রাজ্যের কোনও প্রত্যন্ত গাঁ-গঞ্জ নয়! ভরদুপুরের ব্যস্ত শিয়ালদহ স্টেশন থেকে ভয় দেখিয়ে মাদক খাইয়ে মেয়েটিকে তুলে দেওয়া হয়েছিল ট্রেনে। নিয়ে আসা হয়েছিল দিল্লিতে। ১৫ বছরের ওই কিশোরীর মাদকাচ্ছন্ন চোখ যখন খুলেছিল, ততক্ষণে সে বিক্রি হয়ে গিয়েছিল দিল্লির জি বি রোডের যৌনপল্লিতে। একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার তৎপরতায় আজ সকালে সেখান থেকেই উদ্ধার করা হয়েছে সোদপুর সংলগ্ন এলাকার ওই কিশোরীকে।
হালফিলে পশ্চিমবঙ্গ থেকে নারী পাচারের এটা অবশ্য কোনও বিক্ষিপ্ত ঘটনা নয়। দার্জিলিঙের এক ১৪ বছরের কিশোরীকেও দক্ষিণ দিল্লির মুনিরকা থেকে উদ্ধার করা হয়েছে বলে আজই সিবিআইয়ের তরফে জানানো হয়েছে। চাকরির লোভ দেখিয়ে গত নভেম্বর মাসে তাকে নিয়ে আসা হয়েছিল দিল্লিতে। চাকরি তো জোটেইনি, উপরন্তু একাধিক লোকের হাতে নির্যাতিত হয় মেয়েটি। জানুয়ারিতে সিবিআইয়ের দিল্লির স্পেশ্যাল ক্রাইম ব্রাঞ্চে ‘অ্যান্টি হিউম্যান ট্রাফিকিং ইউনিট’ তৈরি হয়। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে নিখোঁজ কিশোরী-তরুণীদের খুঁজে বার করার জন্যই গড়া হয়েছে এই বিশেষ শাখা। ফেব্রুয়ারিতে সেই ইউনিটের কাছে দার্জিলিঙের ওই কিশোরী সম্পর্কে তথ্য আসে। এর পর গত ২২ তারিখ মুনিরকা থেকে উদ্ধার করা হয় তাকে।
বস্তুত, সপ্তাহখানেক আগে একই ভাবে জি বি রোডের যৌনপল্লি থেকে কলকাতা পুলিশ উদ্ধার করেছিল বেলগাছিয়া এলাকার একটি মেয়েকে। সেই মেয়েটির দেওয়া সূত্র ধরেই আজ ওই যৌনপল্লি থেকেই উদ্ধার হয় সোদপুর সংলগ্ন এলাকার কিশোরীটি।
স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাটির সদস্য সুবীর রায় জানিয়েছেন, সোদপুরের মেয়েটি নিখোঁজ হয়েছিল কয়েক মাস আগে। রাজু নামে একটি ছেলের সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল ওই স্কুলছাত্রীর। রাজুর বাড়ি শিয়ালদহের রেলওয়ে আবাসনে। পুলিশের কাছে মেয়েটি জানিয়েছে, বেড়াতে যাওয়ার নাম করে তাকে এক দিন শিয়ালদহ স্টেশনে নিয়ে এসেছিল রাজু। সেখানে তাকে এক মহিলার হেফাজতে রেখে রাজু চলে যায়। অনেক ক্ষণ পরেও রাজু ফিরছে না দেখে মেয়েটি কাঁদতে শুরু করতেই তাকে ভয় দেখানো হয়। খুন করার হুমকিও দেওয়া হয়। পুলিশের সন্দেহ, ট্রেনে তোলার পর মেয়েটিকে মাদক মেশানো খাওয়ানো হয়েছিল। তাতেই সে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। ওই ঘটনার দু’দিন পর দিল্লির এক ঘুপচি বাড়িতে ফের রাজুর দেখা পায় মেয়েটি।
