‘রাজধর্ম’ পালনে মমতার প্রশংসায় মন্ত্রীরা
পুলিশের গায়ে হাত, ধৃত মুখ্যমন্ত্রীর ভাইপো
র্তব্যরত ট্র্যাফিক পুলিশকে ধাক্কাধাক্কি ও কাজে বাধা দেওয়ার অভিযোগে গ্রেফতার হলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভাইপো আকাশ বন্দ্যোপাধ্যায়। ঘটনাটিকে তৃণমূলের শীর্ষ নেতৃত্ব ও রাজ্যের মন্ত্রীরা মমতার ‘রাজধর্ম’ পালনের দৃষ্টান্ত বলে ব্যাখ্যা করছেন।
আকাশ বন্দ্যোপাধ্যায়
পুলিশের অভিযোগ, বুধবার সকালে খিদিরপুর মোড়ের কাছে ট্র্যাফিক বিধি ভেঙে গাড়ি নিয়ে যাওয়ার সময় বাধা পেলে কর্তব্যরত ট্র্যাফিক ইনস্পেক্টর এবং এক কনস্টেবলকে তিনি ও তাঁর দুই সঙ্গী ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেন। ‘অশ্রাব্য গালিগালাজ’ করেন। সঙ্গীদের নিয়ে ট্র্যাফিক কর্মীদের আটকেও রাখেন।
ঘটনা ঘটার সময়েই অবশ্য আকাশ ও তাঁর সঙ্গীদের গ্রেফতার করেনি পুলিশ। তাঁরা তখনকার মতো চলেও গিয়েছিলেন। ইতিমধ্যে সেই খবর ছড়িয়ে পড়ায় তাঁদের গ্রেফতারের দাবিতে বিক্ষোভ দেখাতে শুরু করে কংগ্রেস। এই দাবিতে কংগ্রেসের পক্ষ থেকে এ দিন দুপুরে খিদিরপুর মোড় আধ ঘণ্টা অবরোধও করা হয়। খবর পৌঁছে যায় সংবাদমাধ্যমগুলিতেও। এর ঘণ্টা দুয়েক পরে মুখ্যমন্ত্রীর ভাইপো আকাশ এবং গাড়ির চালক-সহ মোট চার জনকে গ্রেফতার করা হয়। গাড়িটিও আটক করে পুলিশ। এই গাড়িটি নিয়েই আকাশ কয়েক দিন আগে শিবপুর বটানিক্যাল গার্ডেনে মুখ্যমন্ত্রীর ভাইপো পরিচয় দিয়ে আইন ভেঙে ঢুকেছিলেন বলে অভিযোগ উঠেছিল। সেটি তদন্তাধীন।
কিন্তু এ দিন বিধি ভাঙার অভিযোগ ওঠার পরে আকাশের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে কেন এত দেরি করল পুলিশ? মুখ্যমন্ত্রীর ‘আত্মীয়’ বলেই কি তাঁর ‘অনুমতি’ আসার আগে আকাশকে গ্রেফতার করা হয়নি? লালবাজারে স্পেশাল পুলিশ কমিশনার শিবাজী ঘোষ এ দিন দাবি করেন, “আকাশদের গ্রেফতার করতে বলেন মুখ্যমন্ত্রী নিজেই।” তা হলে কি অত ক্ষণ মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশের অপেক্ষা করছিল পুলিশ? এই প্রশ্নের কোনও সদুত্তর অবশ্য লালবাজারে পুলিশের শীর্ষকর্তাদের কাছ থেকে পাওয়া যায়নি।
যদিও ওয়াটগঞ্জ থানার পুলিশের দাবি, তখন মাধ্যমিক পরীক্ষার্থীরা ওই পথ দিয়ে যাচ্ছিল। তাদের সুবিধা করে দেওয়াটাই ছিল পুলিশের প্রথম কাজ। গোটা ঘটনার জেরে রাস্তায় যানজট বাড়ছে দেখে গাড়ির নম্বর লিখে তখনকার মতো ছেড়ে দেওয়া হয় আকাশদের। পরে বিদ্যাসাগর সেতু ট্র্যাফিক গার্ডের ওসি-র অভিযোগের ভিত্তিতে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া হয়। ধৃতদের বিরুদ্ধে জামিন অযোগ্য ধারা দেওয়া হয়েছে।
ফিরহাদ হাকিম,
একটা ছোট্ট ঘটনা। এমন তো কলকাতা বা সারা দেশে হামেশাই ঘটে। আকাশ একটা বাচ্চা ছেলে। তৃণমূলের সঙ্গেও যুক্ত নয়। তবু মুখ্যমন্ত্রী দেখিয়ে দিলেন, কেউই আইনের ঊর্ধ্বে নয়।
