তখন সবে সকাল পৌনে ন’টা। দক্ষিণ শহরতলিতে বন্ধ ‘কভার’ করতে নেমে কামালগাজি, অজয়নগর মোড়, গড়িয়া মোড় ঘুরে আমরা যাদবপুরের দিকে যাচ্ছি। আমার সঙ্গী চিত্রসাংবাদিক পিন্টু মণ্ডল। গাঙ্গুলিবাগানে অশোক ট্রাস্টের মোড়ে হঠাৎ একটা জটলা দেখেই গাড়িটা ডাইনে ঘোরাতে বললাম। একটু এগোতেই দেখি তৃণমূলের মিছিল। লোহার রড, কাঠের বাটাম ও জোড়াফুল আঁকা কয়েকটা পতাকা হাতে ওঁরা এগোচ্ছেন। কাছেই ডাইনে সিপিএমের জোনাল অফিস। মিছিলটা ‘রে রে’ করে সটান সেখানে ঢুকে পড়ল।
কেন? ব্যাপারটা বুঝতে তখনই গাড়ি থামালাম। কিন্তু মিছিলের মেজাজ বুঝে ক্যামেরা নিয়ে বেশি দূর এগোনোর সাহস হয়নি। আমি আর পিন্টু চোখাচোখি করে মুহূর্তে কে কোথায় থাকব ঠিক করে নিলাম। পিন্টু একটু পিছনে গাড়ির কাছ থেকে ক্যামেরা তাক করে পার্টি অফিসের সামনে জটলাটার ছবি নিতে শুরু করেছে। আর, আমি একটু এগিয়ে কী হচ্ছে দেখার চেষ্টা করছি।
|
আমাদের চোখের সামনেই রডের বাড়ি মেরে তালাবন্ধ দরজাটা ওরা ভেঙে ফেলল। তার পরে ১০-১২টা ছেলে ভিতরে ঢুকে চেয়ার-টেবিল উল্টে কাগজপত্র তছনছ করতে শুরু করল। ওই যুবকদের মধ্যে এক জন, চেনা মুখ। কলকাতা পুলিশের কনস্টেবল তারক দাস। কিন্তু তিনি তো ওই তল্লাটে পাটুলি থানার কর্মী নন! তাহলে বিস্কুট-রঙা একেবারে ঘরোয়া টি-শার্ট আর কালো প্যান্ট পরনে তিনি গাঙ্গুলিবাগানে কী করছেন? আমায় চিনতে পেরে তারকবাবুই আঙুল উঁচিয়ে বললেন, “তোমাদের লোক ছবি তুলছে কেন? এক্ষুনি কেটে পড়ো। এখানে কী দেখতে এসেছ?” তত ক্ষণে আরও কয়েকজন মিলে আমাকে ঘিরে ধরেছে। পিছনে তাকিয়ে দেখি ওরা পিন্টুর মুখে দমাদ্দম ঘুষি মারছে। ওর ক্যামেরাটাও কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা করছে। মুখে অকথ্য গালিগালাজ। ঘিয়ে রঙের ফুলহাতা টি-শার্ট পরা একটা ছেলে পিন্টুকে চেপে ধরে বলছিল, “কোথা থেকে এসেছিস? আনন্দবাজার নাকি? ভাল চাস তো ক্যামেরা খুলে রিলটা বার করে দে!”
