তাঁর কাছে রীতিমতো ‘চ্যালেঞ্জ’ ছিল।
বাম আমলের ৩৪ বছরে যে কোনও বন্ধ বা ধর্মঘটের দিন মহাকরণ থাকত পুরোদস্তুর ছুটির মেজাজে। এমনকী বামফ্রন্ট-বিরোধী কোনও দল বন্ধ ডাকলেও ছবিটা প্রায় একই থাকত। সরকারি বদান্যতায় এক দিনের ‘সবেতন ছুটি’ প্রাপ্তির এই পড়ে পাওয়া সুযোগ কিছুতেই হাতছাড়া করতে চাইতেন না কর্মীরা।
সাড়ে তিন দশকের এই অভ্যাস তিনি কি বদলাতে পারবেন? মঙ্গলবার বামেদের ডাকা ধর্মঘটে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে এই চ্যালেঞ্জটাই বড় হয়ে দেখা দিয়েছিল। প্রথমে মুখ্যসচিবের মাধ্যমে ছুটি মঞ্জুর না করার নির্দেশ দিয়ে তিনি একটি বার্তা দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তাতেও সোমবার বিকেল পর্যন্ত ধর্মঘটের দিনের হাজিরা নিয়ে নিশ্চিন্ত হতে পারছিলেন না মুখ্যমন্ত্রী। বরং বিভিন্ন সূত্রে তাঁর কাছে এই বার্তাই আসছিল, সরকার বড়জোর এক দিনের বেতন কাটবে ধরে নিয়ে অনেকেই হয়তো ছুটির স্রোতে গা ভাসাবেন।
ধর্মঘট, বন্ধের স্বঘোষিত বিরোধী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তাই শেষবেলায় তূণের শেষ অস্ত্রটাই বের করেছিলেন। সোমবার রাতে মহাকরণ ছাড়ার আগে তিনি জানিয়ে দেন, “যাঁরা আসবেন না, তাঁদের চাকরিতে ছেদ পড়বে।” মুখ্যমন্ত্রীর এই কড়া হুঁশিয়ারি উপেক্ষা করার সাহস দেখাননি কেউই। এমনকী ধর্মঘটের সমর্থক কো-অর্ডিনেশন কমিটির সদস্য-সমর্থকরাও নন। যার নিট ফল, মঙ্গলবার ধর্মঘট সত্ত্বেও মহাকরণে হাজির ছিলেন শতকরা ৮৪ জন কর্মী। মুখ্যসচিব সমর ঘোষের কথায়, “এই উপস্থিতি সাধারণ দিনের চেয়েও বেশি।”
বন্ধের দিন সরকারি অফিসে হাজিরার বহর দেখে দৃশ্যতই খুশি মমতার মন্তব্য, “সরকারি কর্মীদের জন্য আমি গর্বিত।” এবং তাঁর দাবি, “রাজ্যে কর্মসংস্কৃতি ফিরে এসেছে।” কিন্তু বিপুল হাজিরার হাত ধরে সরকারি অফিসে সত্যিই কি কর্মসংস্কৃতি ফিরে এল? এ দিন মহাকরণে হাজির ইউনিয়নের নেতা এবং কর্মীদের একটি অংশ কিন্তু অন্য কথা বলছেন। তাঁদের বক্তব্য, “চাকরি জীবনে ছেদ পড়লে অবসরের পর পেনশন, গ্র্যাচুইটির ক্ষেত্রে নানা সমস্যা হতে পারে। তাই সেই ঝুঁকি নেওয়ার কোনও মানেই হয় না।”
