পুলিশের ভূমিকায় ক্ষুব্ধ কংগ্রেস
‘ধর্ষিতা’র পাশে থাকা নেতা পদে নেই, তরজা তৃণমূলেই
কেতুগ্রামে ‘ধর্ষিতা’ ও তাঁর পরিবারের পাশে থাকা বিকাশ মজুমদার দলের ‘ব্লক সভাপতি’ নন বলে জানিয়ে দিল তৃণমূল। যদিও তাঁর ‘অপসারণ’ নিয়ে দলের নেতারা পরস্পরবিরোধী কথা বলছেন।
পাশাপাশি, ঘটনার চার দিন পরেও ধর্ষণের অভিযোগে কেউ গ্রেফতার না হওয়ায় পুলিশের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে। বুধবার বিকেলে কাটোয়ার কংগ্রেস বিধায়ক রবীন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে দেখা করে নিরাপত্তার অভাবের কথা জানিয়েছেন মহিলা। তদন্তের পদ্ধতি নিয়েও এমন কিছু প্রশ্ন উঠেছে, পুলিশের কাছে যার সদুত্তর মেলেনি।
মঙ্গলবার মহাকরণে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় (রাজ্যের পুলিশ ও স্বাস্থ্য দফতর তাঁরই অধীন) মন্তব্য করেন, এই ধর্ষণের ঘটনা ‘সাজানো’ কি না তা তদন্ত করে দেখতে হবে। ১১ বছর আগে বিধবা হওয়া অভিযোগকারিণীর ‘স্বামী সিপিএমের স্থানীয় সমর্থক’ বলেও দাবি করেন তিনি। এলাকায় অবশ্য ওই পরিবারের লোকজন কংগ্রেস ও তৃণমূল সমর্থক বলেই পরিচিত।
দুপুরে মেজো ভাসুরের সঙ্গে কাটোয়ায় প্রদেশ কংগ্রেসের সাধারণ সম্পাদক রবীন্দ্রনাথবাবুর কাছে এসে মহিলা বলেন, “এত দিন শক্ত ছিলাম। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রীর মন্তব্যের পরে গ্রামের রাস্তায় বেরোতেও লজ্জা করছে। স্কুলে যেতে মেয়েরা ভয় পাচ্ছে। নিরাপত্তার অভাব বোধ করছি।” রবীন্দ্রনাথবাবু তাঁকে বলেন, “শক্ত হয়ে আইনের লড়াই লড়তে হবে। আমরা পাশে আছি।” প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি প্রদীপ ভট্টাচার্যও এ দিন মহিলাকে টেলিফোন করে ‘অভয়’ দেন। তাঁর বক্তব্য, “আমার কাছে যত দূর খবর আছে, পুলিশের ভূমিকা ভাল নয়। ঘটনাটি ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে। পুলিশ যদি রাজনৈতিক চাপে তদন্তে বিরত থাকে, আইনের চোখে তারাও দোষী।” আজ, বৃহস্পতিবার প্রদেশ কংগ্রেসের সাধারণ সম্পাদক কৃষ্ণা দেবনাথ ও মায়া ঘোষের নেতৃত্বে চার সদস্যের মহিলা প্রতিনিধি দল মহিলার বাড়িতে যাচ্ছে বলেও তিনি জানান।
কেন প্রশ্ন পুলিশের ভূমিকা নিয়ে?
