দীর্ঘ অপেক্ষার পর অবশেষে আনুষ্ঠানিক ভাবে শুরু হয়েছে কেলেঘাই-কপালেশ্বরী-বাগুই নদী-সংস্কার প্রকল্প। এই প্রকল্প ঘিরে দুই মেদিনীপুরের কয়েক লক্ষ মানুষের বিপুল প্রত্যাশা। ফি-বছর বানভাসির দুর্ভোগ থেকে মুক্তির উপায় হিসাবেই তাঁরা প্রকল্পটিকে দেখছেন। সেই সঙ্গে সরকারি নানা কাজের ধরন-ধারণ নিয়ে পূর্ব-অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে তাঁরা কিছুটা সতর্কও। ঠিকমতো কাজ হবে তো? নির্দিষ্ট সময়সীমায় কাজ শেষে হবে কি? ক্রমশ পিছোতে পিছোতে আবার এই প্রকল্পটিও আরও অনেক সরকারি কাজের মতো (হাতের কাছেই রয়েছে সুবর্ণরেখা বহুমুখী প্রকল্পের পরিণতির উদাহরণ) বিশ বাঁও জলে চলে যাবে নাতো? প্রকল্পের জন্য (নদীখাত চওড়া করা এবং পাড়বাঁধের জন্য) জমি অধিগ্রহণও প্রয়োজন। নন্দীগ্রাম, সিঙ্গুর-পরবর্তী বাংলায় জমি-জটের ধারাবাহিকতায় এই প্রকল্পের গতিরোধ হবে নাতো? এমন নানা প্রশ্ন, সংশয় এখন কান পাতলে শোনা যাবে সবং, পটাশপুর, ভগবানপুর, ময়না, নারায়ণগড়ের আনাচ-কানাচে।
তবু আশায় বাঁচে মানুষ। নদীপাড়ের মানুষ বন্যা-দুর্গতি থেকে বাঁচার আশা তো করবেনই। সবংয়ের মানস ভুঁইয়া দীর্ঘ কয়েক দশক ধরে এই প্রকল্পের জন্য কলকাতা-দিল্লিতে গলা ফাটিয়েছেন। সেই মানসবাবু এখন রাজ্যের সেচমন্ত্রী হওয়ায় অবশ্য কিছুটা ভরসা পাচ্ছেন এলাকাবাসী। মানসবাবু নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে কাজ শেষ করার ভরসাও দিচ্ছেন। |
নদীর বুকে অবৈধ পারাপারের পথ। ফাইল চিত্র। |
প্রকল্পের এই সূচনা-সময়ে নদীপাড়ের মানুষের মনে পড়ছে অতীত সঙ্কটের দিনগুলি। আর মনে মনে তাঁরা প্রার্থনা করছেন, আর যেন সেই দুর্দিন দেখতে না হয়। সংশ্লিষ্ট নদীগুলির বন্যার সমস্যা একশো বছরেরও বেশি পুরনো। এলাকায় বন্যা নিয়ন্ত্রণে, বিশেষ করে নদী-তীরবর্তী এলাকায় বসবাস ও চাষবাসের লক্ষ্যে এলাকাভিত্তিক জমিদারি বাঁধ দেওয়ার শুরু সেই ইংরেজ আমলে। কিন্তু সেই বাঁধেই নদীর স্বাভাবিক গতি বাধাপ্রাপ্ত হয়। এ দিকে, ওড়িশা, ঝাড়খণ্ড ও বিহারের মালভূমি এলাকার জল-নিকাশির ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ কেলেঘাই ও তার উপনদীগুলি। অপরিকল্পিত ভাবে বাঁধ ও গতিপথে বাধা দেওয়ার ফলে দ্রুত জল নিকাশি না-হতে পারায় নদী উপচে বা বাঁধ ভেঙে বন্যা হয়েছে প্রায় ফি-বছরই। স্বাধীনতার পর থেকে কেলেঘাই নদীর বন্যা নিয়ন্ত্রণে সরকারি ভাবে ছোট ছোট পরিকল্পনা অনেক হয়েছে। কিন্তু কাজের কাজ কিছু হয়নি। ২০০৮-এ কেলেঘাইয়ের বিধ্বংসী বন্যায় সম্পত্তির বিপুল ক্ষয় এবং শতাধিক মানুষের মৃত্যু অতীতের ভয়াবহতাকে ছাপিয়ে যায়।
