মহাকরণ-সহ সরকারি দফতরে হাজিরার হার সাধারণ দিনের চেয়ে বেশিই। কিন্তু সেই বৃত্তের বাইরের বেসরকারি ক্ষেত্রে বন্ধের দিনের চিরাচরিত ‘ঐতিহ্য’ বজায় রাখল বাংলা।
সাম্প্রতিক কালের মধ্যে এই প্রথম সরকার ধর্মঘট মোকাবিলায় সমস্ত পরিকাঠামোগত বাড়তি ‘সহায়তা’ মজুত রাখল বিমানবন্দর, রেল স্টেশন, তথ্যপ্রযুক্তি ক্ষেত্রের মতো এলাকায়। প্রশাসনিক স্তরে ‘অভয়’ দিলেন স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী। তা সত্ত্বেও মঙ্গলবার ফাঁকাই রয়ে গেল রাস্তাঘাট। বন্ধই রইল অধিকাংশ দোকানপাট-বাজার এবং বেসরকারি দফতর।
এর প্রথম কারণ যদি হয়ে থাকে বাঙালির বিখ্যাত ‘কর্মবিমুখ’ এবং ‘ছুটি-পিপাসু’ মানসিকতা, তা হলে দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ কারণ হল কলকাতা, বৃহত্তর কলকাতা এবং রাজ্যের বিভিন্ন এলাকায় বিচ্ছিন্ন গোলমালজনিত আতঙ্কের আবহ। যা নিউজ-চ্যানেল বাহিত হয়ে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে গোটা রাজ্যে একই সঙ্গে আইনশৃঙ্খলাজনিত ‘বিপন্নতা’ এবং ‘বাইরে না-বেরোনো’র যুক্তিকে আরও জোরালো করে দিল। সম্ভবত ভবিষ্যতের জন্যও এই ইঙ্গিত রেখে গেল যে, এ রাজ্যে যে কেউ বন্ধ ডাকলেই তা ‘সফল’ হয়ে যাবে।
মহাকরণ এবং বিভিন্ন সরকারি দফতরে হাজিরার নিরিখে ‘তৃপ্ত’ মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বন্ধ ‘ব্যর্থ’ বলে দাবি করে বলেছেন বটে যে, “বন্ধের কর্মনাশা সংস্কৃতি এ দিনই শেষ হয়ে যাক। আর যেন কেউ বন্ধ করার সাহস না-পায়!” বা বন্ধ ব্যর্থ করার জন্য রাজ্যবাসীকে ‘অভিনন্দন’ জানিয়েছেন। কিন্তু ঘটনাপ্রবাহ অন্য সঙ্কেত দিচ্ছে। প্রত্যাশিত ভাবেই, সারা দিনের ঘটনাচক্রে ‘হতাশ’ রাজ্যের শিল্প ও বাণিজ্য মহল। যদিও রাজ্য সরকার বন্ধের বিরোধিতা করায় শিল্পমহল প্রাথমিক ভাবে ‘খুশি’ই হয়েছিল। শিল্পোদ্যোগীরা ভেবেছিলেন, সরকারের সক্রিয় বিরোধিতার ফলে কলকাতা-সহ রাজ্যের মানুষ ‘উজ্জীবিত’ হয়ে বন্ধ ব্যর্থ করতে দলে দলে রাস্তায় নেমে পড়বেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা ঘটেনি। রাজ্যের এক শিল্পপতির কথায়, “ভেবেছিলাম, সরকারের সদিচ্ছায় সাড়া দেবে আমজনতা। খুব আশা ছিল। কিন্তু দিনের শেষে খুব হতাশ লাগছে।”
‘হতাশা’ এই কারণেই যে, তাঁর সরকারের যাবতীয় ‘সদিচ্ছা’ সত্ত্বেও সরকারি ক্ষেত্র (যেখানে ‘সার্ভিস ব্রেক’
