কয়েক মাস আগেই আসব। সেই মতো ওরহান পামুকের উপন্যাসের পাতা থেকে বেরিয়ে পড়েছিলাম। বেরিয়ে দে ছুট! কিন্তু রাস্তায় এক কুকুরী বলল, কালীপুজোর সময় বাংলায় যেও না। মানুষেরা তোমার লেজে পটকা, টিনের কৌটো বেঁধে দেবে। তার চেয়ে দোলের সময়টা ভাল। লাল, হলুদ, সবুজ আবিরে রাঙা চার দিক, দেখতে চমৎকার লাগে।
তাই এ দেশে এসেছি। চার দিকে চমৎকার আকাশি আর গাঢ় নীল রং। বিজন সেতু, পার্ক স্ট্রিট উড়ালপুল, তারাতলা সর্বত্র নীল। সবুজ ময়দানের গাছগুলিও নীল-সাদা। দেখেই বুঝেছি, চমৎকার ‘নীল ছবি’র শহর। জলভরা টুসটুসে বেলুন আর লম্বা পিচকিরি নিয়ে এখানেই দোল খেলা মানায়।
অলঙ্করণ: দেবাশীষ দেব
নীল ছবি দেখা যাবে? এক বৃদ্ধ কুকুরকে জিজ্ঞেস করেছিলাম। সে ঘ্যাঁক ঘ্যাঁক করে তেড়ে এল, ‘ফালতু বকো না। ক্ষমতা দেখাতে এই শহরের মানুষেরা কখনও শহিদ মিনারের মাথায় লাল রং করে, কখনও রাস্তায় নীল রং করে। মানুষ আসলে লাল-হলুদ-নীল-সবুজ কিছু বোঝে না। শুধু ক্ষমতার রং বোঝে।’
বদমেজাজি কুকুরের তাড়া খেয়ে ছুটতে ছুটতে একটা বাজারে ঢুকে গেলাম। ওই তো, একটা দোকানে ছিপি আঁটা শিশিতে সিলভার কালার, বাঁদুরে রং বিক্রি হচ্ছে। আর কয়েক দিন পরে, বৃহস্পতিবারেই দোল। বেশ সাংবাদিকের মতো হাবভাব করে দোকানিকে ভারিক্কি চালে বললাম, ‘একটা ‘বাইট’ দিন তো। পশ্চিমবঙ্গের রং বদলে গিয়েছে। পরিবর্তনের পরে এটাই প্রথম দোল। সবুজ আবিরের বিক্রি কি তা হলে বেশি?’ দোকানি কথার জবাব তো দিলই না, উল্টে লাঠি নিয়ে ‘কুকুরটা আবার এসেছে, সরা ওটাকে’ বলে মারতে এল। বুঝলাম, পরিবর্তনের পরেও মানুষগুলি সেই তিমিরে, মারপিটের নেশা যায়নি। কুঁই কুঁই করে পালিয়ে এলাম।
পালিয়ে এসে কৃষ্ণচূড়ার ছায়ায় বসেছি। মৃদুমন্দ মলয়সমীরণ, শরীরটা যেন জুড়িয়ে যাচ্ছে। ‘কবে ফুটছো? বসন্ত তো এসে গেল,’ কৃষ্ণচূড়াকে জিজ্ঞেস করলাম। সে বিষণ্ণ হয়ে জবাব দিল, ‘হ্যাঁ, ফুটতে তো হবে। আমার আবার লাল ছাড়া গতি নেই।’ কেন, লাল তো ভাল! কৃষ্ণচূড়া বলল, ‘দূর, লাল মানেই এখন অসুবিধা। রাজারহাটের গাছগুলি বরং ভাল আছে। ওরা ‘সিন্ডিকেট’ তৈরি করে লাল থেকে সবুজ হয়ে গিয়েছে।’ তুমি গেলে না কেন? কৃষ্ণচূড়া দীর্ঘ শ্বাস ছাড়ল, ‘আর বোলো না, বড় বড় বট-অশ্বত্থরা আগেই ও দিকে ভিড়ে গিয়েছে। ওদের মতো সামর্থ্য আমার নেই।’
সবুজের এত দাপট! রাস্তায় ঘুরতে ঘুরতে দেখলাম, কয়েকটি ছেলে বাটিতে গোলাপি, সবুজ ইত্যাদি নানা রং গুলে একটা মিশ্র রং তৈরির চেষ্টা চালাচ্ছে। দোলের দিন তারা অন্যদের এটাই মাখাবে, সাবান ঘষে বহু কষ্টে গা থেকে তুলতে হবে। রঙের শিশি চোখ মটকে হাসল, ‘বোকা! বুঝতে পারছে না, তিন রঙা মানে ছোট শরিক। ঝগড়া করলেই সবুজ দাবড়ে বসিয়ে দেবে। এখানে এক রঙের দাপট অনেক বেশি। সিঙ্গল অ্যাজেন্ডা!’
