ব্যাগ গুছিয়ে...
ঈশ্বরের আপন দেশে
ড্রাইভার জোসজির গাড়ি যখন সাঁ করে একটা ইউ টার্ন নিয়ে থমকাল পাহাড়ের গায়ে মাথা উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা হোটেলটার সামনে, বাইরে তখন ঘুরঘুট্টি অন্ধকার। সামনে সোজাসুজি তাকালে অনেক দূরে পাহাড়ের কোলে দু’-চারটে টিমটিমে আলো ছাড়া আর কিছুই দেখা যাচ্ছে না। হঠাৎ হুড়মুড়িয়ে হাওয়া বইলে একটু শিরশিরানি লাগছে গায়ে। কিন্তু সব মিলিয়ে বেশ আরামদায়ক আবহাওয়া। যদিও নভেম্বরের শেষ, কিন্তু ঠাণ্ডা খুব বেশি নেই।
কেরল ভ্রমণ সদ্য শুরু হয়েছে। কোচিতে রাতযাপনের পরে সারা দিনটা কেটেছে মেরিন ড্রাইভ, ইহুদি-পাড়া, চাইনিজ ফিশিং নেট, ডাচ প্যালেস আর কেল্লা দেখে। ভাস্কো-ডা-গামা স্কোয়্যারে বাঁশ আর সেগুন কাঠের তৈরি মাছ ধরার জাল দেখেছি, খুব কাছ থেকে দেখেছি মৎস্যজীবীদের রোজনামচা। মাটানচেরি ডাচ প্যালেসে ম্যুরাল শিল্পে রামায়ণের আখ্যান দেখেছি। সিনাগগ থেকে বেরনোর সময়ে পর্তুগিজ ও ওলন্দাজ সভ্যতার টুকিটাকি আর সেই সময়কার ইতিহাস জ্বলজ্বল করছিল চোখের সামনে। সেই সঙ্গে ব্যাগও ভরেছে ‘জিউ টাউনশিপ’-এ ফুলেল তেল, সুগন্ধি, আরও হরেক কিসিমের জিনিসপত্র কিনে। তার পরেই তো মুন্নার পাড়ি! এর্নাকুলাম থেকে ইডুক্কি। পথ নেহাৎ কম নয়! তাই পৌঁছতে পৌঁছতে বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যে।
সেই রাতটায় উপাদেয় মালয়ালি নৈশভোজেই মেটাতে হল তখনও অবধি স্বচক্ষে মুন্নারকে দেখতে না পাওয়ার দুঃখটা। তবে খাওয়ার আয়োজনও কিছু কম নয়। আপ্পম, ইডিয়াপ্পম আর নানাবিধ সম্বর তো বটেই। সেই সঙ্গে অতিকায় লবস্টার, করিমিন মাছ থেকে শুরু করে অগুনতি সামুদ্রিক সুখাদ্যের অপ্রতিরোধ্য আকর্ষণ। কাজেই রাত কাটল ভুরিভোজে।
পর দিন চোখ মেলতেই জানলার বাইরেই যেন হাতছানি দিল দিগন্তবিস্তৃত চা-বাগান। চোখের আরাম বোধ হয় একেই বলে! ধাপে ধাপে ঢেউ খেলানো দু’টি পাতা-একটি কুঁড়ির সবুজ রাজ্য। সেই সবুজে কোনও দৈন্য নেই। আর সেই ঝকঝকে সবুজের ওপারেই নীলপাহাড়ের দেশ। মুদ্রাপূজা, নাল্লাথান্নি আর কুন্ডালা পাহাড় এসে মিশেছে। আকাশে অবিরাম ভেসে চলা ছেঁড়া ছেঁড়া মেঘ যেন পাহাড়ি নীল আলতো ছড়িয়ে দিচ্ছে সবুজের রাজ্যেও। তাকে পাশে রেখে পাহাড়ি পথ ধরে হেঁটে বেড়ালে মেঘের ভাপ এসে লাগে চোখে-মুখে। শহুরে ক্লান্ত মন আরাম পায়। আর শ্রবণেন্দ্রিয়কে আরাম দেয় নৈঃশব্দ্য। মাঝেমধ্যে সেই নীরবতাকে ছিঁড়েখুড়ে পিলে-চমকানো আওয়াজে দু’চারটে অটো নিত্যযাত্রীদের পৌঁছে দিচ্ছে শহর থেকে শহরান্তরে। এ ছাড়া চারদিক অদ্ভুত শান্ত।
