রাজদীপ বন্দ্যোপাধ্যায় • বাঁকুড়া |
বাঁকুড়া মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের সেই মূক ও বধির তরুণীর এ বার ডাক্তারি পরীক্ষা হল এসএসকেএম হাসপাতালে।
মঙ্গলবার বাঁকুড়া মেডিক্যালে ওই তরুণীর ডাক্তারি পরীক্ষার ‘নেগেটিভ রিপোর্ট’ মেলে। এর পরেই এসএসকেএমে ফের তাঁর পরীক্ষা করানোর নির্দেশ দেন বাঁকুড়ার পুলিশ সুপার প্রণব কুমার। বুধবার দুপুর আড়াইটে নাগাদ ওই তরুণী ও তাঁর মাকে নিয়ে পুলিশ এসএসকেএমে পৌঁছয়। কিন্তু, স্বাস্থ্যকর্তাদের লিখিত নির্দেশ না আসা পর্যন্ত তাঁরা পরীক্ষা করতে পারবেন না বলে এসএসকেএম কর্তৃপক্ষ জানিয়ে দেওয়ায় পরীক্ষার কাজ শুরু করতে কিছু দেরি হয়। বিকেলে ফ্যাক্সে স্বাস্থ্য-শিক্ষা অধিকর্তার নির্দেশ পাওয়ার পরে এসএসকেএমের ফরেন্সিক, স্ত্রী-রোগ ও মনোরোগ বিভাগের চিকিৎসকেরা ওই তরুণীকে পরীক্ষা করেন। পরে ফরেন্সিক বিভাগের প্রধান বিশ্বনাথ কাহালি বলেন, “মেয়েটির শারীরিক পরীক্ষানীরিক্ষা করা হয়েছে। সেই রাতে মেয়েটির পরনের পোশাক সংরক্ষণ করা হয়েছে। রিপোর্ট নির্দিষ্ট সময়ে জেলাশাসক ও পুলিশ সুপারের কাছে পাঠিয়ে দেওয়া হবে।” |
বাঁকুড়া মেডিক্যালে মহিলা সমিতির বিক্ষোভ। |
অন্য দিকে, বাঁকুড়া মেডিক্যালের যে হাউসস্টাফের বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগ উঠেছে, তাঁর বিরুদ্ধে এখনও বিভাগীয় ব্যবস্থা না নেওয়ায় প্রশ্ন উঠছে বিভিন্ন মহলে। অথচ ঘটনাক্রম থেকে স্পষ্ট, অভিযুক্ত হাউসস্টাফকে রাজ্য স্বাস্থ্য দফতর ও পুলিশ চিহ্নিত করতে পেরেছে। ওই হাউসস্টাফের মা এ দিন সন্ধ্যায় বাঁকুড়ার একটি লজে দাবি করেন, “আমার ছেলেকে মিথ্যা সন্দেহ করা হচ্ছে।” হাসপাতালের চার সদস্যের তদন্ত কমিটি এ দিন ওই হাউসস্টাফকে জিজ্ঞাসাবাদ করে। ওই হাউসস্টাফকে আপাতত মহিলা ওয়ার্ডে ‘ডিউটি’ করতেও মানা করা হয়েছে। অর্থাৎ, অভিযোগের তির কার দিকে, তা খুব ভাল করেই জানেন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।
ওই হাউসস্টাফকে কেন শনাক্ত করানো হল না, সে প্রশ্ন তুলে এ দিন গণতান্ত্রিক মহিলা সমিতি বাঁকুড়া মেডিক্যালের ভারপ্রাপ্ত সুপার সরোজ ভট্টাচার্য ও পুলিশ সুপারের কাছে স্মারকলিপি দেয়। এসএসকেএমে এ দিন তরুণীর মা-ও জানান, তাঁর যা জানানোর, মঙ্গলবারই জানিয়ে দিয়েছিলেন। তার পরে কোনও তরফে শনাক্তকরণ করানোর প্রক্রিয়া হয়নি।
মঙ্গলবার রাতে হাসপাতালে পুলিশ সুপার প্রণব কুমারও ওই হাউসস্টাফের সঙ্গে কথা বলেন। তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল ‘ফিমেল মেডিসিন’ ওয়ার্ডেও। এর পরেও কেন ওই হাউসস্টাফের পরিচয় নিয়ে এত গোপনীয়তা, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন হাসপাতালের রোগীর বাড়ির লোকজন। তাঁদের কয়েক জনের বক্তব্য, “ধর্ষণের মতো গুরুতর অভিযোগ পাওয়ার পরেও কেন ওই হাউসস্টাফকে ডেকে শনাক্তকরণ করানো হচ্ছে না, তা আমরা বুঝতে পারছি না। তা হলে কি স্বাস্থ্য দফতর গোটা ঘটনাই চেপে যেতে চাইছে?”
