কেন্দ্রের নির্দেশ অগ্রাহ্য করে রাজ্যের প্রতিটি সরকারি হাসপাতালে ব্যবহার করা হচ্ছে পারদ ভরা রক্তচাপ মাপার যন্ত্র এবং থার্মোমিটার। প্রতিটি হাসপাতালে প্রায় রোজই এ রকম একাধিক যন্ত্র ভেঙে ছড়িয়ে পড়ছে ক্ষতিকর পারদ। নিরাপদ প্রক্রিয়ায় ওই পারদ সাফ করার জন্য দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের বিধি যে প্রায় কোনও সরকারি হাসপাতালেই মানা হয় না, তা স্বীকার করেছেন স্বাস্থ্যকর্তারাই। ফলে পারদ-দূষণ থেকে রোগী এবং হাসপাতালের চিকিৎসক ও কর্মীদের শারীরিক সমস্যার আশঙ্কা পুরো মাত্রায় থাকছে।
বছরখানেক আগেই কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য দফতর থেকে একটি নির্দেশ পাঠানো হয় রাজ্য স্বাস্থ্য দফতরে। সেখানে বলা হয়, হাসপাতালে পারদ যুক্ত যন্ত্রপাতি আর ব্যবহার করা যাবে না। তার বদলে রক্তচাপ মাপার ডিজিটাল যন্ত্র এবং ডিজিটাল থার্মোমিটার ব্যবহার করতে হবে। এক বছর কেটে গিয়েছে। তবু যন্ত্রপাতি প্রায় কিছুই বদলায়নি। সম্প্রতি আবার স্বাস্থ্য দফতরকে একই নির্দেশনামা পাঠিয়েছে কেন্দ্র। চিঠি দেওয়া হয়েছে চিকিৎসকদের সংগঠন “ইন্ডিয়ান মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন’-এর রাজ্য শাখাকেও।
কেন্দ্রের চিঠির জেরে আবার নড়েচড়ে বসা স্বাস্থ্যকর্তারা এখন খোঁজ নিতে গিয়ে দেখছেন, এত দিনে রক্তচাপ মাপার ডিজিটাল যন্ত্র ও ডিজিটাল থার্মোমিটার কেনার সরকারি অর্ডারটুকুও সেন্ট্রাল মেডিক্যাল স্টোর্স থেকে দেওয়া হয়ে ওঠেনি! স্বাস্থ্য দফতরের মুখপাত্র অসিত বিশ্বাসের কথায়, “পারদ ভরা যন্ত্রের ব্যবহার বন্ধ করা নিয়ে কেন্দ্র থেকে একটি নির্দেশনামা এসেছিল। আমরাও ধাপে ধাপে ওই যন্ত্রের ব্যবহার বন্ধ করব বলে জানিয়েছিলাম। কিন্তু এখনও ডিজিটাল যন্ত্র কেনার দরপত্র ডাকা হয়নি। এর জন্য অনেক টাকা লাগবে, সেটিও দেরির একটি কারণ। তবে অন্য অফিসারদের সঙ্গে কথা বলছি, যাতে দ্রুত ওই দরপত্র ডাকা যায়।”
পারদ ভরা যন্ত্রের ব্যবহার পুরোদমে চললেও তা ভাঙার পরে পারদ পরিষ্কার করার যথাযথ প্রশিক্ষণ বা জ্ঞানই নেই স্বাস্থ্যকর্মীদের। নীলরতন সরকার মেডিক্যাল কলেজ কর্তৃপক্ষের কথায়, “একটি বেসরকারি সংস্থা প্রচুর ডিজিটাল যন্ত্র বিনা পয়সায় দিয়েছিল। ডাক্তারেরা কেউ ব্যবহার করেন না। বলেন, পারদের যন্ত্র ব্যবহারই সুবিধাজনক। ব্যবহার করতে গিয়ে অসংখ্য যন্ত্র ভাঙে। হয় সেই প্রচণ্ড বিষাক্ত পারদ হাসপাতালের মেঝেতেই পড়ে থাকে, অথবা অন্য মেডিক্যাল বর্জ্যের সঙ্গে মিশিয়ে প্যাকেটে ভরে রেখে দেওয়া হয়।” মেডিক্যাল কলেজের এক চিকিৎসক-শিক্ষকের কথায়, “নার্স আর চতুর্থ শ্রেণির কর্মীদের বুঝিয়ে বুঝিয়ে আমরা ক্লান্ত। রক্তচাপ মাপার যন্ত্র ভাঙছে। পারদ ওয়ার্ডে পড়ে আছে। তা মাড়িয়েই সবাই যাতায়াত করছে!”
ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজের মেডিসিন বিভাগের এক চিকিৎসক এবং এসএসকেএমের ইউরোলজি বিভাগের অন্য এক চিকিৎসকেরও অভিযোগ, প্রায় প্রতি দিন পারদ ভরা রক্তচাপ মাপার যন্ত্র বা থার্মোমিটার ভাঙছে। পারদ কোনও মতে ঝাঁট দিয়ে একপাশে সরিয়ে রাখা হচ্ছে। ঝাঁটাতে লেগে, লোকের পায়ে-পায়ে তা সর্বত্র ছড়াচ্ছে। পারদ পরিবেশে মিশে যায় না। এর থেকে কী পরিমাণ দূষণ ছড়ায় এবং কতটা শারীরিক সমস্যা হতে পারে, তার সচেতনতাই নেই। দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ এ ব্যাপারে সাফাই দিতে গিয়ে জানিয়েছে, হাসপাতালগুলিতে লিখিত ভাবে জানানো হয়েছিল, কোনও যন্ত্র ভেঙে পারদ ছড়িয়ে পড়লে সঙ্গে সঙ্গে তা আলাদা একটি প্যাকেটে ভরে রাখতে। যে সংস্থা অন্য মেডিক্যাল বর্জ্য নিয়ে যায়, তারাই ওই প্যাকেট নিয়ে যাবে। কিন্তু হাওড়ায় অন্য বর্জ্য যেখানে অটোক্লেভে দিয়ে নষ্ট করা হয়, সেখানে ওই পারদ যাবে না। সেটি নিয়ে যাওয়া হবে হলদিয়ায়। সেখানে একটি বিশেষ প্রক্রিয়ায় তা ব্যবহার করা হবে। কিন্তু কোনও সরকারি হাসপাতাল থেকে আলাদা করে পারদের প্যাকেট আসছে না। সেখানে এ ব্যাপারে কেউ নজরদারি করার নেই। সরকারি হাসপাতালের অন্য মেডিক্যাল বর্জ্যের সঙ্গেই পারদ মিশছে। চলে যাচ্ছে সাধারণ অটোক্লেভ যন্ত্রেও। তার থেকে অন্য ‘টক্সিক’ রাসায়নিক পরিবেশে তৈরি হচ্ছে কি না, তা-ও খতিয়ে দেখা হচ্ছে না। |