ধর্মঘটের দিনে সংঘর্ষের বড় ঘটনা ঘটল কলকাতার কাছেই। রাজারহাটে।
একটি স্কুল খোলাকে কেন্দ্র করে সিপিএম এবং তৃণমূলের সংঘর্ষে রণক্ষেত্র হয়ে ওঠে রাজারহাট-গোপালপুর এলাকার বাবলাতলা। গুলিও চলে। গুলিতে আহত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন শঙ্কর রায় নামে এলাকার এক সিপিএম কর্মী। প্রহৃত হন এলাকার তৃণমূলের বিধায়ক সব্যসাচী দত্তের দেহরক্ষী স্বপন মৃধা। মারধরের সঙ্গে জড়িয়ে গিয়েছে এলাকার সিপিএম নেতা ও পুরসভার চেয়ারম্যান তাপস চট্টোপাধ্যায়ের নাম। তৃণমূল নেতারা তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করেছেন। তবে সিপিএমের উত্তর ২৪ পরগনার জেলা সম্পাদক গৌতম দেবের দাবি, তাপসবাবুকে মিথ্যা মামলায় জড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। আজ, বুধবার তাপসবাবু ব্যারাকপুর আদালতে আত্মসমর্পণ করবেন বলে জানিয়ে দেন গৌতমবাবুই।
ঘটনার সূত্রপাত মঙ্গলবার সকালেই। পুলিশ জানায়, রামকুমার কমলা বিদ্যালয় নামে এলাকার মেয়েদের স্কুলটির প্রধান ফটক সকাল থেকেই বন্ধ ছিল। কয়েক জন শিক্ষিকা ও কর্মীরা এসে দেখেন, ফটকে তালা ঝুলছে। তালা খোলার জন্য তাঁরা স্কুল-কর্তৃপক্ষের দ্বারস্থ হন। সাহায্য চাওয়া হয় পুলিশেরও। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, পুলিশের হস্তক্ষেপে শিক্ষিকাদের স্কুলে ঢোকানো হচ্ছে দেখে বাধা দেন সিপিএম সমর্থকেরা। আর স্কুল খোলা রাখার দাবিতে রাস্তায় নেমে পড়ে তৃণমূল। এই নিয়ে দু’পক্ষে বচসা বাধে।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানাচ্ছেন, সেই সময়েই ঘটনাস্থলে হাজির হন নিউ টাউন এলাকার তৃণমূল বিধায়ক সব্যসাচী দত্ত এবং রাজারহাট-গোপালপুর পুরসভার সিপিএম চেয়ারম্যান তাপসবাবু। দুই নেতার সামনেই তাঁদের দলের সমর্থকেরা পরস্পরের দিকে ধেয়ে যান। দু’পক্ষই ইটবৃষ্টি করতে থাকে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পুলিশ লাঠি চালায়। সংঘর্ষের মধ্যেই খবর আসে, সিপিএম কর্মী শঙ্কর রায় গুলিতে আহত হয়েছেন। বছর সাতাশের শঙ্করবাবুর ঊরুতে গুলি লেগেছে বলে জানান বিধাননগরের পুলিশ কমিশনার রাজীব কুমার। প্রহৃত হন সব্যসাচীবাবুর দেহরক্ষী স্বপন মৃধাও। খোয়া যায় তাঁর সার্ভিস রিভলভার।
|
সব্যসাচীবাবুর অভিযোগ, “ঘটনার পিছনে রয়েছেন তাপস চট্টোপাধ্যায়। তিনিই বাইরে থেকে লোক এনে গোলমাল পাকিয়েছেন। তাঁর নেতৃত্বেই স্বপনের সার্ভিস রিভলভারটি ছিনিয়ে নিয়ে তাঁকে গুলি করা হয়েছে। তাঁর অবস্থা আশঙ্কাজনক।” যদিও পুলিশের দাবি, স্বপনবাবুর দেহে গুলির কোনও চিহ্ন নেই। তাঁকে মারা হয়েছে লোহার রড দিয়ে। তাপসবাবুর বিরুদ্ধে পুলিশের কাছে লিখিত অভিযোগ জানান সব্যসাচীবাবুরা। পুলিশ এর পরেই তাপসবাবুর খোঁজ করতে থাকে। তাঁর বাড়ির সামনে পুলিশ বসানো হয়।