এক জন পুলিশকর্মী একটু সাহায্য করার চেষ্টা করেছিলেন। পিন্টু ক্যামেরাটা বাঁচাতে ওঁর হাতেই তুলে দিল সেটা। কিন্তু পরক্ষণেই দেখলাম, ছেলেগুলো ওঁর হাত থেকে ক্যামেরা কেড়ে নিয়েছে। কী ভাবে ছবি মুছতে
হয় বুঝতে না-পেরে ক্যামেরাটাই মাটিতে আছড়ে ভাঙার চেষ্টা করছে। সেই সঙ্গে চলছে পিন্টুর উপরে ঘুষির বৃষ্টি। ২৫-৩০ জন ছেলে মিলে তত ক্ষণে আমাকেও ঘিরে ধরেছে। সবুজ টি-শার্ট পরা একটা ছেলে আমায় জাপ্টে ধরে মাটিতে ফেলার চেষ্টা করছিল। অত সকালেও মুখে মদের গন্ধ। মনে হচ্ছিল, বাকিদের মধ্যেও কেউ কেউ মদ্যপ অবস্থায়। যা-খুশি গালিগালাজ দিয়েই চলেছে ওরা। |
কোনও মতে টাল সামলে আমি শুধু নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে থাকার চেষ্টা করছিলাম। এক বার পড়ে গেলে তো অত জন মিলে পায়ের নীচে পিষেই মেরে ফেলবে! অত জনের মারই বা কী ভাবে আটকাব? মুখটা বাঁচাতে গেলে বুকে-পিঠে মার খাচ্ছি। এই ভাবে কত ক্ষণ ধস্তাধস্তি চলল, ১০ মিনিট না ২০ মিনিট কে জানে! অতগুলো লোককে ঠেলে সরিয়ে আদৌ কী ভাবে বেরোব, বুঝে উঠতে পারছিলাম না। এক সময়ে কয়েক জন পুলিশকর্মী ভিড়ের মধ্যে ঢুকে ওদের সরানোর চেষ্টা শুরু করলেন। ওঁরাই আমাকে টেনে বার করে কারও একটা মোটরসাইকেলে বসিয়ে বার করে নিয়ে গেলেন। দেখি, তখনও পিন্টুকে নিয়ে পুলিশ এবং ওই মারকুটে ছেলেগুলোর ‘টাগ-অফ-ওয়ার’ চলছে। পকেটে হাত দিয়ে দেখি আমার মোবাইলটা উধাও। পুলিশের সঙ্গেই মোটরসাইকেলে পাটুলি থানায় এলাম। দেখি, পিন্টুও আমাদের অফিসের গাড়িতে বসে কয়েক জন পুলিশকর্মীর সঙ্গে আসছে। পুলিশই আমার মোবাইল ফোন ও আমাদের ক্যামেরাটা ভাঙা অবস্থায় উদ্ধার করে পিন্টুর হাতে তুলে দিয়েছিল। ঘুষিতে আমার চোখে কালশিটে পড়েছে। পিন্টুর ঠোঁট কেটে রক্ত ঝরছিল। ও বলছিল, বাঁ কানের পিছনে রগের কাছটায় অসহ্য যন্ত্রণা হচ্ছে। পুলিশ আমাদের বাঘাযতীন হাসপাতালে মেডিক্যাল পরীক্ষার জন্য নিয়ে গেল।
ফেরার পথে পুলিশ এবং এলাকার লোকেদের সাহায্যে কয়েকটা ছেলের নাম জানতে পারলাম। তারক দাস ছাড়া মানিক বণিক, মৃত্যুঞ্জয় মণ্ডল, পুলক চৌধুরী, মনু সাহা, দাশু সাহা, জয়দেব দাস, বাবু সাহা, রাজু সাহাদের নামগুলো তখনই শুনলাম। পাটুলি থানায় লিখিত অভিযোগে পিন্টু এই নামগুলোই পুলিশকে জানিয়েছে। আমরা যখন থানায় যাচ্ছিলাম, তখন স্টার আনন্দ ও অন্য সংবাদমাধ্যম ওই অশোক ট্রাস্টের গলিতে ঢুকছে। পরে জানতে পারলাম, স্টার আনন্দ-এর চিত্রসাংবাদিক পার্থপ্রতিম ঘোষকেও তৃণমূল সমর্থকরা মাটিতে ফেলে বেধড়ক পিটিয়েছে। |