মরসুমি ফুল! মরসুমি ফুল! সকলের কী নাম জানি! রং দেখেই তাই তাদের সঙ্গে আলাপ। শহর থেকে একটু দূরে ‘ফ্লাওয়ার গার্ডেন’-এই হোক বা পাহাড়ি পথের এ দিক-সে দিক, নীল-লাল-হলদে-কমলার আলতো ছোঁয়ায় চোখ আটকালো। আর সেই একরাশ রং চোখে মেখেই ঘুরে নিলাম ‘ইকো পয়েন্ট’, মাট্টুপেটি, পল্লিভাসাল। পোঠানমেডু, আট্টুকাড আর চিথিরাপুরমের সৌন্দর্যও বাদ যায়নি। আর ‘স্পাইস গার্ডেন’! সে-ও তো আছেই তার কোকো, দারচিনি, এলাচের গাছ আর ‘ট্রি হাউস’ নিয়ে।
সারা দিন অনেক ঘুরেছি। টাটকা অক্সিজেন ইচ্ছেমতো ভরে নিয়েছি ফুসফুসে। আবার বিকেল ফুরোচ্ছে। মেঘে মেঘে আঁধার হচ্ছে মুন্নার। আর উতরাই ধরে হাঁটতে হাঁটতে পৌঁছে গিয়েছি ‘পুনর্জনি’ গ্রামে। ‘পুনর্জনি’ মানে পুনর্জন্ম। কথাকলি আর কালারিপ্পায়াত্তু শেখানো আর দেখানোর গ্রাম। সে-ও এক অভিজ্ঞতা। চোখের সামনেই কথাকলি-শিল্পীরা সাজছেন। পরতে পরতে রং মেখে হয়ে উঠছেন পৌরাণিক এক-একটা চরিত্র। তার পরেই ‘কুঠাম্বলম’ বা নাটমন্দিরে দক্ষিণী রাগসঙ্গীত ও তালবাদ্যের সঙ্গে শুরু হল নাচ। বুঁদ হয়ে রইলাম বিশুদ্ধ ভারতীয় ঐতিহ্যে। এর পরের চমক কালারিপ্পায়াত্তু। ওদের কথায়, সব মার্শাল আর্টের আদিপুরুষ। তলোয়ার-লাঠি-আগুনের গোলা-বর্শা নিয়ে ‘কুজিক্কলরিতে’ ঘণ্টা দু’য়েক রীতিমতো জাদু দেখাল ভয়-ডরহীন টানটান পেশিবহুল শরীরগুলো। দর্শককুলও উত্তেজনায় টানটান। সাবাস ‘পুনর্জনি’!
মুন্নারের গল্প ফুরোলো। ছেড়ে যেতে ইচ্ছে করছিল না। কিন্তু এ-ই তো সবে চলার শুরু। এ বারের গন্তব্য থেক্কাডি। মাইলের পর মাইল ক্রমশ বদলাতে থাকা জনপদ পেরিয়ে পাহাড়ের পরে এ বার জঙ্গল।
জঙ্গলের মধ্যে থাকার মজাটাই আলাদা। জঙ্গলের সীমানার মধ্যে ঢুকে পড়তে হবে সন্ধ্যে ৬টার মধ্যেই। তার পরে সকাল ৬টা পর্যন্ত আসা-যাওয়া বন্ধ। পেরিয়ার নদী আর মুল্লাপেরিয়ার বাঁধ থেকেই জন্ম নিয়েছে পেরিয়ার লেক। সেই লেকেই পরদিন সকালে যাব ঘণ্টা দেড়েকের ‘ক্রুজ’-এ। ‘পেরিয়ার টাইগার রিজার্ভ’-এ সেই ভয়ঙ্কর সুন্দরকে চোখে দেখার সৌভাগ্য হবে কি না কে জানে!