তাপসবাবুর পাল্টা অভিযোগ, “সব্যসাচীবাবু নবাবপুর এলাকা থেকে লোক এনে গোলমাল বাধিয়েছেন। আমি এর সিবিআই তদন্ত দাবি করছি। যদি আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হয়, রাজনীতি ছেড়ে দেব। চেয়ারম্যানের পদেও ইস্তফা দেব। আমাদের হেনস্থা করতে আমার বাড়ির সামনে পুলিশ বসিয়ে আমাকে গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে।” পুলিশ জানায়, ওই ঘটনায় ২২ জনকে আটক করা হয়েছে।
বিকেলে বাগুইআটিতে পার্টি অফিসে বসে সাংবাদিক বৈঠক করেন সিপিএমের জেলা সম্পাদক গৌতমবাবু। তাঁর দাবি, একটি ঘটনার সুযোগ নিয়ে ওই এলাকা দখল করতে এসেছিল তৃণমূল। গোটা ঘটনাটিই রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে অভিযোগ করেন তিনি। বলেন, “গুলি লেগেছে সিপিএম কর্মীর। সিপিএমের লোক সার্ভিস রিভলভার চুরি করে সিপিএমের লোককে মারতে যাবে কেন? নিউ টাউনে সিপিএম হারলেও ওই এলাকায় তাপস আট হাজারের বেশি ভোটে জিতেছিল। তৃণমূল রাজারহাট-গোপালপুর পুরসভার ১ থেকে ১০ নম্বর ওয়ার্ডের দখল নিতে চেয়েই ওই ঘটনা ঘটিয়েছে।”
পুলিশ এই ঘটনায় তৃণমূলের হয়ে কাজ করেছে বলেও অভিযোগ জেলা সিপিএমের। গৌতমবাবু বলেন, “তাপসের মোবাইলে ফোন করে পুলিশ কমিশনার বলছেন, রিভলভার খুঁজে বার করতে হবে। এক জন কমিশনার কী ভাবে এ কথা বলেন! যখন গুলি চলে, তাপস ৫০ মিটার দূরে ছিল। তাপসের ওখানে ভাল চেনাজানা আছে ঠিকই। কিন্তু ও কোথা থেকে রিভলভার খুঁজে দেবে? তাপস বুধবার ব্যারাকপুর কোর্টে আত্মসমর্পণ করবে। আমরা মিছিল নিয়ে সেখানে যাব। দেখি, কী হয়! আমরা কমিশনারের বিরুদ্ধে গণস্বাক্ষর সংগ্রহ করে ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে দরবার করব।”
গৌতমবাবুর সাংবাদিক বৈঠকের মধ্যেই বাগুইআটিতে সিপিএমের কার্যালয়ের সামনে ভিড় জমান তৃণমূল সমর্থকেরা। তাতে আটকে পড়েন গৌতমবাবু, অমিতাভ নন্দী, রবীন মণ্ডলেরা। পরে পুলিশ গিয়ে তাঁদের সেখান থেকে বার করে আনে।
বিকেলে ঘটনাস্থলে যান কেন্দ্রীয় মন্ত্রী তথা তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক মুকুল রায় এবং রাজ্যের খাদ্যমন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক। তাঁরা রাজ্য সরকারকে রিপোর্ট দেবেন বলে জানান। পরে সেখানে যান শ্রমমন্ত্রী পূর্ণেন্দু বসুও। বাসিন্দারা, বিশেষ করে মহিলারা তাঁদের কাছে সিপিএমের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসের অভিযোগ জানান। ঘটনাস্থল ঘুরে মুকুলবাবু বলেন, “এ দিন এখানকার সিপিএমের পুরপ্রধান তাপস চট্টোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে সন্ত্রাস সৃষ্টি করা হয়েছে। শিক্ষিকাদের স্কুলের ভিতরে বন্ধ করে তাপসবাবু নিজে গেটে তালা লাগিয়ে দিয়েছেন।’’
দুপুরে সিপিএম রাজারহাট-গোপালপুর পুরভবনেও তালা ঝুলিয়ে দেয় বলে অভিযোগ তৃণমূলের। পূর্ণেন্দুবাবুর অভিযোগ, “পুরপ্রধান হয়েও তাপসবাবুই পুরসভার গেটেও তালা লাগিয়ে দিয়েছেন।” তাপসবাবুর পাল্টা দাবি, “চতুর্থ শ্রেণির কর্মীরা ধর্মঘটে যোগ দিয়েছিলেন। তাই তালা খোলার কেউ ছিল না। পুরসভার তালা খোলার এক্তিয়ার আমার নেই।” |