সিআইডি-কে তদন্তের ভার
জেলা পুলিশের উপরে অনাস্থা প্রকাশ করে বর্ধমানের দুই সিপিএম নেতা খুনের তদন্তভার শুক্রবার সিআইডি-র হাতে ন্যস্ত করল কলকাতা হাইকোর্ট। সিআইডি তদন্ত করবে হাইকোর্টের নজরদারিতে। ২৩ মার্চ সিআইডি-কে প্রাথমিক রিপোর্ট দিতে হবে। সেই রিপোর্ট দেখে হাইকোর্ট পরবর্তী সিদ্ধান্ত জানাবে।
পশ্চিম মেদিনীপুরের নেতাইয়ের গুলিচালনার ঘটনায় প্রথমে সিআইডি-কে তদন্ত চালাতে দিয়েছিল কলকাতা হাইকোর্ট। কিন্তু সিআইডি তদন্তে আস্থা রাখতে না-পেরে পরে হাইকোর্টই নেতাইয়ে সিবিআই তদন্তের নির্দেশ দেয়। বর্ধমানের দুই সিপিএম নেতা প্রদীপ তা এবং কমল গায়েন হত্যা-তদন্তে হাইকোর্টের হস্তক্ষেপ চেয়ে তিনটি জনস্বার্থের মামলা হয়। তাতে আবেদনকারীরা সিবিআই তদন্ত চেয়েছিলেন। সিআইডি-র প্রাথমিক রিপোর্ট দেখে হাইকোর্ট এ বার ঠিক করবে, বর্ধমান-কাণ্ডেও তারা সিবিআই তদন্তের নির্দেশ দেবে কি না। তবে মামলার তদন্তকারী অফিসার যে ভাবে ঘটনাটিকে ‘রাজনৈতিক’ বলে মন্তব্য করেছেন, তাতে হাইকোর্ট এ দিন অসন্তোষ চেপে রাখতে পারেনি। পুলিশের ভূমিকাকে রীতিমতো তিরস্কার করেছে আদালত।
এবং এ সবের প্রেক্ষিতেই আইনজীবীদের একাংশ মনে করছেন, নেতাই-কাণ্ড নিয়ে পুলিশি তদন্তে দলতন্ত্রের যে অভিযোগ উঠেছিল, বর্ধমান-কাণ্ডেও কার্যত তার পুনরাবৃত্তি হল। বস্তুত এ দিন হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি জয়নারায়ণ পটেল ও বিচারপতি সম্বুদ্ধ চক্রবর্তীর ডিভিশন বেঞ্চ তদন্ত নিয়ে যে সব প্রশ্ন তুলেছে, তাতে পুলিশের ‘নিরপেক্ষ’ ভূমিকাই সংশয়ে। যেমন, কেস ডায়েরির সঙ্গে ময়না-তদন্ত রিপোর্ট পুলিশ জমা দেয়নি। উপরন্তু তদন্তকারী অফিসার কেস ডায়েরিতে এটিকে ‘রাজনৈতিক ঘটনা’ হিসেবে অভিহিত করায় আদালত বিস্মিত। বেঞ্চের আরও প্রশ্ন, প্রকাশ্য দিবালোকে রাজপথে দু’জন খুন হওয়ার পরেও পুলিশ কেন এত কম লোকের জবানবন্দি নিল? কেনই বা অভিযুক্তদের নিজেদের হেফাজতে নিল না পুলিশ?
দুই সিপিএম নেতার ময়না-তদন্তের ‘ফোটোকপি’ করা রিপোর্ট বিকেলে হাইকোর্টে পৌঁছানোর পরে পুলিশের ভূমিকা সম্পর্কে আদালতের অসন্তোষ বেড়েছে বই কমেনি। কেন?
কারণ, কেস ডায়েরিতে পুলিশ লিখেছিল, তারা ঘটনাস্থল থেকে দুটি বাঁশ ও একটি গাছের ডাল উদ্ধার করেছে। অথচ ময়না-তদন্ত রিপোর্ট বলছে, দু’টি মৃতদেহের বাইরে-ভিতরে অসংখ্য ক্ষত ছিল। ছিল ভোঁতা অস্ত্রে আঘাতের চিহ্ন। সরকারি আইনজীবীর কাছে প্রধান বিচারপতি জানতে চান, মৃতদেহে এত ক্ষত, কিন্তু পাওয়া গেল বাঁশ আর গাছের ডাল! এটা কী করে সম্ভব?
