চিত্রকলা ও ভাস্কর্য ১...
প্রতিবাদী চেতনা থেকেই উত্তরণের গভীর বাণী
শিরোনাম ‘আনডেটেড: নাইটস্কিন’। রাত্রির আবরণ ছড়িয়ে থাকে গ্যালারির সাতটি কক্ষ জুড়ে। এবং সেই রাত্রিময়তা সময়ে সংবদ্ধ নয়। সময়হীনতায় পরিব্যাপ্ত। সেই রাত্রি, সেই তমসা জারিত করে, মথিত করে উঠে আসছে এক অনৈসর্গিক আলো। হিংসায়, আতঙ্কে, সন্ত্রাসে পর্যুদস্ত হচ্ছে জীবন। তবু সূর্য ওঠে, ফুল ফোটে। চিত্রভানু মজুমদারের বিরাট মাপের প্রদর্শনী হল সম্প্রতি হ্যারিংটন স্ট্রিট আর্ট সেন্টারে। মূলত ইনস্টলেশন ও ভিডিও দিয়ে করা সেই এককের মূল উপজীব্য অনেকটা এরকম। যন্ত্র, প্রযুক্তি, বৈদ্যুতিক ও বৈদ্যুতিন কারিগরির দক্ষ ও সমৃদ্ধ ব্যবহার, আলো ও ধ্বনির নাটকীয় উৎসারণ, চিত্র, আলোকচিত্র, ভাস্কর্য, চলচ্চিত্র এ সমস্ত শিল্পরূপকে সমন্বিত করে গড়ে উঠেছে প্রায় ১৫টি আলাদা চতুর্মাত্রিক প্রদর্শ। সময়প্রবাহ যার চতুর্থ মাত্রা। তাতে নির্দিষ্ট আখ্যান কিছু নেই। বিমূর্তভাবেই উপস্থাপিত হয়েছে আবিশ্ব সংকট। চৈতন্যের গভীরের নিবিড় অন্ধকার। আবার তাকে অতিক্রম করে আলোর অভিসারের বার্তা।
শিল্পী: চিত্রভানু মজুমদার
১৯৮০-র দশকে কলকাতার গভর্নমেন্ট আর্ট কলেজ থেকে পাশ করে তিনি যখন শুরু করেছিলেন দৃশ্যকলা সৃজনের পথে তাঁর যাত্রা, তখন দ্বিমাত্রিক ছবিই ছিল তাঁর প্রকাশের প্রধান মাধ্যম। দুই ভিন্ন সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ছিল তাঁর মননের প্রেক্ষাপটে। পিতা নীরদ মজুমদার ছিলেন ১৯৪০-এর দশকের এক জন অত্যন্ত বড় মাপের শিল্পী। আধ্যাত্মিকতার বাতাবরণ ছিল পারিবারিক উত্তরাধিকারে। তাঁর ছবি এবং তাঁর দাদা কমল মজুমদারের সাহিত্য ও চিত্রকলাতেও ছিল সেই ধর্মীয় আধ্যাত্মিকতার নিবিড় প্রকাশ। মায়ের সূত্রে চিত্রভানু পেয়েছিলেন ফরাসি সংস্কৃতির উত্তরাধিকার। তাঁর প্রথম পর্বের ছবিতে এই দুই সংস্কৃতির সমন্বয়ের প্রবণতা দেখা যেত। ফরাসি উৎসের জ্যামিতিক মোজাইক, আলো-ছায়ার মরমি অন্তর্লীনতা ধীরে ধীরে রূপান্তরিত হয়েছে। আধ্যাত্মিকতা থেকেই ক্রমান্বয়ে এসেছে প্রতিবাদী চেতনা। পাশ্চাত্য আধুনিকতাবাদী প্রকাশভঙ্গি থেকে তিনি গেছেন উত্তর-আধুনিকতা সঞ্জাত বিকল্প শিল্পরীতির দিকে।