সংক্রান্ত হুঁশিয়ারি কাজ করেছে বলেই প্রশাসনিক মহলের অভিমত) ছাড়া মুখ্যমন্ত্রী মমতা তাঁর ‘ধর্মযুদ্ধে’ রাজ্যের সিংহভাগ মানুষের সাড়া পেলেন না। বস্তুত, প্রশাসক হিসেবে তাঁর আমলের প্রথম ধর্মঘটের যে ধরনের ‘জঙ্গি-বিরোধিতা’য় মুখ্যমন্ত্রী নেমেছিলেন, তাতে ‘জয়’ একপ্রকার নিশ্চিতই ছিল। কিন্তু ‘খামতি’ রয়ে গেল ঐতিহ্যগত বঙ্গ-মানসিকতা, কার্যত প্রথম প্রহরেই তাঁর দলের কিছু অবিমৃষ্যকারী সমর্থকের আচরণ এবং সম্ভবত নিজের ঈষৎ ‘বাড়াবাড়ি’র ফলেই। যে কারণে বিরোধী সিপিএম তাঁর বিরুদ্ধে ‘দমনপীড়নের’ অভিযোগ তুলেছে। প্রকাশ্যে আমল দিতে না-চাইলেও একান্ত আলোচনায় দলীয় কর্মীদের অসহিষ্ণুতার বিষয়টি কার্যত স্বীকার করে নিচ্ছেন তৃণমূল নেতাদের একাংশও। দলের এক প্রথম সারির নেতার কথায়, “শুরুটা ভাল করেও শেষে দলের এক শ্রেণির লোকের অভব্যতার মাসুল দিতে হল। সিপিএমের প্ররোচনা ছিল ঠিকই। কিন্তু তাতে পা না-দেওয়াটাই বুদ্ধিমানের কাজ হত। শাসক হিসেবে সেই সংযমটা দেখানো উচিত ছিল।”
|
সোমবারেই মুখ্যমন্ত্রী তথা তৃণমূল নেত্রী মমতা সাফ নির্দেশ দিয়েছিলেন, তৃণমূলের কোনও নেতা-কর্মী রাস্তায় নেমে মিছিল করবেন না। তাঁরা বড়জোর বিভিন্ন এলাকায় থেকে যাঁরা কাজে আসতে চান, তাঁদের ‘সাহায্য’ করবেন। বন্ধ-সমর্থকেরা কোথাও জোর করে ধর্মঘট করাতে চাইলে প্রশাসনকে খবর দেবেন। কিন্তু কেউই আইন নিজের হাতে তুলে নেবেন না। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেল, ক্ষমতার পরিবর্তন হলেও শাসক দলের শাসক-সুলভ ‘দম্ভ’ রয়ে গিয়েছে। স্বয়ং দলনেত্রীর নির্দেশ ‘অগ্রাহ্য’ করে তৃণমূলের কর্মীরা বন্ধ ‘ব্যর্থ’ করতে ‘সক্রিয়’ হয়েছেন।
পাশাপাশি, আলিমুদ্দিন স্ট্রিটের নির্দেশ ‘উপেক্ষা’ করেছে সিপিএম ক্যাডারদের একাংশও। রাজ্যের বিভিন্ন এলাকায় তারা সেই ‘জোর খাটিয়ে’ই বন্ধ করাতে ‘সক্রিয়’ হয়েছে। বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্র ২৪ ঘণ্টা আগেই ধর্মঘট না-করার ‘অধিকারে’র কথা বলেছিলেন। কিন্তু তাঁর কথার তোয়াক্কা না-করেই রাজারহাট-গোপালপুর পুরসভার সিপিএম চেয়ারম্যান সরকারি স্কুলে এবং পুরসভায় তালা ঝুলিয়ে দিয়েছেন। বারাসতে জোর করে বাস থামিয়ে চালককে মারধর করা হয়েছে।
মোদ্দা কথায়, বন্ধ-সমর্থক এবং বন্ধ-বিরোধীরা বিভিন্ন এলাকায় সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েছে। এবং সেটা সংশ্লিষ্ট দু’দলের শীর্ষ নেতৃত্বের নির্দেশকে আমল না-দিয়েই!