প্রধান বিচারপতির প্রশ্নের কোনও উত্তর সরকারি আইনজীবীরা এ দিন এজলাসে দাঁড়িয়ে দিতে পারেননি। হাইকোর্টের নির্দেশমতো এ দিন পুলিশ বর্ধমান-কাণ্ড নিয়ে কেস ডায়েরি আদালতে পেশ করলেও তার সঙ্গে ময়না-তদন্তের রিপোর্ট জমা দেয়নি। পিএম-রিপোর্ট ছাড়া কেস ডায়েরি কী ভাবে জমা পড়ল, সেই প্রশ্ন তুলে প্রধান বিচারপতি এক সময় মন্তব্য করেন, “রাজ্য সরকার করছেটা কী? বিষয়টি যথেষ্ট উদ্বেগের।” বর্ধমানের ওই দুই সিপিএম নেতাকে হত্যার ঘটনায় হাইকোর্টে দাখিল তিনটি জনস্বার্থ-মামলাকে রাজ্য সরকার যথেষ্ট গুরুত্ব দিচ্ছে কি না, সে সম্পর্কেও সন্দেহ প্রকাশ করে ডিভিশন বেঞ্চ।
কেন তাঁরা রাজ্য সরকারের তদন্তে আস্থা রাখতে পারছেন না?
এক আবেদনকারীর আইনজীবী বিকাশ ভট্টাচার্য আদালতকে বলেন, “ঘটনার ক’ঘণ্টার মধ্যে রাজ্যের তিন-তিন জন মন্ত্রী কলকাতায় বসে জানিয়ে দিলেন, এটা খুন নয়, গণরোষের ফল! রাজ্যের এডিজি সুরজিৎ পুরকায়স্থ জানালেন, দু’পক্ষের সংঘর্ষে মৃত্যু হয়েছে! দিল্লিতে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী বললেন, সিপিএমের অভ্যন্তরীণ গণ্ডগোলেই খুন! তদন্ত শুরুর আগেই কয়েক ঘণ্টার মধ্যে ঘটনাটিকে প্রশাসনের সর্বোচ্চ স্তর থেকে লঘু করে দেওয়া হল। এই সব বক্তব্যের মাধ্যমে পুলিশকে প্রভাবিত করা হল। পুলিশ এর পরে নিরপেক্ষ তদন্ত করবে, তা আশা করা যায় না।” এ দিন আর এক আবেদনকারীর আইনজীবী জয়ন্তনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়ের বক্তব্য, “জেলা পুলিশ তদন্তে নেমে চার জনকে গ্রেফতার করে। অথচ আদালতে তাদের জেরা করার জন্য পুলিশ হেফাজত চাওয়াই হল না! খুনের অভিযোগে ধৃতদের পুলিশ হেফাজত না-চাওয়ার নজির নেই।” অন্য মামলাটির আইনজীবী সুব্রত মুখোপাধ্যায়ের যুক্তি: এই হত্যাকাণ্ডের তদন্ত হাইকোর্টের তত্ত্বাবধানে না-হলে সুবিচার পাওয়া অসম্ভব। তাই তিনি সিবিআই তদন্তের দাবি জানান।
অপর পক্ষে রাজ্য সরকারের তরফে জিপি অশোক বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “গত চৌত্রিশ বছরে এমন অসংখ্য ঘটনা ঘটেছে। নন্দীগ্রাম ও নেতাইয়ের ক্ষেত্রে হাইকোর্টে সিবিআই-তদন্তের আর্জি জানানো হয়েছিল।” উত্তরে প্রধান বিচারপতি বলেন, “ব্যাপারটা চৌত্রিশ বছর বা ছ’মাসের নয়, প্রশাসন যথাযথ কাজ করছে কি না, সেটাই দেখার। আদালত রাজনীতির ক্ষেত্র নয়।” ময়না-তদন্ত রিপোর্ট খতিয়ে দেখে এবং সেই সম্পর্কে রাজ্যের কৌঁসুলিদের বক্তব্য শুনে ডিভিশন বেঞ্চ জানিয়ে দেয়, জেলা পুলিশের তদন্তে তাদের আস্থা নেই। তাই আপাতত সিআইডি-কে দিয়ে তদন্ত করানোর নির্দেশ দেয় আদালত।
রাজ্য সরকার অবশ্য হাইকোর্টের নির্দেশ মেনে নিচ্ছে। ডিভিশন বেঞ্চের রায় চ্যালেঞ্জ করে তারা সুপ্রিম কোর্টে যাচ্ছে না। মুখ্যসচিব সমর ঘোষ এ দিন বলেন, “হাইকোর্টের নির্দেশ মেনে সিআইডি-তদন্তের বিজ্ঞপ্তি জারি হবে।”
স্বাভিবিক ভাবেই বর্ধমান-কাণ্ডে সিআইডি-তদন্তের নির্দেশ এবং তাতে হাইকোর্টের ‘নজরদারি’র সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছে সিপিএম। বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্রের প্রতিক্রিয়া, “তিরস্কার ওদের প্রাপ্য ছিল। যে ভাবে তদন্ত এগোচ্ছিল, মুখ্যমন্ত্রী-সহ মন্ত্রীরা পরস্পরবিরোধী বিবৃতি দিয়ে যে ভাবে তদন্তকে প্রভাবিত করছিলেন, তার বিরুদ্ধে একটা কড়া বার্তা মহামান্য আদালত দিয়েছে। আমরা খুশি। সিআইডি তদন্ত করবে, এবং আদালতের পক্ষ থেকে নজরদারি থাকবে, এতে ভরসা পাচ্ছি।”
