আজ্ঞে হ্যাঁ
এটাই বহেনজির ভিটেমাটি।
সুবিশাল বাদশাহি স্থাপত্যে মোড়া প্রায় একশো কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত এক রাজপ্রাসাদ।
দিল্লি থেকে মাত্র ষাট কিলোমিটার দূরে পুরনো গাজিয়াবাদের গায়ে এই গ্রামের নামটি বাদলপুর। আধুনিক নামকরণ হয়েছে নতুন জেলার, গৌতমবুদ্ধ নগর। বর্ধিষ্ণু এই গ্রামটিতেই ছাপ্পান্ন বছর আগে জন্মেছিলেন আজকের দলিত নেত্রী মায়াবতী। বাবা প্রভুদাস দয়াল ছিলেন কেন্দ্রীয় ডাক ও তার বিভাগের এক নিচুতলার কর্মী। বাদলপুরের তাঁর সেই পৈতৃক পর্ণকুটিরে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে মায়াবতীর অট্টালিকা। ভিতরে লাল পাথরের প্রাচীর। নানান বড় বড় গম্বুজ। অট্টালিকার সামনে দু’ধারে বিশাল সবুজ বাগান। যেমনটি আছে তাজমহলের সামনে। আর এই দু’টি বাগান তৈরি করতে খরচা হয়েছে প্রায় দশ কোটি টাকা। অনতিদূরে একটি হেলিপ্যাড। ব্যয় তিন কোটি চব্বিশ লক্ষ টাকা। লখনউ থেকে হেলিকপ্টারে করে এখানে আসেন মায়াবতী। ভাই আনন্দ প্রত্যেক দিন বিকেলে এই প্রাসাদের তদারকি করতে আসেন। বাড়ির আর এক প্রান্তে তৈরি হয়েছে একটি দলিত গ্রন্থাগার। দলিত সাহিত্যে ঠাসা। মায়াবতীর স্বপ্ন, এই এলাকাটি হয়ে উঠবে দলিত ‘স্টাডি-হাব’।
দলিতদের মধ্যে কিন্তু একটু উচ্চজাতের দলিত ছিলেন মায়াবতীরা। দিল্লির ইন্দ্রপুরীর ঝুগ্গিঝোপড়িতে বড় হলেও শুধু স্নাতক নন, বিএড পাশ করেছিলেন তিনি। সেই মায়াবতী উত্তরপ্রদেশে তিন বার মুখ্যমন্ত্রী হয়েছেন। আর আজ এত বছর পর এ বারের বিধানসভা নির্বাচনে মূল প্রশ্ন একটাই মায়াবতী নামক দীর্ঘদিনের তৈরি ‘মিথ’ কি এ বার ভাঙবে? মুলায়ম সিংহ যাদবের সাইকেল যে ঝড় তুলেছে, সেই ঝড়ে কি উড়ে যাবে দলিত নেত্রীর ‘হেজেমনি’? আগামিকাল উত্তরপ্রদেশের প্রলম্বিত ভোটগ্রহণ পর্ব শেষ হতে চলেছে। ৬ মার্চ ভোটের ফলাফলে স্পষ্ট হবে এ বার পয়লা নম্বরে কে থাকবেন। |
বিহারে বিগত বিধানসভা নির্বাচনে নীতীশ কুমারের নেতৃত্বে জিতেছিল জেডি (ইউ)-বিজেপি জোট। লালু প্রসাদ ও কংগ্রেসের জোট হয়নি। সেই ভোট ভাগাভাগির ফায়দা পেয়েছিলেন নীতীশ। পটনার তখ্ত নীতীশ দখল করলেও ময়নাতদন্তে দেখা যায়, লালুর ভোট কিন্তু খুব একটা কমেনি। লালুর ভোটের প্রধান উপাদান ছিল যাদব ও মুসলমান। সেই ভোটের ঝুলি থেকে সংখ্যালঘু ভোট কিছুটা কমলেও যাদব ভোটের যে সম্পদ, তা কিন্তু নীতীশ ভাঙতে পারেননি। ফলে উন্নয়নের স্লোগান দিয়ে নীতীশ মধ্যবিত্ত মানুষের কাছে একটা বার্তা দিলেও মূলত জাতপাতের সমীকরণে লালু লভ্যাংশ পেয়েছিলেন। এ বার মায়াবতীর দলিত ভোটে কতটা ভাঙন ধরাতে পারবেন রাহুল গাঁধী? সেটাও কিন্তু মস্ত বড় প্রশ্ন। যে উত্তরপ্রদেশ ক্রমাগত কংগ্রেস নেতাদের প্রধানমন্ত্রী করেছে (সেই তালিকায় আছেন নেহরু থেকে রাজীব, সকলেই), এক সময় তারাই আবার মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল এই জাতীয় দলটির থেকে। কারণ, দলীয় নেতৃত্ব মানুষের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিলেন। সেই সুযোগে কাঁসিরাম দখল করেন দলিত ভোটব্যাঙ্ক। তার কাছ থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে সেই ভোট এখন এসেছে মায়াবতীর ঝুলিতে। এখন প্রশ্ন, গাঁধীর হরিজন প্রেম এবং নেহরুর বহুত্ববাদের মডেলের নবীনতম দূত রাহুল কি পারবেন সেই ভোট কংগ্রেসের দিকে
ফিরিয়ে আনতে?