১৯৯০-এর দশকের মাঝামাঝি থেকে ছবির পাশাপাশি ইনস্টলেশনই হয়ে ওঠে তাঁর প্রধান প্রকাশমাধ্যম। সামাজিক সংকটের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী চেতনা ছিল তাঁর প্রকাশের একটি গুরুত্বপূর্ণ মাত্রা। এ বারের এই প্রদর্শনীতে এসে আমরা দেখি সেই প্রতিবাদী চেতনায় সংস্থিত থেকেই তিনি এনেছেন উত্তরণের গভীর বাণী।
প্রদর্শনীতে প্রবেশের মুখেই বাজতে থাকে ১৯৬৬-র একটি ফিল্ম ‘লাভ ইন টোকিও’-র আবহসঙ্গীত। এর আগে অন্য একটি প্রদর্শনীতে তিনি দেখিয়েছিলেন ‘আইসক্রিম ফ্যাক্টরি চিল টিউবস’ নামে একটি ইনস্টলেশন। তার সঙ্গে যুক্ত ছিল এই ধ্বনি। সেই ‘চিল টিউব’-ও রাখা ছিল প্রদর্শনীর প্রবেশপথে। এরকম একটা হলিউড-বলিউড মেশানো ১৯৬০-এর দশকের সুরের আবহের মধ্য দিয়ে মূল প্রদর্শনীতে প্রবেশ করে আমরা পৌঁছে যাই একবিংশ শতকের উন্নত প্রযুক্তিগত সংকটাপন্ন আন্তর্জাতিক আবহমণ্ডলের মধ্যে।
বিমূর্ত কিছু দ্বিমাত্রিক চিত্র রয়েছে প্রদর্শনীতে। যেমন ২০০৯-এ করা প্লাইউড ও মাইল্ড স্টিলের উপর মোম ও আলকাতরার সম্পূর্ণ তমসাবৃত রচনা। তার ভিতর একটি ছোট অংশে আলোকিত শুভ্রতার সংঘাত। ‘এনসেন্ট আর্থ’ রচনায় ডিজিটাল ফোটোর মাধ্যমে উপস্থাপিত করেছেন ঝাড়খণ্ডের বিশুষ্ক নিসর্গ। স্বদেশের ভিতর এক শঙ্কার আবহ। এই নিসর্গই অন্য ভাবে এসেছে একটি বড় মাপের ইনস্টলেশনে। বড় একটি অন্ধকার কক্ষে অজস্র ঝুলন্ত কালো ধাতব বাক্সের ভিতর সাঁটা রয়েছে নিসর্গ ও জীবনের বিচিত্র ডিজিটাল ছবি। অন্য প্রান্তে রয়েছে স্পন্দমান এক ঘুঙুরের স্তূপ। মাঝে মাঝে বেজে ওঠে ঘুঙুরের ধ্বনি। রহস্যময় সেই ধ্বনিতে অন্ধকার আলোড়িত হয়। একটি কক্ষের চারটি দেয়াল জুড়ে পর্দা। তাতে একই সঙ্গে প্রদর্শিত হয় চারটি ভিডিও ইনস্টলেশন। সমুদ্রের ঢেউ উছলে উছলে ওঠে। অন্তহীন স্রোতে পরিপ্লুত হতে থাকে বিশ্ব। পাখি ওড়ে আকাশে। শূন্যতাকে পরিব্যাপ্ত করতে থাকে অসীমের অনুরণন। অন্য একটি কক্ষে দেয়াল ও মেঝেতে বিস্তৃত পর্দায় উপস্থাপিত হয় প্রায় সাত মিনিটের একটি ডিজিটাল প্রজেকশন। রাত্রির আবরণের মধ্যে উদ্ভাসিত হতে থাকে আলোকিত স্মৃতির প্রবাহ। ভোর হয়। পাখি ডাকে। নন্দিত হয় জীবন। সীমাবদ্ধ সময়ের সীমিত পরিসর থেকে জেগে ওঠে সীমাহীন চৈতন্যের অনুধ্যান। অসীমে বিস্তীর্ণ হয় জীবন। ‘মানুষের মৃত্যু হলে তবুও মানব থেকে যায়।’


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.