গত শনিবার সন্ধ্যায় কাটোয়া-আমোদপুর লাইনে ট্রেনে ডাকাতির সময়ে ওই মহিলাকে নামিয়ে লাইনের পাশে ঝোপে ধর্ষণ করা হয় বলে অভিযোগ। রাতে স্থানীয় তৃণমূল নেতা বিকাশবাবুর সঙ্গে কাটোয়া জিআরপি-তে গিয়ে তিনি ধর্ষণের অভিযোগ (এফআইআর নম্বর ৬/১২) দায়ের করেন। তাতে তিনি জানিয়েছিলেন, রিভলভার দেখিয়ে তাঁকে ‘বলাৎকার’ করে এক জন। সেখানে আরও তিন জন ছিল। ডাকাতির অভিযোগে রবিবার দু’জনকে গ্রেফতার করে রেলপুলিশ। কাটোয়া আদালতের নির্দেশে মঙ্গলবারই ধর্ষণ মামলার তদন্তভার রাজ্য পুলিশের হাতে গিয়েছে। কিন্তু ধর্ষণের অভিযোগে কেউ গ্রেফতার হয়নি।
প্রশ্ন রয়েছে মহিলার ডাক্তারি পরীক্ষা নিয়েও। পুলিশ সূত্রে জানা গিয়েছে, মঙ্গলবার মহিলার কাপড়, অন্তর্বাস ইত্যাদি ফরেন্সিক পরীক্ষার জন্য বেলগাছিয়ার পরীক্ষাগারে পাঠানো হয়। শনিবার রাতে কাটোয়া হাসপাতালে অভিযোগকারিণীর যে যোনিরস (ভ্যাজাইনাল সোয়াব) সংগ্রহ করা হয়েছিল, পাঠানো হয়েছে তা-ও। কিন্তু ফরেন্সিক বিশেষজ্ঞদের মতে, ঠিক ফল পেতে যোনিরস ২৪ ঘণ্টার মধ্যে পরীক্ষা করা উচিত। তার পরে নমুনা শুকিয়ে যায়। ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে পরীক্ষায় কিছু ফল পাওয়া যেতে পারে। তার পরে ভুলের সম্ভাবনাই বেশি থাকে। অর্থাৎ, শনিবার রাতে যে নমুনা সংগৃহীত হয়েছে, বড় জোর সোমবার রাতের মধ্যে তার পরীক্ষা প্রয়োজন ছিল। রেলপুলিশ সুপার (হাওড়া) মিলন দাসের বক্তব্য, “যা বলার ডিজি বলবেন।” রেলপুলিশের ডিজি দিলীপ মিত্র বলেন, “জেলা পুলিশের কাছে তদন্তভার চলে গিয়েছে। এ নিয়ে একটি কথাও বলব না। এসপি-কে (জেলা পুলিশ সুপার) জিজ্ঞাসা করুন।” বর্ধমানের পুলিশ সুপার সৈয়দ মহম্মদ হোসেন মির্জা বলেন, “মন্তব্য করব না।”
ইতিমধ্যে বাঁকুড়া মেডিক্যালে যে তরুণীকে ধর্ষণ করা হয়েছে বলে অভিযোগ, দ্বিতীয় দফার পরীক্ষার জন্য এ দিন তাঁকে এসএসকেএম হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। তবে কেতুগ্রামের মহিলাকে কলকাতায় পাঠানো হল না কেন? তাঁর ডাক্তারি পরীক্ষা যিনি করেছিলেন, কাটোয়া হাসপাতালের সেই চিকিৎসক রবীন্দ্রনাথ মণ্ডলের সঙ্গে যোগাযোগ করা যায়নি। হাসপাতাল সুপার সোমনাথ মুখোপাধ্যায় বলেন, “বিষয়টি বিচারাধীন, মন্তব্য করব না।” একই কথা পুলিশ সুপারেরও। সিপিএমের জেলা সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য অচিন্ত্য মল্লিকের কটাক্ষ, “মমতা বুধবার মহাকরণে যা বলে দিয়েছেন, তার পরে কার ঘাড়ে ক’টা মাথা যে মুখ খুলবে? উনি আবার মুখে গণতন্ত্রের কথা বলেন!”