এর উপর আছে গত পাঁচ বছরে মায়াবতীর শাসনের নানা কীর্তি ও কেলেঙ্কারি। এই প্রাসাদের কাছেই রয়েছে মায়াবতীর একটি বিশাল মূর্তি। তাতে তাঁর চারটি মুখ। মুলায়ম-তনয় অখিলেশ যাদব এখানে এসে প্রশ্ন তুলেছেন, মূর্তির চারটে মুখ, কিন্তু এই চতুরাননে উত্তরপ্রদেশের উন্নতি কতটুকু হল?
এর আগেও দলিত নেত্রীর বৈভব, তাঁর বিরুদ্ধে
দুর্নীতির অভিযোগকে প্রচারের প্রধান হাতিয়ার করেছে কংগ্রেস। কিন্তু তাতে উত্তরপ্রদেশের দলিত নেত্রীর ভক্তকূল বিচলিত হননি। এ এক বিচিত্র সংস্কৃতি। ১৫ জানুয়ারি নেত্রীর জন্মদিনে দলিত তহবিল থেকে যখন মায়াবতীর নতুন একটি মার্সিডিজ বেন্জ কেনেন এবং তাতে প্রথম চাপেন। তখন কিন্তু রাগ করা দূরের কথা, ওই সম্প্রদায়ের মানুষ রীতিমতো গৌরবান্বিত বোধ করেন। পশ্চিমবঙ্গে এমনটা ভাবাই যায় না। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যদি তাঁর নীল হাওয়াই চটি ও কাঁধের ঝোলাটি পরিত্যাগ করে একটি কালো মার্সিডিজে চেপে মহাকরণে আসেন, তা হলে বঙ্গসমাজ তাঁর জয়ধ্বনি দিতে পারবে না। বাংলার এই সংস্কৃতি উত্তরপ্রদেশে নেই। আর সেটাই দুই বৃহৎ জাতীয় দল কংগ্রেস ও বিজেপির কাছে মস্ত অসুবিধার ব্যাপার।
এর আগের বার অবশ্য মায়াবতী নিজেকে বদলাতে শুরু করেছিলেন। দেখা যাচ্ছিল, তিনি ‘বহুজন সমাজের’ বদলে ধীরে ধীরে ‘সর্বজন সমাজ’-এর দিকে এগোচ্ছেন। অনেকে এমনটাই বলতে শুরু করেছিলেন যে, মায়াবতী এ বার মনুবাদী তকমা থেকে বেরিয়ে একটা বৃহত্তর জনসমাজকে ধরতে চাইছেন। এমনটাও অনেকে ভাবতে শুরু করেছিলেন যে, তিনি বোধহয় দিল্লির দরবারের দিকে তাকিয়ে ক্ষুদ্র সত্তা থেকে নিজেকে আরও প্রসারিত করতে চাইছিলেন।
নরেন্দ্র মোদী যেমন ‘গুজরাত অস্মিতা’ থেকে বেরিয়ে সর্বভারতীয় প্রেক্ষাপটে আসার স্বপ্ন দেখেন। আর সেই কারণেই তখন কৌশলগত ভাবে সতীশ মিশ্রের মতো উচ্চবর্ণের উপদেষ্টাকে সঙ্গে নিয়ে মায়াবতী হয়ে উঠেছিলেন ‘সোশ্যাল ইঞ্জিনিয়ার’। উচ্চবর্ণের সমর্থন তাঁর দলে ক্রমশ বাড়ছিল। ১৯৯৬ সালে যেটা ছিল শতকরা ৬ ভাগ, ২০০৭ সালে সেটা বেড়ে দাঁড়ায় ১৬ শতাংশে। যাদব বাদে ওবিসি ভোট ১৩ থেকে ২৭ শতাংশ এবং সংখ্যালঘু ভোট ১২ থেকে বেড়ে ১৭ শতাংশে দাঁড়ায়। তাতেও কিন্তু দলিত ভোট কমেনি। একই সময়ে দলিত ভোট ৬২ শতাংশ থেকে বেড়ে দাঁড়ায় ৭৭ শতাংশে।
এ বারের ভোটে এসে দেখা যাচ্ছে রাহুল-অখিলেশের প্রচারের মূল বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে, প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা, দুর্নীতি, অপশাসন, চাকরি, বিজলি-পানি-সড়ক। সেইখানে দাঁড়িয়ে মায়াবতী উচ্চবর্ণের ভোট হারালে, তা সে যার কাছেই যাক, শুধু দলিত ভোট নিয়ে ক্ষমতায় থাকা মুশকিল হয়ে যাবে। দিল্লি দরবারে পা রাখার স্বপ্ন গত লোকসভা নির্বাচনেই চুরমার হয়ে গিয়েছে। আজ এই বিরাট প্রাসাদ বা হেলিপ্যাডের মধ্যেই কোথাও যেন একটা ক্লান্তির ছাপ।
তবে কি শেষে কাদায় আটকাবে মায়াবতীর রথ? জবাব মিলবে আর চার দিন বাদেই। |