উল্লেখ্য, সরকারে থাকাকালীন সিপিএম যে কোনও ঘটনায় সিবিআই-তদন্তের পক্ষপাতী ছিল না। রাজ্য চাইলে তবেই সিবিআই-তদন্তের নীতি মেনে চলার কথা বলত তারা। বিরোধী হয়েও সাধারণ ভাবে তাঁদের সেই অবস্থান যে পাল্টায়নি, তা জানিয়ে সূর্যবাবু বলেন, “সিআইডি বা রাজ্য পুলিশ যে ভাবে পরিচালিত হচ্ছে, তাতে সরকারের উপরে আস্থা রাখতে পারছি না। শুধু রাজনৈতিক সংঘর্ষ বা বামপন্থীদের উপরে আক্রমণ নয়, অনেক অপরাধমূলক ঘটনা রাজ্যে ঘটছে। যেখানে নিরপেক্ষ তদন্ত হচ্ছে বলে আস্থা রাখা যাচ্ছে না। এই ঘটনার (বর্ধমান) বৈশিষ্ট্য হল, এখানে আদালতের নজরদারি থাকবে।”
সরকার কী বলছে? আবেদনকারীদের প্রতি কটাক্ষ করে রাজ্যের শিল্পমন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় বলেন, “সিবিআই-তদন্ত চাওয়া হয়েছিল। হাইকোর্ট সিআইডি-তদন্তের নির্দেশ দিয়েছে। এটা নাকের বদলে নরুন।” আর কোর্টের নির্দেশকে ‘স্বাগত’ জানিয়ে আইনমন্ত্রী মলয় ঘটকের মন্তব্য, “সব ঘটনায় সিবিআই-তদন্ত চাইলে রাজ্য পুলিশের আর দরকার কী?”
তবে পুলিশ বর্ধমান-কাণ্ডকে ‘রাজনৈতিক ঘটনা’ হিসেবে অভিহিত করে হাইকোর্টে তিরস্কৃত হওয়া সত্ত্বেও আইনমন্ত্রী বলছেন, “নন্দীগ্রামে পুলিশের গুলিতে লোক মরেছিল। নেতাইয়ে জমায়েতে গুলি চলেছিল। তাই ওই দু’টো ক্ষেত্রে সিবিআই-কে দিয়ে তদন্ত করানো হয়। কিন্তু বর্ধমানের ঘটনা ওদের গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের ফল।” মলয়বাবুর আরও মন্তব্য, “বাম আমলে প্রায় প্রতিটি ঘটনায় সিবিআই-তদন্তের দাবি জানাতেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। কারণ তিনি মনে করতেন, রাজ্য পুলিশ সিপিএমের সরকারের হয়ে কাজ করে।”
এ দিন ডিভিশন বেঞ্চ জেলা পুলিশের তদন্তে অনাস্থা প্রকাশ করায় এই বিষয়টাই কিন্তু ফের সামনে উঠে এল। কারণ, রাজ্যের পুলিশমন্ত্রী এখন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়!

হাইকোর্টের প্রশ্ন
• তদন্তকারী অফিসার কেস ডায়েরিতে এটিকে ‘রাজনৈতিক ঘটনা’ বললেন কী ভাবে?
• আদালত রাজনীতির আখড়া নয়। খুনকে খুনের ঘটনা হিসেবে কেন দেখা হচ্ছে না?
• সাত দিন আগে হাইকোর্টের নির্দেশ সত্ত্বেও ময়না-তদন্ত রিপোর্ট নেই কেন?
• কেস ডায়েরির সঙ্গেই ময়না-তদন্ত রিপোর্ট পাঠানোর কথা। রাজ্য কী করছে?
• ধৃতদের পুলিশি হেফাজতের পক্ষে কোনও যুক্তিকেন কেস ডায়েরিতে নেই?
• প্রকাশ্য দিবালোকে রাজপথে খুন, কিন্তু জবানবন্দি এত কম লোকের কেন?
• ঘটনাস্থলে দু’টো বাঁশ ও একটা গাছের ডাল পাওয়ার কথা লিখেছে পুলিশ। তা হলে শরীরে এত আঘাত কী ভাবে?
• চৌত্রিশ বছর বা ছ’মাসের প্রশ্ন নয়। গোটা ব্যবস্থাটা ঠিকঠাক চলছে কি?

• জেলা পুলিশের তদন্তে আস্থা নেই
• কোটের্র্র নজরদারিতে সিআইডি তদন্ত
• দরকারে ধৃতদের সিআইডি হেফাজত
• ২৩ মার্চ সিআইডি’র প্রথম দফা রিপোর্ট
• তা দেখে পরবর্তী সিদ্ধান্ত
যা বলল হাইকোর্ট



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.