পরিবর্তন শব্দটি রূপান্তর বা বদল অর্থে ব্যবহৃত হয়। এই ব্যবহার তুলনায় আধুনিক। অতীতে পরিবর্তন বলিতে মুখ্যত আবর্তন বোঝানো হইত। ‘চক্রবৎ পরিবর্তন্তে দুঃখানি চ সুখানি চ’ নামক প্রসিদ্ধ শ্লোকে পরিবর্তনের এই চক্রাকার স্বরূপ অতি স্পষ্ট। চাকা ঘুরিলে গাড়ি অগ্রসর হয় বটে, কিন্তু তাহা তো আবর্তনের একটি ব্যবহারমাত্র। আবর্তন নিজে আগায়ও না, পিছায়ও না। বস্তুত, বিশুদ্ধ আবর্তনের পরিণাম একটি কথাতেই প্রকাশ করা যায়: ন যযৌ, ন তস্থৌ। সুতরাং বিশুদ্ধ পরিবর্তন কোনও রূপান্তরের জন্ম দেয় না, স্থিতাবস্থাই তাহার যথার্থ ফল। পশ্চিমবঙ্গ এই বিশুদ্ধ পরিবর্তনের মহাতীর্থ। ২০১১ সালে মহাকরণে নূতন সরকার আসিয়াছে। সেই সরকার ‘পরিবর্তন’-এর সওয়ার হইয়াই আসে, এবং আসিয়াও পরিবর্তনের বাণীই প্রচার করিতে থাকে। পশ্চিমবঙ্গবাসী ভাবিয়াছিলেন, এ বার বুঝি তাঁহাদের রাজ্যটি বদলাইবে। দ্রুত স্পষ্ট হইতে থাকে যে, কিছুই বদলায় নাই। ভুল হইল, কিছু বদলাইয়াছে। লাল রং প্রথমে সবুজ এবং পরে নীল হইয়াছে, ক্রমে হয়তো রামধনু হইতে অন্য রঙেদেরও ডাক পড়িবে। কিন্তু বাঙালি কবি কবেই বলিয়াছেন, শুধু পোশাকের রং বদলায়, শুধু মুখোশের ঢং বদলায়...
প্রকৃত বদল আসিতে পারে একটি বস্তু বদলাইলে তবেই। সেই বস্তুটির নাম মন। কিংবা, মানসিকতা। পশ্চিমবঙ্গের সমাজের মানসিকতা বদলায় নাই। মানসিকতা যেখানে ছিল সেখানেই আছে। পরিবর্তন সম্পূর্ণ হইয়াছে। তিন শত ষাট ডিগ্রি। প্রমাণ? প্রমাণ ২৮ ফেব্রুয়ারি, ২০১২। চরমতম প্রমাণ। এই দিন অন্তত কলিকাতা শহরে যানবাহনের অভাব ছিল না। যাত্রীদের উপর হামলার অভিযোগও কার্যত শোনা যায় নাই। সাধারণ যাত্রীদের জন্য সরকার পরিবহণ এবং নিরাপত্তা, দুইয়েরই ব্যবস্থা করিয়াছিলেন। কিন্তু নাগরিকরা রাস্তায় নামেন নাই, ঘরের বাহিরে পা বাড়ান নাই। তাঁহারা বেমালুম ছুটি করিয়া দিয়াছিলেন। দোকানপাটের মালিকরাও ঝাঁপ তোলেন নাই। সরকারি অফিসে হাজিরার ভাল হার সরকারের সদিচ্ছাকেই চিনাইয়া দিয়াছে, কিন্তু নাগরিকরা সেই সদিচ্ছায় অনুপ্রাণিত হইয়া ধর্মঘটের সংস্কৃতি ছাড়িয়া কাজের সংস্কৃতিতে ফিরিয়া আসিয়াছেন, এমন কথা মনে করিবার কিছুমাত্র কারণ নাই। এই দিনের সাধারণ ধর্মঘট প্রমাণ করিল, সরকার সর্বতোভাবে কাজের পরিবেশ বজায় রাখিবার চেষ্টা করিলেও নাগরিকরা স্রেফ হাত গুটাইয়া লইয়া সেই চেষ্টা বানচাল করিয়া দিবেন।
বস্তুত, এমন স্বতঃস্ফূর্ত সাধারণ ধর্মঘট তথা বন্ধ পশ্চিমবঙ্গেও কমই দেখা গিয়াছে। কাজ না করিবার যে মানসিকতা পশ্চিমবঙ্গের চরিত্রলক্ষণ বলিয়া ভূভারতে বিদিত, তাহা যে কত বড় সত্য এবং কতখানি দুর্মর ও (অ)পরিবর্তনীয়, তাহা নির্ভুল ভাবে প্রমাণিত হইল। ধর্মঘটের আয়োজক বামপন্থীরা তাঁহাদের সাফল্য লইয়া শ্লাঘা বোধ করিতে পারেন, করিয়াছেনও, তবে ইহার সহিত তাঁহাদের ঘোষিত দাবিদাওয়া বা রাজনৈতিক আদর্শের কিছুমাত্র সম্পর্ক নাই। তাঁহাদের প্রকৃত কৃতিত্ব এইখানে যে তাঁহারা একটি জাতিকে কর্মবিমুখতার মন্ত্রে সম্পূর্ণ দীক্ষিত করিয়া তুলিতে পারিয়াছেন। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এই সত্যটিকে কতটা গভীর ভাবে অনুধাবন করিতে পারিয়াছেন, বলা শক্ত। তিনি যে ফাঁকির বদলে কাজের অভ্যাস ফিরাইতে চাহিয়াছিলেন, তাহা অনস্বীকার্য। সে জন্য তিনি যে কঠোর অবস্থান লইয়াছিলেন, তাহা পশ্চিমবঙ্গে কার্যত অদৃষ্টপূর্ব বলিয়াই বিশেষ ভাবে প্রশংসনীয়। কিন্তু ঘোড়াকে জোর করিয়া জলের কাছে আনিয়া হয়তো জল পান করানো যায়, কাজ করিবার সমস্ত আয়োজন করিয়া দিলেও বাঙালিকে কাজে মন দেওয়ানো যায় না এই সত্যটি তাঁহার সম্মুখে প্রকাণ্ড আকার ধারণ করিয়া আবির্ভূত হইয়াছে। ইহাই পশ্চিমবঙ্গের ‘পরিবর্তনশীল’ সত্য। এই কারণেই পশ্চিমবঙ্গের ভবিষ্যৎ তমসাবৃত। তাহার বর্তমানের মতোই। |