এই ‘বাধ্যবাধকতা’ অধিকাংশ কর্মীকে অফিসে টেনে আনলেও কর্মসংস্কৃতির কি কোনও পরিবর্তন হল? উত্তর হল, না। বরং গোটা মহাকরণ ঘুরে এর উল্টো ছবিই উঠে এসেছে এ দিন। ধর্মঘট ‘ব্যর্থ’ করতে তৃণমূলের দু’টি ইউনিয়নের আবেদনে সাড়া দিয়ে কর্মীদের রাতে থাকার অনুমতি দিয়েছিল প্রশাসন। হাজিরা নিশ্চিত করতে বিভিন্ন দফতরের আধিকারিকেরা মৌখিক ভাবে জানিয়ে দিয়েছিলেন, অন্য দিনের মতো সাড়ে ১০টার মধ্যে হাজিরা দিতে হবে না। ১২টার মধ্যে এলেই চলবে। হাতে এই বাড়তি দেড় ঘণ্টা সময় পেয়ে অনেকেই এসেছেন দেরিতে। ফেরার ক্ষেত্রেও বিকাল সওয়া ৫টার ভ্রূকুটি ছিল না। তাই হাজিরা দিয়েই অনেকে বাড়ি ফিরেছেন নিজেদের ইচ্ছেমতো সময়ে। কার্যত বিকাল ৩টের পর মহাকরণের বিভিন্ন দফতরে কর্মীদের খুঁজে পাওয়াই কঠিন হয়েছে।
তাঁদের সমর্থক বেশি হওয়া সত্ত্বেও বন্ধে কী করে এত কর্মী এলেন? কো-অর্ডিনেশন কমিটির সাধারণ সম্পাদক অনন্ত বন্দ্যোপাধ্যায়ের বক্তব্য, “চাকরিতে ছেদ পড়ার ভয় দেখিয়ে আনা হয়েছে।” তাঁর দাবি, “মহাকরণ থেকে ব্লক স্তর পর্যন্ত সরকারি অফিসে হাজিরার খাতায় সই রয়েছে গড়ে ৪০%-কর্মীর।” তাঁর অভিযোগ, “আসলে ২৫%-এর বেশি কর্মী হাজির ছিলেন না।”
বন্ধ বা ধর্মঘটের দিন সরগরম মহাকরণ কর্মীদের কাছে এ দিন আক্ষরিক অর্থেই ছিল এক নতুন প্রাপ্তি। সেই প্রাপ্তির প্রত্যাশা বাড়িয়ে দেন মুখ্যমন্ত্রী নিজেই। মহাকরণে এসেছিলেন অন্য দিনের চেয়ে অন্তত এক ঘণ্টা আগে। কিছু ক্ষণ নিজের ঘরে কাটিয়ে হঠাৎ ছিটকে বেরিয়ে আসেন বারান্দায়। সঙ্গে তখন আলোকচিত্রী-পুলিশের এক বিরাট দল। হাজিরা দেখতে মুখ্যমন্ত্রী তখন বিভিন্ন দফতরের ঘরে ঘরে ঢুকছেন। হাতের সামনে মুখ্যমন্ত্রীকে পেয়ে কর্মীরা আপ্লুত। কেউ বলছেন, একটু চা খেয়ে যান। কেউ শুধু কথা বলতেই আগ্রহী। আলোকচিত্রীদের ক্যামেরার সঙ্গে কর্মীদের মোবাইলে ঘন ঘন বন্দী হচ্ছেন মুখ্যমন্ত্রী। সেই ছবি দেখতে মহাকরণের প্রতিটি অলিন্দে ভিড় উপচে পড়েছে কর্মীদের।
প্রথমে আধ ঘণ্টা ঘুরে নিজের ঘরে ঢুকে যান মুখ্যমন্ত্রী। দুপুর ১২টায় ফের ঘর থেকে বেরোন তিনি। এ বারের গন্তব্য মহাকরণের তিন তলা। কিন্তু তিনি চান না, আলোকচিত্রী-সাংবাদিকরা সঙ্গে থাকুন। দোতলায় লিফ্টের কাছে এসে সাংবাদিকদের আটকানোর নির্দেশ দেন মুখ্যমন্ত্রী। পুলিশের উদ্দেশে তাঁর বক্তব্য, “ওটা সংরক্ষিত এলাকা। গুরুত্বপূর্ণ কাগজপত্র চুরি হয়ে যেতে পারে।” এবং