এই প্রশ্নের উত্তরে মুখে কুলুপ এঁটেছেন স্বাস্থ্য-কর্তারা। স্বাস্থ্য-শিক্ষা অধিকর্তা সুশান্ত বন্দ্যোপাধ্যায় শুধু বলেন, “রিপোর্ট হাতে আসার আগে কোনও মন্তব্য করব না।” আবার পুলিশ সুপার বলেছেন, “বিষয়টি খুবই স্পর্শকাতর। অনেক কিছু ভেবে আমাদের এগোতে হচ্ছে। তবে রিপোর্টের উপরে অনেক কিছু নির্ভর করছে। তবে ওই হাউসস্টাফকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। আপাতত বাঁকুড়া না ছাড়তে বলা হয়েছে।” |
বাঁকুড়ায় ‘ধর্ষণকাণ্ডে’ পরীক্ষার জন্য নিয়ে যাওয়া হচ্ছে তরুণীর পোশাক ও হাসপাতালের বিছানা। |
ঘটনার সময় অভিযুক্ত হাউসস্টাফ কোথায় ছিলেন, তা নিয়ে বাঁকুড়া মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের দুই শীর্ষ কর্তার বক্তব্যেও এ দিন অসঙ্গতি উঠে এসেছে। মেডিক্যাল কলেজের অধ্যক্ষ মনোজ চৌধুরীর দাবি, “ওই হাউসস্টাফ আমাদের জানিয়েছেন, সোমবার রাত ১০টা পর্যন্ত তিনি দোতলার ‘মেল মেডিক্যাল’ ওয়ার্ডে ছিলেন। তার পর হস্টেলে যান। তবে প্রকৃত ঘটনা কী, পুলিশ তা তদন্ত করে দেখছে।” হাসপাতাল সুপার পঞ্চানন কুণ্ডু (মেয়ের পরীক্ষার জন্য ছুটিতে রয়েছেন) এ দিন টেলিফোনে বলেন, “ওই হাউসস্টাফ জানিয়েছেন, ‘মেল মেডিক্যাল’ ওয়ার্ডে রোগী দেখার পরে তিন তলার ‘ফিমেল মেডিক্যাল’ ওয়ার্ডে গিয়ে ওই তরুণীর শারীরিক পরীক্ষা করেন। কিন্তু, তাঁর সঙ্গে কোনও অশালীন আচরণ করেননি বলে আমাদের কাছে দাবি করেছেন।”
প্রশ্ন উঠেছে, সোমবার অত রাতে ওই তরুণীকে তিনি কী এমন জরুরি পরীক্ষার জন্য সেই ওয়ার্ডে গিয়েছিলেন? তা ছাড়া কাঠের পার্টিশন দেওয়া ঘরে তিনি তরুণীকে একাই নিয়ে যান বলে অভিযোগপত্রে দাবি করা হয়েছে।
কলকাতায় ওই তরুণীর ডাক্তারি পরীক্ষা করানোর প্রয়োজন হল কেন?
অধ্যক্ষ মনোজবাবু বলেন, “মঙ্গলবার রাতে এখানে ওই তরুণীর মেডিক্যাল পরীক্ষায় ‘নেগেটিভ রিপোর্ট’ পাওয়া যায়। এখানে ফরেন্সিক পরীক্ষা করারও পরিকাঠামো রয়েছে। কিন্তু পুলিশ সুপার ফরেন্সিক ও ডাক্তারি পরীক্ষার জন্য ওই তরুণীকে এসএসকেএমে নিয়ে যেতে বলেন। স্বাস্থ্য সচিবের সঙ্গে আলোচনা করে তরুণীকে এ দিন সকালে এসএসকেএমে পাঠানো হয়।” পুলিশ সুপারের বক্তব্য, “তদন্তের স্বার্থেই ওই পরীক্ষা করতে এসএসকেএমে তরুণীকে পাঠানো হয়।”
জেলা পুলিশের এক কর্তা জানান, অভিযুক্ত যুবক বাঁকুড়া মেডিক্যালেরই হাউসস্টাফ হওয়ায় নিরপেক্ষ রিপোর্ট পেতে অন্য জায়গায় ডাক্তারি পরীক্ষা করানো দরকার ছিল। অভিযুক্ত হাউসস্টাফের ডাক্তারি পরীক্ষা করানো হয়নি বলেও হাসপাতাল সূত্রের খবর। অথচ এমন অভিযোগের ক্ষেত্রে তা করাই নিয়ম।
মূক ও বধিরদের বিভিন্ন সংগঠনের প্রতিনিধিরা ওই তরুণীর ‘পাশে দাঁড়াতে’ এসএসকেএমে ভিড় করেন। বিকেলে পুলিশকর্মীরা ওই তরুণীকে নিয়ে সেখান থেকে বেরোন। প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি প্রদীপ ভট্টাচার্য জানিয়েছেন, দলের মহিলা প্রতিনিধিদল ওই তরুণীর সঙ্গে শীঘ্রই দেখা করবে।
|