১৯৭২-৭৭ ও ১৯৯৩-’৯৪ সাল---দু’বার কেলেঘাই নদী-সংস্কারে বিশেষ পরিকল্পনা নেওয়া হয়। প্রথমবার নদীর খুব সামান্য অংশে বাঁধ সরিয়ে নদী চওড়া করা হয়। পটাশপুরের পাথরঘাটা থেকে বলভদ্রপুর পর্যন্ত নদীর মূল প্রবাহপথের সাড়ে পাঁচ কিলোমিটার অংশের দুই মুখ বন্ধ করে সিংলি খাল দিয়ে নদীকে প্রবাহিত করা হয়। সিংলি খাল সংস্কার করে চওড়া করাও হয়েছিল। আমগেছিয়া থেকে লাঙলকাটার দিকে নদীর মাঝ বরাবর নদীর মূল প্রবাহপথ তৈরি করতে প্রায় তিন কিলোমিটার একটি চ্যানেল কাটা হয়েছিল। দ্বিতীয়বার লাঙলকাটার কাছে পলি তোলার কাজে প্রকল্পের মাত্র পাঁচ শতাংশ কাজ হয়। পলি তুলে ফেলে রাখা হয় নদীর বকচর অংশে। পরের বর্ষায় সেই পলিই ধুয়ে ফের ভরাট হয়েছে নদীখাত। হয়েছে আর্থিক ক্ষতি। বন্যা নিয়ন্ত্রণ হয়নি।
উল্লেখ্য, কেলেঘাইয়ের নদীখাত কোথাও বিস্তৃত (শালমারায় তিন কিলোমিটার চওড়া)। আবার কোথাও সংকীর্ণ (মকরানিচক, শিউলিপুরে ২০০ ফুটেরও কম)। এর ফলে নদী স্বাভাবিক গতিতে মোহনার দিকে প্রবাহিত হতে পারছে না। নদীখাতের বিভিন্ন স্থান আবার অবরুদ্ধ করা হয়েছে বিভিন্ন ভাবে। দু’টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, শতাধিক বাড়ি, কারখানা, ইটভাটা, বড় বড় গাছ, ঝোপঝাড়, বিদ্যুৎ ও টেলিফোনের খুঁটি, রাস্তা রয়েছে। নদীগর্ভে ভাঙা ইট ফেলে কারখানা বা ইটভাটার এক দিকে ভাঙন আটকানোর চেষ্টা পর্যন্ত হয়েছে। নদীর প্রবাহপথে খুঁটি পুঁতে, বেড়ি দিয়ে বা বাঁধ বেঁধে, কোথাও জাল দিয়ে মাছ ধরার ব্যবস্থাও হয়েছে। তা ছাড়া সেচের জলের জন্য যেখানে-সেখানে বাঁধ দেওয়া তো আছেই। বর্ষার সময়েও এই বাধাগুলি তুলে দেওয়া হয় না। লাঙলকাটার কাছে জোয়ারের নোনা জল আটকে দেওয়ার জন্য বাঁধ দেওয়া হয়। এ-সব কারণে জলপ্রবাহে বাধা পড়ে। জোয়ারের সময়ে হলদি নদীর জল ঢুকেও কিছুটা পলি পড়ে। কেলেঘাই নদী শালমারার পর থেকে সংকীর্ণ হওয়ায় জল নিকাশি দ্রুত হয় না। ফলে পলি জমার হার শালমারা থেকে মোহনা অংশ পর্যন্ত বেশি।