কিন্তু বড় শরিকের ছড়ি ঘোরানো...ওটা তো লাল অভ্যাস! রঙের শিশি বলল, ‘আর তো পাঁচটা দিন। নিজের চোখেই দোলের রংবাজি দেখে যাও।’ আমার অবশ্য শিশির সঙ্গে এত কথা বললে চলবে না, চলে গেলাম শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানে। কে ইউনিয়ন দখল করবে, তা নিয়ে দু’দল ছাত্র-কুকুরে তখন হেভি ঘ্যাঁকঘ্যাঁক চলছে। বহিরাগত কিছু নেতা-কুকুরও এসেছে। মাটিতে শুকিয়ে যাওয়া কালচে কাদা। লক্ষ করে বুঝলাম, জমাট বাঁধা রক্ত। লাল, সবুজ নয়। পরিবর্তনের পরে প্রথম দোলে এটাই আমাদের, কুকুরদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের রং।
অতএব, লাল রঙের কাছে যাওয়া গেল। ও কি এখন খুব নিঃসঙ্গ? মন খারাপ? লাল আমাকে দেখেই দূর থেকে হাঁকল, ‘এত দিন বাদে এলে? চার দিকে যা সন্ত্রাস চলছে! তবে আমরা হঠব না, ধর্মঘট ডাকব, ব্রিগেড ভরাব, রাস্তায় দাঁড়িয়ে প্রতিবাদ করব।’ সেই সন্ত্রাস, ধর্মঘট আর প্রতিবাদ! এত ‘শুদ্ধকরণ’ চলল, তবু লালের হুঙ্কার আর বদলাল না। কুকুর-বুদ্ধিতে বুঝলাম, বন্যেরা বনে সুন্দর, লালেরা ধর্মঘটে।
সবুজের বাড়ি গেলাম। ‘দেখতে পাচ্ছ, কত কাজ হচ্ছে? দলতন্ত্র একেবারে শেষ করে দিয়েছি,’ হাসল সে। আমি আমতা আমতা করে বললাম, ‘কিন্তু কৃষ্ণচূড়া বলছিল, লালেরাও নাকি সবুজ হয়েছে, সব জায়গায় সিন্ডিকেট তৈরি করেছে।’ সবুজ সঙ্গে সঙ্গে হুঙ্কার ছাড়ল, ‘অ্যাই, কুকুরটাকে দূর করে দে। উন্নয়নের বিরোধিতা করছে।’
সেই থেকে ছুটছি। কোনও মতে দোলটা এখানে কাটিয়ে ফের ইস্তাম্বুল ফিরে যাব। আমার আর লাল-সবুজ দরকার নেই। সবাই এক, কোনও তফাত নেই। সবই ক্ষমতার রং। সাদা-কালো। আমার দিকে থাকলে পবিত্র সাদা। বিপক্ষে থাকলে ঘোর কালো। সন্দেহ হলে উইকিপিডিয়া দেখে নিও। বুঝবে, কেন আমরা, কুকুরেরা, মানুষের চেয়ে ভাল আছি।

চোখের রেটিনায় ‘কোন সেল’-এর কারণে মানুষ নানা রং দেখতে পায়। কুকুরের রেটিনায় এই কোষের সংখ্যা মানুষের তুলনায় সাত গুণ কম। ফলে সারমেয়গণ উজ্জল রং দর্শনে অক্ষম। তাদের দৃষ্টি প্রকৃত প্রস্তাবে ‘ডাইক্রোমাটিক’, শুধু নীল আর হলুদ এই দুটি প্রাথমিক রং দেখতে সক্ষম। মনুষ্যসন্তানের দৃষ্টি ‘ট্রাইক্রোমাটিক’, লাল, নীল, হলুদ তিনটি প্রাথমিক রংই সে অক্লেশে বুঝতে পারে। পক্ষান্তরে, কুকুরের রেটিনায় মানুষের তুলনায় ‘রড সেল’ বেশি। তাই তারা মানুষের চেয়ে সাদা-কালো ভাল বুঝতে পারে।

ঋণ: ওরহান পামুকের ‘মাই নেম ইজ রেড’




অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.