মহাকরণে বসে এ দিন রাজ্যের পুর ও নগরোন্নয়ন মন্ত্রী ফিরহাদ (ববি) হাকিম বলেছেন, “নিজের ভাইপো হওয়া সত্ত্বেও আকাশকে গ্রেফতার করার নির্দেশ দিয়ে রাজধর্ম পালন করেছেন মুখ্যমন্ত্রী।” তাঁর অভিযোগ, “রাজ্য সরকারের উন্নয়নমূলক কাজ যাতে লোকে দেখতে না পান, তাই নেতিবাচক খবর বড় করে দেখানো হচ্ছে।” তৃণমূলের রাজ্য সভাপতি সুব্রত বক্সী বলেন, “মুখ্যমন্ত্রীর ভাইপোকে গ্রেফতার করে রাজ্য প্রশাসন নজির সৃষ্টি করেছে।” দলের আর এক শীর্ষ নেতা তথা কেন্দ্রীয় মন্ত্রী সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়ের মন্তব্য: “কোন রাজ্যে এমন ঘটনা হয়! মুখ্যমন্ত্রীর ভাইপোকে পুলিশ গ্রেফতার করে রাজধর্ম পালন করেছে।” সিপিএম অবশ্য এই ঘটনা নিয়ে কোনও বিশদ প্রতিক্রিয়া দিতে চায়নি। দলের এক শীর্ষ নেতার মন্তব্য: “একটা ঘটনা ঘটেছে। পুলিশ গ্রেফতার করেছে। এটা প্রশাসনের ব্যাপার।”
পুলিশ জানিয়েছে, আকাশের অন্য যে দুই সঙ্গীকে ধরা হয়েছে, তাঁরা হলেন অমিত মিশ্র ও নীতেশ সিংহ। এ ছাড়াও গ্রেফতার করা হয়েছে চালক মহম্মদ ফারমুদ্দিনকে। অমিতের বাড়ি খিদিরপুরের মুন্সিগঞ্জ রোডে। তিনি তৃণমূল ‘যুবা’র নেতা বলে পরিচিত। নীতেশ হাইড রোডে থাকেন। ফারমুদ্দিন সার্কুলার গার্ডেনরিচ রোডের বাসিন্দা। আকাশের ঠিকানা মুখ্যমন্ত্রীর বাড়ির পাশেই ২০বি, হরিশ চ্যাটার্জি স্ট্রিট।
ঠিক কী ঘটেছিল এ দিন?
ট্র্যাফিক পুলিশ জানায়, এ দিন সকালে আকাশ এবং তাঁর সঙ্গীরা স্লেট রংয়ের একটি গাড়িতে বিএনআর-এর দিক থেকে ফিরছিলেন। বেলা পৌনে ১১টা নাগাদ খিদিরপুর মোড়ের কাছে ডায়মন্ড হারবার রোড এবং সার্কুলার গার্ডেনরিচ রোডের মোড়ে তাঁরা ট্র্যাফিক বিধি না-মেনে গাড়িটি এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন। মাধ্যমিক পরীক্ষার্থীদের সুবিধার জন্য ওই সময় বিদ্যাসাগর সেতুর ট্র্যাফিক গার্ডের ওসি সুবীর ঘোষ তাঁর সহকর্মীদের নিয়ে যান নিয়ন্ত্রণ করছিলেন। আকাশদের গাড়ি অন্য গাড়িকে নিয়ম বহির্ভূত ভাবে ওভারটেক করে সিগন্যাল অমান্য করে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে দেখে এক ট্র্যাফিক সার্জেন্ট ওই গাড়ির চালককে গাড়ি পিছিয়ে নিতে এবং অন্য দিকের যানবাহনকে যাওয়ার সুবিধা করে দিতে বলেন। না হলে, ট্র্যাফিক আইন অমান্যের জন্য তিনি মামলা করতে বাধ্য হবেন বলেও জানান।
পুলিশের অভিযোগ, তা সত্ত্বেও চালক গাড়ি এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলে ট্র্যাফিক কর্মীরা আকাশদের গাড়ি দাঁড় করিয়ে দেন। সেই সময় গাড়ির দরজা খুলে বেরিয়ে আসেন আকাশ ও তাঁর সঙ্গীরা। পুলিশের অভিযোগ, ওই সার্জেন্টের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করেন আকাশ। তাঁকে ধাক্কা মারা হয়। সহকর্মীকে ধাক্কা মারা হচ্ছে দেখে এগিয়ে যান ওসি নিজে। ট্র্যাফিক পুলিশের কর্মীদের দাবি, ওসি-কে আকাশ বলেন, তিনি মুখ্যমন্ত্রীর ভাইপো। তাঁদের গাড়ি কেন আটকানো হয়েছে তার কৈফিয়ৎ চান। ওসি-কেও ধাক্কা মারেন আকাশ ও তাঁর সঙ্গীরা। তাই দেখে ওসি-র গাড়ির চালক আকাশদের বাধা দিতে গেলে তাঁকেও সজোরে ধাক্কা মারা হয় বলে অভিযোগ। পুলিশের অভিযোগ, আকাশ ও তাঁর সঙ্গীরা ‘অশ্রাব্য গালিগালাজ’ করছিলেন ওসি এবং তাঁর সহকর্মীদের। ওসি-কে এ-ও বলা হয়েছিল, অবিলম্বে তাঁর চাকরি কেড়ে নেওয়া হবে।