বর্তমান নদী-সংস্কার প্রকল্পের সময়সীমা ধরা হয়েছে তিনটি আর্থিক বছর। গত আর্থিক বছরে প্রকল্পের জন্য পরিকাঠামো গড়া (কে-কে-বি ডিভিশন অফিস তৈরি, জমি অধিগ্রহণের জন্য প্রয়োজনীয় নথি সংগ্রহ) হয়েছে। ২০১৩-’১৪ সালে প্রকল্প শেষ করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
কেলেঘাইয়ের সংস্কার হওয়ার কথা নারায়ণগড়ের পোক্তাপোলের কাছ থেকে ঢেউভাঙা পর্যন্ত ৬৩ কিমি অংশে। বাগুইয়ের সংস্কার হওয়ার কথা বেলদার খাকুড়দা থেকে বুলাকিপুরে কেলেঘাইতে মিলিত হওয়া পর্যন্ত ২৪ কিমি অংশে। দেউলির সংস্কার হওয়ার কথা সবং ব্লকের বড়চাহারা ও খাজুরি থেকে কেলেঘাই পর্যন্ত ৯ কিমি। কপালেশ্বরীর সংস্কার হওয়ার কথা সবং ব্লকের গুমাইবাকিটাকি থেকে কেলেঘাই পর্যন্ত ২১ কিমি (কাজ হয়ে গিয়েছে প্রায়)। চণ্ডীয়ার সংস্কার হওয়ার কথা পিংলার পাটচণ্ডা ও পাঁচথুপি খালের মিলনস্থল থেকে কেলেঘাই পর্যন্ত ২৪ কিমি অংশে। এ ছাড়াও কেলেঘাই, কপালেশ্বরী, বাগুই নদীর উপ-অববাহিকায় ফের খনন করার কথা দাঁতন-২, পটাশপুর-১, ভগবানপুর-১, ময়না ও সবং ব্লকের প্রায় ২০টি খাল (বুড়াবুড়ি, গৌর মাইতি, যদুপাত্র, অভয়গিরি, ব্রজমোহনচক, কীর্তনখালি, কুলটিকরি, ময়না নিউ কাট চ্যানেল, গণপত, আমড়াখালি, কালীমণ্ডপ, সতী, সুন্দরপুর, খড়িকা, জরুরা, মির্জাপুর, বাগমারি, পেজোয়ার খাল ইত্যাদি)। খনন করার কথা খালগুলির মোট ৯০.৪৩ কিমি অংশ।
কেলেঘাই-খাতের সংস্কার হওয়ার কথা উজানে ৯৫ মিটার থেকে শুরু হয়ে একেবারে শেষ জায়গায় ১৫০ মিটার। অন্যান্য নদীর ক্ষেত্রে ১৫ মিটার থেকে ৪৫ মিটার। শাখা খালগুলির ক্ষেত্রে ৭ মিটার থেকে ১০ মিটার। মাটি কাটার গভীরতা নদী ও খালের বর্তমান অবস্থা অনুযায়ী বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন রকম হওয়ারই কথা। চণ্ডীয়া নদীর উপরে শ্রীধরপুর, ব্রজমালিচক ও চাঁদবেনিয়ায় তিনটি পাকা সেতু নির্মাণ হওয়ার কথা। কেলেঘাই নদীর উপরে লাঙলকাটা ও শিউলিপুরে বর্তমান কম পরিসরের ‘ফেয়ার ওয়েদার ব্রিজ’ ভেঙে বড় পরিসরের কাঠের সেতু হওয়ার কথা। নিকাশির সুবিধার জন্য বিভিন্ন জায়গায় ড্রেনেজ-স্লুইস নির্মাণ ও পুনর্গঠনেরও পরিকল্পনা রয়েছে। কেলেঘাই নদীর বুকে শেষ বর্ষার জল ধরে রেখে শুখা মরসুমে চাষের জন্য চাবুকিয়ায় একটি ‘রাবার ড্যাম’ তৈরিরও পরিকল্পনা রয়েছে।