বিকেল থেকেই বেশ মেঘ করেছে। আর রাত ঘন হয়ে আসতেই টিপটিপ বৃষ্টি শুরু। গা ছমছমে অন্ধকারে মোড়া বনবাংলোয় সকলেই যে যার ঘরে বন্দি। বৃষ্টি বাড়ছে। তার একঘেয়ে একটানা শব্দে মন খুঁজছে অজানা রোমাঞ্চ। এমন সময়ে হঠাৎ একটা অস্পষ্ট আওয়াজ। অনেক দূরে জঙ্গলের গভীর থেকে ভেসে আসছে কোনও এক প্রাণীর ডাক! ফেউ নাকি? ফেউ ডাকলে শুনেছি বাঘ আসে। আশায় আশায় বাংলোর বারান্দায় বেরিয়ে অন্ধকারে চোখ সওয়াতে চেষ্টা করলাম। যদি হঠাৎ চোখে পড়ে একজোড়া জ্বলজ্বলে চোখ! নাহ্, ঘণ্টাখানেকের অপেক্ষা বৃথাই গেল। অগত্যা কম্বলের তলায় ফেরা। আর সেই অজানা জন্তুর ডাক শুনতে শুনতে ঘুমের দেশে।
তার পরে সকালের আলো ফুটল।
জংলি পাখির কিচিরমিচির আর বাংলোর বারান্দায় ২-৪টে বাঁদরের ধুপধাপ শব্দে ঘুম ভাঙল। আবার ঝটপট তৈরি হয়ে বেরিয়ে পড়া। আর তার পরেই পেরিয়ার লেকের ‘ক্রুজ’। বনভূমির ধার ঘেঁষে ঘেঁষে এগিয়ে চলেছে লঞ্চ। হঠাৎ হঠাৎ সহযাত্রীদের উচ্ছ্বাসে সামিল হতে গিয়ে চোখে পড়ে যাচ্ছে দু-একটা বুনো শুয়োর আর হরেক রকমের পাখি। আবার কখনও হাওয়ায় সবুজ ঝোপের নড়াচড়া দেখেই বোকা বনে যেতে হচ্ছে। তবে মন ভরিয়ে দিচ্ছে গাছগাছালিরা। কত রকম রং তাদের! পেরিয়ার লেকের টলটলে স্বচ্ছ জলে ছায়া পড়ছে আদিম বনানীর। কোথাও আবার মাঝদরিয়ায় আজব কায়দায় বাসা বেঁধেছে নতুন দেশের পাখিরা। সেই সঙ্গে হিমেল হাওয়ার ঝাপটা। এমনিতেই মন ভাল হয়ে যাচ্ছে। কোনও অপূর্ণতা বাসা বাঁধতে পারছে না সেখানে। দেড় ঘণ্টার লঞ্চ-বিহার শেষে তাই ইচ্ছে করছে দু’দণ্ড চুপ করে বসে থাকি। মনের মধ্যে গেঁথে নিই পর পর ছবিগুলো।
উঁহু! পাহাড় আর জঙ্গলেই কিন্তু কেরলের শেষ নয়। বাকি আছে আরও অজানার। মুন্নার আর পেরিয়ার মুগ্ধ করেছে। আর খিদে বাড়িয়েছে মনের। সত্যিই, চলার এই তো শুরু।

কী ভাবে যাবেন
কলকাতা থেকে ট্রেনে বা বিমানপথে এর্নাকুলাম বা কোচি পৌঁছতে পারেন।
সেখান থেকে গাড়ি নিয়েই যেতে হবে মুন্নার ও থেক্কডি।
কোথায় থাকবেন
দু’জায়গাতেই বিভিন্ন দামের থাকার জায়গা রয়েছে।
থেক্কডি বা পেরিয়ারে জঙ্গলের মধ্যে থাকার তিনটি সরকারি গেস্ট হাউস আছে।




অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.