এর ফলে যেমন শাসক তৃণমূলের গায়ে বিরোধী সিপিএম ‘ফ্যাসিবাদী কায়দা’ নেওয়ার অভিযোগ সেঁটে দিতে পেরেছে, তেমনই প্রধান বিরোধী দলের ‘সংযত বিরোধী ভাবমূর্তি’ও খানিকটা ক্ষুণ্ণ হয়েছে। তফাত হল শাসক দলের সর্বময় নেত্রী জানিয়েছেন, গাঙ্গুলিবাগানের ঘটনা সাজানো। আর বিরোধী দলনেতা জানিয়েছেন, তাঁদের সমর্থকদের তরফে এমন কিছু ‘ব্যতিক্রম’ ঘটে থাকলে তা ‘নিন্দনীয়’।
মুখ্যমন্ত্রী মমতা বলেছেন, “সরকারি কর্মীদের জন্য আমি গর্বিত। ৩৪ বছর পর এই প্রথম বন্ধ ব্যর্থ করে সরকারি কর্মী-অফিসাররা কাজে এসেছেন। এটা ঐতিহাসিক। আমি এখনও মনে করি, বন্ধ বাংলার ভবিষ্যৎ নয়। বন্ধ করে বোধহয় কাউকে কাউকে রাজনৈতিক অস্তিত্ব জাহির করতে হয়। এটা খুব দুর্ভাগ্যজনক।”
যে ভাবে মমতা সরকারের তরফে বন্ধ ব্যর্থ করতে নেমেছিলেন, তা ‘ঐতিহাসিক’ তো বটেই। বিভিন্ন সরকারি দফতর ছাড়াও পরিবহণ, বিমানবন্দর, শিক্ষা-সহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে বন্ধ মোকাবিলায় চোখে পড়ার মতো পরিকাঠামো মোতায়েন রেখেছিলেন তিনি। সকাল থেকে রাস্তায় রাস্তা ঘুরে বেড়িয়েছেন পরিবহণমন্ত্রী মদন মিত্র। সল্টলেকের তথ্যপ্রযুক্তি ক্ষেত্র (পরিকাঠামোগত সহায়তা ব্যবহার করে সেখানে প্রায় ৮০ শতাংশ কর্মী কাজে এসেছিলেন) তো বটেই শিয়ালদহ স্টেশন বা কলকাতা বিমানবন্দরের জন্য বিশেষ বাস চালু করারও নির্দেশ দেন তিনি। মোটের উপর রেল চলাচল স্বাভাবিক রাখা গিয়েছিল। কলকাতা বিমানবন্দর থেকে একটি উড়ানও বাতিল হয়নি। (তৃণমূল সাংসদ কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের উচ্ছ্বসিত মন্তব্য, “১৯৮৯ সাল থেকে বন্ধের দিন দিল্লি থেকে কলকাতায় আসার চেষ্টা করছি। এই প্রথম নির্বিঘ্নে এসে পৌঁছতে পারলাম।”)
এই পর্যন্ত ঠিকই ছিল। মমতা দাবিও করেন, “আগে লোকে ভয় পেয়ে ঘরে বসে থাকত। ছুটি কাটাত। কিন্তু এ দিন তারা কাজে এসেছে। বন্ধ ব্যর্থ করেছে জনসাধারণ। আমরা তাদের কাছে কৃতজ্ঞ।” কিন্তু বাস্তব বলছে, পর্যাপ্ত যানবাহন থাকলেও রাস্তায় নামেননি মানুষ। সপ্তাহের অন্যান্য কাজের দিনের চেয়ে ছবিটা এতটাই আলাদা ছিল যে, চোখে লেগেছে। যার উপর ভর করে প্রধান বিরোধী দল সিপিএম বলেছে, বন্ধ ‘স্বতঃস্ফূর্ত ও সফল’। যা যে কোনও বন্ধের আহ্বায়করাই বলে থাকেন।
দিনের প্রথম ভাগে জনতার ‘অনীহা’। বেলা গড়ানোর আগেই বিক্ষিপ্ত গোলমাল। বস্তুত, সকালের পরেই পরিস্থিতি দ্রুত বদলাতে থাকে। সোমবার মুখ্যমন্ত্রী বলেছিলেন, “সিপিএমের পাল্টা করতে তৃণমূল রাস্তায় ডান্ডা নিয়ে দাঁড়াক, এটা চাই না।” কিন্তু বাস্তবে দেখা গেল, গাঙ্গুলিবাগানে সিপিএমের জোনাল কমিটি দফতর ভাঙচুরের দায়ে অভিযুক্ত হল তৃণমূল। জড়িয়ে পড়ল সাংবাদিক-নিগ্রহের ঘটনাতেও।
ধর্মঘটের ‘ধর্মযুদ্ধে’ কি জিতলেন প্রশাসক মমতা?
তিনি নিজে নিশ্চিত, ‘জয়’ হয়েছে এবং রাজ্য থেকে বন্ধ-সংস্কৃতি হটিয়ে নতুন কর্মসংস্কৃতির সূচনা এ দিনই হয়ে গেল। মঙ্গলবারের বাস্তব বলছে, মানসিকতার ‘পরিবর্তন’ ছাড়া নতুন কর্মসংস্কৃতি আনা কঠিন। নইলে ‘পড়ে-পাওয়া’ ছুটিতে ভবিষ্যতেও মজে থাকবে বঙ্গসমাজ। |