তবে এই নদী-সংস্কার প্রকল্পের প্রথম পর্যায়ের কাজে ১৬৭৫ একর জমি অধিগ্রহণ করাও প্রয়োজন। সেটাই খানিক খটকা হয়ে বিঁধছে অনেক আশার মধ্যেও। এই জমির অনেকাংশই রায়তি (কোনও কোনও মহল থেকে জমির বদলে চাকরির দাবি-টাবি ওঠানোর চেষ্টাও চলছে)। সেচ দফতরের অবশ্য আশা, মানুষ বন্যা-দুর্গতি থেকে মুক্তির জন্য ঠিকই জমি দেবেন। ক্ষতিপূরণ হিসাবে জমির মালিক ও পাট্টাদারদের বাজারদরের সমপরিমাণ মূল্য এবং ওই মূল্যের উপরে আরও ৩০ শতাংশ সান্ত্বনামূল্য দেওয়ার প্রস্তাব রয়েছে। জমি অধিগ্রহণের বিজ্ঞপ্তি জারির দিন থেকে ক্ষতিপূরণ দেওয়া পর্যন্ত জমির মূল্যের উপর অতিরিক্ত ১২ শতাংশ অর্থ দেওয়া হবে বলেও আশ্বাস দেওয়া হচ্ছে। নিবন্ধীকৃত ভাগচাষি জমি-মালিকের পাওনার ৫০ শতাংশ অর্থ এককালীন ক্ষতিপূরণ হিসাবে পাবেন। সেই সঙ্গে একশো দিনের প্রকল্পে অদক্ষ শ্রমিকের প্রাপ্য-হারে একর পিছু ৩৪০ দিনের মজুরি প্রদানের কথাও বলা হয়েছে এই নদী-সংস্কার প্রকল্পে। অনিবন্ধীকৃত ভাগচাষি তথ্য প্রমাণ দাখিল করলে একই সুবিধা পেতে পারেন বলেও জানানো হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত পরিবার বিপিএল তালিকাভুক্ত হলে এবং তার বাস্তু অধিগৃহীত হলে ইন্দিরা আবাস যোজনার হারে গৃহ-নির্মাণের জন্য এককালীন অর্থ দেওয়ারও প্রস্তাব রয়েছে।
নদী ও খাল সংস্কারের পাওয়া মাটি সাধারণ ভাবে দু’পাশের বাঁধ চওড়া ও উঁচু করার কাজে ব্যবহার করার কথা। বাঁধের কাজের পরেও বাড়তি মাটি গ্রামের নিচু জায়গা, সরকারি বা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের জমি ভরাট ও উঁচু করা এবং গ্রামীণ রাস্তা নির্মাণের কাজে লাগানোরও পরিকল্পনা রয়েছে। যদিও নদী-সংস্কার হলেই যে পলি জমা বন্ধ হবেসে আশ্বাস দিতে পারেন না কেউই, তবু সেচ দফতরের বক্তব্য, নদীগুলির জল-ধারণ ও পরিবহণ ক্ষমতা নিশ্চিত ভাবেই কয়েক গুণ বাড়বে। স্রোত বেশি থাকবে বলেই নদীখাতে পলি পড়ার হার কমবে। সেচ-কর্তাদের আশা, কমপক্ষে আগামী পঞ্চাশ বছর নদীর মোহনার দিকের ১৫ কিলোমিটার অংশ ছাড়া সংস্কারের প্রয়োজন তেমন হবে না। নদী-বিশেষজ্ঞ কল্যাণ রুদ্র সতর্ক করছেন, “নদীখাত গভীর বা চওড়া করলেও নদীখাতের ঢালের ভারসাম্য সঠিক না থাকলে পলি বেশি পড়ার সম্ভাবনা থাকে। এর জন্য সামগ্রিক পরিকল্পনা দরকার। এলাকার বৃষ্টির জল ও নদী উপচানো জল যাতে সহজে নদী বা খালে পড়ে, তার ব্যবস্থা জরুরি।” |