এই পরিস্থিতিতে কেতুগ্রাম ২ ব্লক সভাপতির পদ থেকে বিকাশবাবুর ‘অপসারণ’ তৃণমূলের অন্দরেই তরজার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রথম দিন ‘ভয়ঙ্কর ঘটনা’ বলে মন্তব্য করলেও মঙ্গলবার দলনেত্রীর মন্তব্য শোনার পরেই তিনি বলেন, “চক্রান্ত সম্পর্কে মুখ্যমন্ত্রী যা বলছেন, ঠিকই বলছেন বলে এখন আমার মনে হচ্ছে।” তা সত্ত্বেও তাঁকে পদ থেকে ছেঁটে ফেলা হয়েছে বলে কানাঘুষো শুরু হওয়ায় প্রথমে জেলা তৃণমূল সভাপতি (গ্রামীণ) স্বপন দেবনাথ বলেন, “দলবিরোধী মন্তব্য করলে সরতে হবে। কিন্তু বিকাশকে ব্লক সভাপতি পদ থেকে অপসারিত করা হয়েছে বলে আমার জানা নেই।” মহাকরণ থেকে দলের বর্ধমান জেলা পর্যবেক্ষক তথা আইনমন্ত্রী মলয় ঘটকও বলেন, “বিকাশ দলবিরোধী বিবৃতি দিয়েছেন। কিন্তু আমি ওকে অপসারণের নির্দেশ দিইনি। মুকুলবাবু দিয়ে থাকতে পারেন।”
সন্ধ্যায় তৃণমূলের সর্বভারতীয় সভাপতি মুকুল রায় অবশ্য দাবি করেন, “বিকাশবাবুকে দু’বছর আগেই কেতুগ্রাম ২ ব্লক সভাপতির পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছিল। তাঁর বদলে দেবাশিস মণ্ডলকে সভাপতি করা হয়েছে।” অথচ স্থানীয় তৃণমূল এবং কংগ্রেস সূত্রের খবর, পেশায় আইনজীবী দেবাশিসবাবু বিধানসভা নির্বাচনের আগেও কংগ্রেস করতেন। তাঁর বাবা জগন্নাথ মণ্ডল এখনও স্থানীয় বিল্লেশ্বর এলাকায় কংগ্রেসের অঞ্চল সভাপতি। জেলা তৃণমূলের সাধারণ সম্পাদক মণ্ডল আজিজুলও বলেন, “বিধানসভা ভোটের সময়ে ব্লক সভাপতি ছিল বিকাশই। এর পরে ওখানে নতুন কোনও কমিটি তৈরি হয়নি।”
মুকুলবাবুর বক্তব্য শুনে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন কেতুগ্রাম ২ ব্লক কংগ্রেস সভাপতি অরবিন্দ সেনও। তাঁর দাবি, “দেবাশিস আমাদের সক্রিয় কর্মী ছিল। আইন ভাল জানায় জোটধর্মের খাতিরে আমিই তাকে তৃণমূল প্রার্থী শেখ সাহানেওয়াজের অন্যতম নির্বাচনী এজেন্ট করার প্রস্তাব দিই। ভোটের পরে ও তৃণমূলে চলে যায়।” বর্তমানে কেতুগ্রামের বিধায়ক শেখ সাহানেওয়াজ অবশ্য দাবি করেন, “বিকাশ মজুমদারকে আমি চিনি না। আমি বিধায়ক হওয়ার পরে দেবাশিস মণ্ডলই আমার হয়ে সব কাজকর্ম করত।”
দেবাশিসবাবুর দাবি, “কেতুগ্রামে দলীয় পর্যবেক্ষক অনুব্রত মণ্ডল দু’বছর আগেই মৌখিক ভাবে আমায় সভাপতি করে দিয়েছেন।” একই দাবি অনুব্রতবাবুরও। বিধানসভা ভোটের আগে যে এলাকায় সবাই তাঁকে কংগ্রেস করতে দেখেছেন, সে প্রসঙ্গে দেবাশিসবাবর ব্যাখ্যা, “ঠিকই, কিন্তু লুকিয়ে-চুরিয়ে তৃণমূল করতাম।” অরবিন্দবাবুর পাল্টা প্রশ্ন, “যে লুকিয়ে চুরিয়ে দল করে, তাকে কেউ দু’বছর ধরে ব্লক সভাপতি করে রাখে কি?” বহু চেষ্টা সত্ত্বেও বিকাশবাবু ফোন ধরেননি। তবে তাঁর জন্য আক্ষেপ করছে মহিলার পরিবারও। বাড়ির এক সদস্যের কথায়, “মনে হয়, আমাদের প্রতি মানবিকতা দেখাতে গিয়েই উনি দলের বিষনজরে পড়লেন।”



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.