অসরকারি সংগঠন, পরিভাষায় নন-গভর্নমেন্টাল অর্গানাইজেশন, সংক্ষিপ্ত নামে ‘এন জি ও’ লইয়া একটি বিতর্ক বাধিয়াছে। প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ সম্প্রতি একটি সাক্ষাৎকারে বলিয়াছেন, কুড়ানকুলম-এ একটি পরমাণু শক্তিকেন্দ্র স্থাপনে কিছু ‘এন জি ও’ বাধাদান করিতেছে, যাহারা বৈদেশিক অর্থে পুষ্ট। আমেরিকা হইতে আগত অর্থে এই ‘এন জি ও’গুলি চলে বলিয়া তাঁহার অভিযোগ। তিনি আরও বলিয়াছেন, বাধাদানের অভিপ্রায়টি স্পষ্ট। ভারত তাহার নিজস্ব উন্নয়নমূলক পথে অগ্রসর হউক, ইহা কিছু মহলের অভিপ্রেত নহে। অভিযোগটি গুরুতর, ফলে গভীরতর বিবেচনার যোগ্য। বৈদেশিক স্তরে ইহার একটি তাৎপর্য আছে। আমেরিকা বলিয়াছে, বিষয়টি তদন্ত করিয়া দেখিবে। কুড়ানকুলম-এর পরমাণু শক্তিকেন্দ্রটি রুশ সহযোগে গড়িয়া উঠিবার কথা। সুতরাং, রাশিয়া তৎক্ষণাৎ জানাইয়াছে, দীর্ঘ দিন ধরিয়াই তাহারা এমন একটি সন্দেহ পোষণ করিতেছে। সত্যই কী ঘটিয়াছে, তাহা তদন্তসাপেক্ষ বিষয় কিন্তু, আন্তর্জাতিক স্তর বাদ দিয়া অন্তর্দেশীয় স্তরেও মাননীয় প্রধানমন্ত্রী-কৃত এই অভিযোগের একটি মাত্রা আছে। তাহা ‘এন জি ও’গুলির কর্মপদ্ধতির সহিত সংশ্লিষ্ট।
স্পষ্টতই, সমস্ত ‘এন জি ও’-র বিরুদ্ধে এক অভিযোগ প্রাসঙ্গিক নহে। তাহাদের কর্মপরিধি এবং কর্মপদ্ধতির ভিতর ফারাক বিস্তর। সুতরাং, একই অভিযোগে এই জাতীয় সকল সংগঠনকে অভিযুক্ত করা অনুচিত। যে সব সংগঠনের কর্মকাণ্ডে স্বচ্ছতার অভাবটি দৃশ্যমান, তাহাদের ক্ষেত্রে নিশ্চয়ই তদন্ত জরুরি, কিন্তু তাহা এন জি ও বলিয়া নয়, আইনে বিভিন্ন ধরনের সংস্থার হিসাবপত্র সংক্রান্ত যে বিধি আছে, অসরকারি সংগঠনগুলিকেও তাহার আওতায় আনা দরকার এবং সেই বিধি তাহারা অনুসরণ করিতেছে কি না তাহর তদারকি দরকার। তাহাতে গণতন্ত্রের কণ্ঠরোধ-জাতীয় নানাবিধ প্রতিক্রিয়ায় গগন বিদীর্ণ করিবার কোনও যুক্তি নাই। অনেক এন জি ও-ই নিশ্চয়ই সমাজের পক্ষে মঙ্গলজনক কাজে ব্রতী। একটি গণতান্ত্রিক সমাজের পক্ষে অসরকারি সংগঠনের প্রয়োজনীয়তা লইয়াও কোনও প্রশ্ন নাই। কিন্তু এন জি ও বলিয়াই একটি সংগঠনের কোনও বাড়তি পবিত্রতা বা মহিমা নাই, তাহাও স্মরণ রাখা ভাল।
আবার, কোন এন জি ও স্বদেশি টাকায় চলিতেছে, কোনটি বিদেশি টাকায়, তাহার ভিত্তিতেও তাহাদের মধ্যে বৈষম্য করিবার কোনও যুক্তি নাই। আজকের পৃথিবীতে স্বদেশি টাকা বনাম বিদেশি টাকার দ্বন্দ্ব কার্যত অর্থহীন। কোনও রাষ্ট্র বা কোনও বেসরকারি সংস্থা অন্য দেশে অসরকারি সংগঠনের মাধ্যমে প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করিতেই পারে। সেই চেষ্টা যদি সংশ্লিষ্ট দেশের আইন লঙ্ঘন করে, তাহার প্রতিকারে আইনানুগ ব্যবস্থা লইতে হইবে, কিন্তু নিছক ‘প্রভাব বিস্তার’-এর অভিযোগ অর্থহীন। ভারতের কোনও স্থানে পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন উচিত কি না, তাহা লইয়া বিতর্ক থাকিতেই পারে, থাকা স্বাভাবিক। সেই বিতর্কে যাঁহারা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে যোগ দিতেছেন, তাঁহারা স্বদেশি না বিদেশি, আমেরিকান না অস্ট্রেলিয়ান, তাহা সম্পূর্ণ অপ্রাসঙ্গিক। কী প্রক্রিয়ায় যোগ দিতেছেন, সেই প্রক্রিয়ার মধ্যে কোথাও কোনও অনাচার বা অন্যায় আছে কি না, তাহাই বিচার্য। কুণ্ডকুলম-এর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রকে রুশ-মার্কিন (নাতি)শীতল লড়াইয়ের কেন্দ্রে পরিণত করিবার প্রয়োজন নাই। |