ওয়াটগঞ্জ থানা সূত্রের খবর, বেলা ১২টা নাগাদ সুবীরবাবু লিখিত অভিযোগ দায়ের করেন আকাশ-সহ চার জনের বিরুদ্ধে। এর পরেই ওই গাড়ি এবং তার আরোহীদের খোঁজ শুরু করে পুলিশ। বেলা একটা নাগাদ বাসকুল ব্রিজের কাছে গাড়িটিকে দেখতে পান ট্র্যাফিক কর্মীরা। তাঁরা খবর দেন ওয়াটগঞ্জ থানায়। পুলিশ সেখান থেকেই আকাশদের গ্রেফতার করে।
প্রাথমিক তদন্তের পরে পুলিশ জেনেছে, ওই গাড়ি আসগর খান নামে ব্রেস ব্রিজের বাসিন্দা এক যুবকের। তিনি আকাশের বন্ধু। মাস ছ’য়েক আগে তিনি ওই গাড়ি কেনেন। তার পর থেকে প্রায়ই ওই গাড়ি ব্যবহার করতেন আকাশ। তদন্তকারী অফিসারেরা জানান, আসগরের সঙ্গে আকাশের কী কারণে ঘনিষ্ঠতা, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। আসগরের রোজগারের উৎস কী, সেই বিষয়েও খোঁজ নিচ্ছেন তদন্তকারীরা।
পুলিশ এই সব জানতে চাইছে কেন? কলকাতা পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চের গোয়েন্দারা জানান, এ দিনের ঘটনাই প্রথম নয়। দিন কয়েক আগে পশ্চিম বন্দর থানার ওসি-র সঙ্গেও দুর্ব্যবহার করেন আকাশ এবং তাঁর কয়েক জন সঙ্গী। সে ক্ষেত্রেও মুখ্যমন্ত্রীর ভাইপো বলে পরিচয় দিয়ে ওসি-কে ‘ধমক’ দিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু লালবাজারের বড়কর্তাদের চাপে ওই থানার ওসি আকাশের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করেননি। কী কারণে আকাশ বারবার ‘মুখ্যমন্ত্রীর ভাইপো’ বলে নিজের পরিচয় দিচ্ছেন? এর পিছনে আসগরের কোনও স্বার্থ রয়েছে কি না, তা জানতেই আসগর সম্পর্কে বিশদ খবর নিচ্ছেন গোয়েন্দারা।
এখানেই শেষ নয়। অভিযোগ, শিবপুর বটানিক্যাল গার্ডেনে মুখ্যমন্ত্রীর ভাইপো বলে পরিচয় দিয়ে ফেব্রুয়ারিতেই দু’-দু’বার নির্ধারিত সময় পেরিয়ে যাওয়ার পরেও সঙ্গীদের নিয়ে ঢুকেছিলেন আকাশ। বুধবার কলকাতায় আকাশ ও তাঁর সঙ্গীদের গ্রেফতারের খবর পাওয়ার পরই সাংবাদিকদের ডেকে এ কথা জানান বটানিক্যালের যুগ্ম অধিকর্তা হিমাদ্রিশেখর দেবনাথ। হিমাদ্রিবাবুর দাবি, আকাশ যে বটানিক্যালে ঢুকেছিলেন, তার প্রমাণ রয়েছে। গার্ডেনের রেজিস্টারে তাঁর স্বাক্ষরও রয়েছে। সেখানে অবশ্য ঠিকানা দেওয়া রয়েছে ৩০বি হরিশ চ্যাটার্জি স্ট্রিট। যেটি খোদ মুখ্যমন্ত্রীর বাড়ি।
গার্ডেন সূত্রে জানা গিয়েছে, গত ৪ ফেব্রুয়ারি এক মহিলা-সহ আকাশ ও তাঁর এক সঙ্গী একটি গাড়িতে করে প্রথম বার বটানিক্যাল গার্ডেনে আসেন। এর পর আসেন ১৯ তারিখ। গাড়ির নম্বর রেজিস্টার খাতায় নথিভুক্ত রয়েছে। নম্বরটি হল ডব্লিউ বি ০৬এইচ ৫৬৮৬। এ দিন এই নম্বরের গাড়িটিই পুলিশ আটক করেছে। গার্ডেন সূত্রের খবর, তাঁরা দু’বারই এসেছিলেন বিকাল সাড়ে ৪টের পর। কলকাতা হাইকোর্টের নির্দেশে ওই সময়ের পরে কাউকে আর গার্ডেনে ঢুকতে দেওয়া হয় না। তিনি ওই সময় ঢুকতে চাইলে গার্ডেনের গেটে কর্তব্যরত নিরাপত্তাকর্মীরা বাধা দেন। তাঁদের সঙ্গেও আকাশদের বচসা বাধে।
 
 
 


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.