সিপিএমের ‘পাল্টা’ মিছিলে যাদবপুরে ‘সাড়া’ ফেলতে পারল না তৃণমূল। বুধবার প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের নেতৃত্বে মিছিলের পরদিনই ‘জবাবি’ মিছিলের ডাক দিয়েছিল তৃণমূল। কিন্তু ভিড়ের নিরিখে তো বটেই, ‘স্বতঃস্ফূর্ততা’র দিক দিয়েও সিপিএমের কাছে ‘হার’ হল তাদের। যা দেখে যথেষ্ট ‘খুশি’ সিপিএম। দলের এক প্রথম সারির নেতার কথায়, “মনে রাখতে হবে, দুটো মিছিলই কিন্তু এক দিনের নোটিসে ডাকা। সেই তথ্য খেয়াল রাখলে ব্যাপারটা বুঝতে আরও সুবিধে হবে!”
সিপিএমের মিছিল নিয়ে এলাকার মানুষের মধ্যে দৃশ্যতই একটা কৌতূহল ছিল। ফলে রাস্তার আশপাশের বাড়ির বারান্দা বা ছাদ থেকেও মহিলা-পুরুষরা মিছিলের ‘সাক্ষী’ হয়েছেন। অনেকে নেমেও এসেছিলেন রাস্তায়। তৃণমূলের মিছিলে এ দিন তেমন কিছু নজরে পড়েনি। বরং মিছিলে ‘বহিরাগত’ই ছিল বেশি। বস্তুত, ‘মুখরক্ষা’র জন্য শহরের বিভিন্ন ওয়ার্ড থেকে লরি ভর্তি করে লোকজনও নিয়ে আসা হয়েছিল। রাজ্যের মন্ত্রীদের একাংশও লোক ‘সরবরাহ’ করেছিলেন। কিন্তু তাতেও ‘শেষ রক্ষা’ হয়নি। দলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নির্দেশেই এ দিন মিছিলের কর্মসূচি নিয়েছিলেন দলীয় নেতৃত্ব। তাতে যথেষ্ট ‘ঝুঁকি’ ছিল। কারণ স্বয়ং মমতা মিছিলে ছিলেন না। তৃণমূলেরই একাংশের মতে, সেই জন্যই মিছিলে কোনও ‘স্বতঃস্ফূর্ততা’ লক্ষ করা যায়নি। মমতা নিজে মিছিলে হাঁটলে মহিলাদের একটা ‘নিশ্চিত ভিড়’ জমে যায়। মমতাও নিজস্ব স্টাইলে তাঁদের সঙ্গে ‘জনসংযোগ’ করেন। সেটাই এ দিন অনুপস্থিত ছিল। সে দিক দিয়ে এ দিনের মিছিলের সিদ্ধান্ত ‘হঠকারী’ বলেই দলের একাংশ মনে করছে। এক নেতার কথায়, “ওভার বাউন্ডারি মারতে গিয়ে ক্যাচ তুলে আউট হয়েছি। স্ট্রোকটা বাউন্ডারির ধারপাশ পর্যন্ত পৌঁছলেও একটা কথা ছিল। এ তো মাঝমাঠেও পেরোয়নি!” তবে ওই নেতার আশা, শনিবার মমতা রাস্তায় নামলে এই ‘ঘাটতি’ পুষিয়ে দেওয়া যাবে। রাজ্যের এক মন্ত্রী বলেওছেন, “দিদি এলে তো রাস্তা ভরে যাবে!” |
প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী তথা যাদবপুরের প্রাক্তন বিধায়ক বুদ্ধবাবুর নেতৃত্বে সিপিএম তথা বামফ্রন্টের মিছিল যে পথ দু’ঘণ্টায় অতিক্রম করেছে, সেই একই পথ তৃণমূলের মিছিল পেরিয়ে গিয়েছে ঘণ্টাখানেকে। তাঁদের মিছিল ‘ফ্লপ’ করেছে, এমন কথা প্রকাশ্যে প্রত্যাশিত ভাবেই স্বীকার করতে চাননি নেতা-মন্ত্রীরা। যদিও প্রকারান্তরে বিষয়টা মেনেই নিয়েছেন। রাজ্যের মন্ত্রী ও টালিগঞ্জের বিধায়ক অরূপ বিশ্বাসের যেমন ঘোষণা করেছেন, “এই মিছিল তো শনিবারের মহড়া মাত্র!” আর কেন্দ্রীয় মন্ত্রী সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথায়, “যাদবপুর জনসমুদ্র আর কী দেখেছে! শনিবার সাত সমুদ্রের গর্জন শুনবে!” যা থেকে এই ইঙ্গিত খুব পরিষ্কার যে, ‘দিদি’ ছাড়া ভিড় জোটানো মুশকিল। ভিড় টানতে মমতাই ‘ভরসা’।