রাজুর সঙ্গে তখন তার এক সঙ্গীও ছিল। কিশোরীটি পুলিশকে জানিয়েছে, দিল্লি পৌঁছনোর পরেই তার ওপর অত্যাচার শুরু হয়ে যায়। রাজু ও তার বন্ধুরা দেহব্যবসায় নামানোর জন্য তাকে মারধরও করে। টানা কয়েক দিন অত্যাচারের পরে তাকে বিক্রি করা হয় জি বি রোডের যৌনপল্লিতে।
ওই যৌনপল্লিতেই এই মেয়েটির সঙ্গে দেখা হয় বেলগাছিয়ার মেয়েটির। কোনও এক ফাঁকে সোদপুরের কিশোরীটি তার বাবার নাম আর ফোন নম্বর দিয়ে দিয়েছিল বেলগাছিয়ার মেয়েটিকে। সম্প্রতি সে উদ্ধার হওয়ার পরেই সোদপুরের কিশোরীটির সম্পর্কে জানতে পারেন তার পরিবারের লোকজন। মেয়েটির বাবা যোগাযোগ করেন পুলিশে। তাঁর মেয়ের দিক থেকে বাড়ির সঙ্গে যোগাযোগ রাখছিলেন মেদিনীপুরের বাসিন্দা এক যুবক। মেয়েটির পারিবারিক বন্ধু রানা চক্রবর্তী বলেন, “আমরা যে পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ করেছি, সেই খবর কোনও ভাবে পাচারকারীদের কাছে পৌঁছে গিয়েছিল। আগামী সপ্তাহে রাজ্য পুলিশের একটি দলের দিল্লি যাওয়ার কথা ছিল। তার আগেই মেয়েটিকে অন্যত্র সরানো হবে বলে ঠিক করে ফেলা হয়।” রানাবাবু এর পর যোগাযোগ করেন দিল্লির স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাটির সঙ্গে। মেয়েটির একটি ছবিও পাঠান তিনি।
ঠিক হয়, স্থানীয় পুলিশের সাহায্য নিয়েই রাতে তল্লাশি হবে। কিন্তু গত কাল রাতে বিহার পুলিশের একটি দল জি বি রোড এলাকায় তল্লাশি চালানোয় অপ্রাপ্তবয়স্ক সমস্ত মেয়েকে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল গুড়গাঁওয়ে। পরে রাত দেড়টা নাগাদ তাদের ফিরিয়ে আনা হয় জি বি রোডে। নয়াদিল্লি স্টেশন সংলগ্ন ওই সড়কের ৭০ নম্বর কোঠির ওপর গত কাল রাতভর নজর রাখছিলেন স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাটির সদস্যরা। মেয়েটিকে যে ফিরিয়ে আনা হয়েছে, সে সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়ার পরে আজ সকালেই তল্লাশি হয় নির্দিষ্ট বাড়িটিতে। উদ্ধার হয় মেয়েটি। এখন সে রয়েছে কমলা মার্কেট থানার হেফাজতে। পুলিশ জেনেছে, মেয়েটিকে বিয়েও করেছিল রাজু। মেয়েটির পরিবারকে সে জানিয়েছিল, শিয়ালদহ স্টেশন থেকে বাড়ি ফেরার সময় মেয়েটি নিখোঁজ হয়ে গিয়েছে। রাজ্য পুলিশ সূত্রে জানা গিয়েছে, ওই কিশোরীর বাবাকে নিয়ে পুলিশের একটি দল এই সপ্তাহেই দিল্লি আসছে। তার পরেই গোটা ঘটনাক্রমের একটা সুস্পষ্ট ছবি পাওয়া যাবে বলে মনে করা হচ্ছে।
এই নিয়ে গত এক বছরে পাচার হয়ে যাওয়া প্রায় দু’শোটি মেয়েকে উদ্ধার করল স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাটি। সংস্থার কর্ণধার ঋষিকান্তের বক্তব্য, “উদ্ধার হওয়া মেয়েদের মধ্যে সত্তর শতাংশ পশ্চিমবঙ্গের।” |