এই চুরির দায় আলোকচিত্রীদের উপরেও বর্তাতে পারে বলে জানান তিনি। পরে অবশ্য মুখ্যমন্ত্রী বলেন, ‘‘অনেক বাইরের লোক ছিল। তারা ফাইল সরিয়ে নিতে পারে। তাই আপনাদের কাছে আবেদন করেছিলাম।” দ্বিতীয় দফায় মহকারণের তিন তলা ও চার তলায় বেশ কয়েটি দফতর ঘুরে দেখেন মুখ্যমন্ত্রী। সেই সময় তাঁর সঙ্গে সাংবাদিকরা না থাকলেও ছিলেন পুলিশ এবং তৃণমূলের কর্মী সংগঠনের একাধিক নেতা-কর্মী। সর্বত্রই উপচে পড়া ভিড় আর মোবাইলে ছবি তোলার হিড়িক। তারই মধ্যে টুকরো টুকরো মন্তব্য। এক জন বললেন, “ভাবা যায়! বন্ধের দিন কোনও মুখ্যমন্ত্রী দফতরে দফতরে ঘুরে বেড়াচ্ছেন! উনি দিদিই রয়ে গেলেন, মুখ্যমন্ত্রী হলেন না।” একটু দূরে আর এক জনের মন্তব্য, “এমন বন্ধের দিনে আর এক জনও আসতেন। তিনি যতীন চক্রবর্তী। তখন পূর্তমন্ত্রী ছিলেন।”
ধর্মঘটে সামিল না হয়ে খাদ্য দফতরে এ দিন যাঁরা অফিস করলেন, তাঁরা কার্যত ক্যারম-তাস খেলে, আড্ডা মেরেই দিন কাটালেন। তাঁদের খাবারের জন্য এ দিনও রান্নার ব্যবস্থা করা হয়। দুপুর ২টোর পর সেখানে গিয়ে দেখা গেল, হাতে গোনা দু’চার জন ফাইলে মুখ গুঁজে কাজ কছেন। বাকিরা পুরোদস্তুর ছুটির মেজাজে। খাদ্যমন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিকের দাবি, তাঁর দফতরে ৮২% কর্মীই হাজির। মহিলারা ব্যাপক হারে হাজির থেকেছেন। মন্ত্রীর দাবি, এ দিন অত্যাবশ্যকীয় পণ্য নিগমে উপস্থিতির হার ছিল ১০০%। এক সরকারি অফিসারের দাবি, এই দিন কিছু কাজ হয়েছে। তবে আড্ডা, তাস খেলাই হয়েছে বেশি।
পরিবর্তনের রাজ্যে ধর্মঘটের দিন সরকারি অফিস নতুন চেহারায় দেখা দিল। মহাকরণ দেখল, বামেদের ডাকা ধর্মঘটের দিনেও সরগরম রাজ্য প্রশাসনের সদর দফতর। খুশি মুখ্যমন্ত্রী। সরকারি কর্মীদের ফেরার জন্য তিনি বাসেরও বন্দোবস্ত করেছিলেন। রাতে মহাকরণ ছাড়ার সময় পুলিশ ও অন্য কর্মীদের জিজ্ঞাসা করেন, “আপনাদের ফেরার ব্যবস্থা আছে তো? না থাকলে বলুন। আরও দু’টি বাসের ব্যবস্থা আছে।”
কিন্তু অফিসে এসে কর্মীদের প্রত্যেকেও কি মুখ্যমন্ত্রীর মতোই খুশি? মুখ্যমন্ত্রী ঘনিষ্ঠ এক প্রবীণ মন্ত্রীর কাছে কথাটা বলেই ফেললেন মহিলা কর্মী, “স্যার, এত তো করলাম। এ বার ডিএ-টা মিলবে তো?”
|
সহ প্রতিবেদন: অশোক সেনগুপ্ত, কাজী গোলাম গউস সিদ্দিকী, অত্রি মিত্র |