বস্তুত, বুদ্ধবাবুদের মিছিল ছিল ধর্মঘটের দিন গাঙ্গুলিবাগানে সিপিএমের জোনাল কার্যালয়ে তৃণমূলের হামলা ও সাংবাদিক-নিগ্রহের প্রতিবাদে। তৃণমূলের মিছিল ছিল স্রেফ তার ‘পাল্টা’। এ ছাড়া নির্দিষ্ট কোনও বিষয় ছিল না। তার প্রভাবও মিছিলের আয়তনে পড়ে থাকতে পারে বলে দলের একাংশের ধারনা। বুদ্ধ-জমানার শেষ দিকে তাঁর যে কোনও রাজনৈতিক কর্মসূচির ‘পাল্টা’ কর্মসূচি নিত বিরোধী তৃণমূল। এ দিনের মিছিল নিয়ে স্বভাবতই সিপিএমের ‘কটাক্ষ’ শাসক হয়ে গেলেও দেখা যাচ্ছে, তৃণমূলের সেই ‘বিরোধী উপসর্গ’ কাটেনি! কয়েক মাস আগে মেদিনীপুরে সিপিএমের জেলা সম্মেলনের সমাবেশে বুদ্ধবাবু বক্তৃতা দিয়ে আসার পর দিন একই মাঠে রাতারাতি পাল্টা সমাবেশ করেছিলেন মুকুল রায়েরা। সেখানে ভিড় হয়েছিল ভালই। কিন্তু তখনও পার্ক স্ট্রিট বা বর্ধমানের ঘটনা ঘটেনি। তখনও মুখ্যমন্ত্রী লাগাতার ‘বেফাঁস’ মন্তব্য করা শুরু করেননি।
দলের একাংশ এ দিনের মিছিলকে ‘হঠকারী’ বলছে আরও একটি কারণে। তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্তে বুদ্ধবাবুদের ‘জবাবি’ কর্মসূচি নিতে গিয়ে নিজের নির্দেশের কথাই মাথায় রাখেননি মুখ্যমন্ত্রী! দলের প্রতি তৃণমূল নেত্রীর স্পষ্ট নির্দেশ হল, কাজের দিনে মিছিল করা যাবে না। কিন্তু তাঁর নির্দেশেই বৃহস্পতিবার কাজের দিন সন্ধ্যায় মিছিল করেছে তৃণমূল। তবে এ দিন ৮বি বাসস্ট্যান্ড থেকে গাঙ্গুলিবাগান পর্যন্ত মিছিল হয়েছে রাস্তার এক দিকে যান চলাচলের ব্যবস্থা রেখেই। ফলে মিছিল শেষ হওয়ার পরেই রাজা সুবোধ মল্লিক রোডে যান চলাচল শুরু হয়ে যায়।
তাঁদের বিরুদ্ধে সিপিএমের ‘চক্রান্তে’র প্রতিবাদে এবং রাজ্যে উন্নয়নের পক্ষে মিছিল করছেন বলে তৃণমূলের মহাসচিব তথা শিল্পমন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় জানিয়েছেন। যাদবপুরের বর্তমান বিধায়ক তথা বিদ্যুৎমন্ত্রী মণীশ গুপ্ত, পার্থবাবু, সুদীপবাবু, মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায়, বিধানসভার সরকারি মুখ্য সচেতক শোভনদেব চট্টোপাধ্যায়, তৃণমূলের রাজ্য সভাপতি তথা সাংসদ সুব্রত বক্সী সকলেই মিছিলে ছিলেন। মিছিলের পুরোভাগে অনুগামীদের নিয়ে ছিলেন মুখ্যমন্ত্রীর ভাইপো ও ‘অল ইন্ডিয়া তৃণমূল যুবা’র সভাপতি অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। ‘গুরুত্ব’ বাড়াতে মাঝপথে মিছিলে যোগ দেন মন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম, মদন মিত্র। মিছিল শুরুর আগে পার্থবাবু বলেন, “সিপিএমের বস্তাপচা নেতা, যাঁদের মানুষ ইতিমধ্যেই বাতিল করেছেন, তাঁদের আবার বস্তাবন্দি করে দিতেই আমরা পথে নেমেছি!” কিন্তু এ দিনের মিছিলে যে সিপিএম-কে ‘বস্তাবন্দি’ করা যায়নি, সেই ‘সত্য’ও মিছিল শেষে মদনবাবুর বক্তব্যে স্পষ্ট, “শনিবার মুখ্যমন্ত্রী যখন হাঁটবেন, সিপিএম ফের দেখবে, মানুষ রয়েছে মমতার সঙ্গেই!” অর্থাৎ, এ দিন মানুষ তাঁদের সঙ্গে ছিলেন না।
তৃণমূলের একাধিক প্রথম সারির নেতা জানাচ্ছেন, শনিবারের মিছিলে তাঁরা ‘দেখিয়ে’ দেবেন। তার প্রস্তুতিও শুরু হয়ে গিয়েছে। দেখার, পাহাড়-ফেরত মমতা রাস্তায় নেমে এ দিনের ‘ক্ষতি’ কতটা ‘মেরামত’ করতে পারেন। |